সম্প্রতি ধর্ষণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশজুড়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেখানে বিভিন্ন মহল থেকে ধর্ষণের সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বা ফাঁসির দাবি জোরেশোরে উঠেছে। বিক্ষুব্ধ জনতার একাংশের স্লোগানে ও প্ল্যাকার্ডে ‘ধর্ষকের ফাঁসি চাই’ বা ‘প্রকাশ্যে ফাঁসি চাই’-এর মতো দাবিও দেখা যাচ্ছে।
ফাঁসির দাবি নিয়ে আন্দোলন বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে দাবি হিসেবে ‘বিচার’-এর চেয়ে ‘ফাঁসি’ মুখ্য—এটা প্রমাণ করে, এখানে সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বা ক্যাপিটাল শাস্তি খুব জনপ্রিয়।
বাংলাদেশে মানবাধিকারের বোঝাপড়ার করুন হালত বোঝা যায় ফাঁসি-সংক্রান্ত আলোচনায়। বর্তমানে বাংলাদেশ যে স্তরে প্রবেশ করেছে, ফাঁসির দাবিকে কেন্দ্র করে যে ফ্যাসিবাদ এখানে কায়েম হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতার জেরে আমরা বলতে পারি, ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আমাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
কেন ধর্ষণের সাজা হিসেবে জনগণ ফাঁসি চায়বাংলাদেশে ধর্ষণের দৃশ্যমান কোনো বিচার হয় না। যেমন ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পুলিশের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে যত ধর্ষণের মামলা হয়েছিল, তার মধ্যে রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং সাজার হার শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ (বাংলা ট্রিবিউন, ২০১৭)।
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার বেহাল দশা, আইনি ও পুলিশি ব্যবস্থার ঔপনিবেশিক খাসলত, দিনের পর দিন মামলার হয়রানি, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং আইনের ভেতরকার সংকট—সব মিলিয়ে বিচারহীনতার এমন এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যে জনগণের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়ে আছে, এ রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব নয়।
জনগণের মধ্যে যখন এমন ধারণা দৃঢ় হয়, তখন তারা একদিকে ফাঁসির মতো সর্বোচ্চ শাস্তি কামনা করে, অন্যদিকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ধর্ষকের মৃত্যু হলে উল্লসিতও হয়। ক্রসফায়ারের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনে ‘ধর্ষণ’কে ব্যবহার করার নজির আমরা দেখেছি আওয়ামী শাসনামলে। মৃত্যুদণ্ডের মতো চরম শাস্তিকে তখন সমাধান হিসেবে দেখতে পছন্দ করে জনগণ।
বাংলাদেশে ‘মৃত্যুদণ্ড’ বা ফাঁসি শাস্তি হিসেবে খুব জনপ্রিয় হলেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো মৃত্যুদণ্ডকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করে। তারা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে কিছু যুক্তি প্রদান করে।
মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্ত শাস্তি। এর প্রয়োগ হয়ে গেলে সেখান থেকে ফেরত আসার আর উপায় নেই। আইন-আদালতে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয় এবং পৃথিবীতে এমন অনেক নজির আছে, যেখানে বহু বছর পর কাউকে নির্দোষ প্রমাণিত হতেও দেখা গিয়েছে। কিন্তু শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে গেলে ভুল শোধরানোর আর কোনো উপায় থাকে না।
আরেকটি জনপ্রিয় ধারণা হচ্ছে, ফাঁসির মতো চরম শাস্তি দিলে অপরাধপ্রবণতা হ্রাস পায়। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে অপরাধ কমেছে, পৃথিবীর কোথাও এমন কোনো নজির পাওয়া যায় না। ত্রুটিপূর্ণ বিচারব্যবস্থার সহজ সমাধান হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বেশি থাকে। পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের নজিরও দুনিয়ায় রয়েছে।
এসব কারণে আন্তর্জাতিক সংগঠনসমূহ মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন উপায়ে শেখ হাসিনার বিচার করার ক্ষেত্রেও এই প্রশ্নটি উঠেছে। যেহেতু আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড রয়েছে, সেহেতু ইতিমধ্যে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিংয়ের প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে, তারা এ বিচারপ্রক্রিয়ায় সহায়তা করবে না।
ধর্ষণের সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড কেন বিপজ্জনক২০২০ সালের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড আইনে যুক্ত হয়েছিল। তখন এ আলোচনা অনেকেই করেছিলেন। আজকেও একই দাবির পুনরাবৃত্তি নতুন করে পুরোনো আলাপ করতে বাধ্য করছে।
শুধু ধর্ষণ কেন, পৃথিবীতে কোনো অপরাধই মৃত্যুদণ্ডের কারণে কমেছে, এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড লৈঙ্গিক সহিংসতাকে নজিরবিহীন স্তরে নিয়ে যাবে। আইনের ভেতরকার সংকটগুলোকে আমলে না নিয়ে কেবল আইনকে কঠোর থেকে কঠোরতর করলে সহিংসতার চক্র বৃদ্ধি পাবে। অনেকেই বলে থাকেন, ধর্ষণের সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড হলে ধর্ষণের পর হত্যা করার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেতে পারে। মৃত্যুদণ্ডকেন্দ্রিক এ আলোচনা নারীর প্রতি সহিংসতার কাঠামোগত বিভিন্ন দিক রয়েছে এবং তার সঙ্গে ধর্ষণের সম্পর্ককে উপেক্ষা করে।
বাংলাদেশের বাস্তবতাও যদি আমরা আমলে নিই, তাহলে দেখব যে এখানে দুটো ঘটনা খুব বেশি ঘটে। একদিকে প্রচুর ভুয়া ধর্ষণের মামলা হয় এবং অন্যদিকে বিভিন্ন কারণে ঘটনা ‘নথিভুক্ত’ করার প্রবণতাও কম। ভুক্তভোগীকে থানায় গিয়ে মামলা করতে গেলে যে ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয় বা সামাজিক চাপে ঘটনাকে তারা চেপে যান, হয়তোবা নানাবিধ ‘আপস’ করতে বাধ্য হন। ধর্ষণের সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড একদিকে ‘সামাজিক ফয়সালা’র প্রবণতা বৃদ্ধি করবে, অর্থাৎ ঘটনা আরও কম নথিভুক্ত হবে। যেহেতু প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড, সেহেতু নানা চাপ দিয়ে আপসে মিটমাট করার চেষ্টাই বেশি করা হবে আমাদের সমাজবাস্তবতায়। অন্যদিকে এটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ‘ধর্ষণ’ মামলাকে ব্যবহারের প্রবণতাও বৃদ্ধি করবে।
আইনের ভেতরে যে ধরনের পুরুষতান্ত্রিক উপাদান আছে, যা এই বিচারপ্রক্রিয়াকে ধীর করে বা খোদ ভুক্তভোগীর জন্য বিচার পাওয়াকে কঠিন করে তোলে বা ভুক্তভোগীকে আরেক দফা ভিকটিমে রূপান্তর করে, সেগুলোকে তাড়াতে হবে। বিচারব্যবস্থাকে সচল করতে হবে। বিচারব্যবস্থায় যত গাফিলতি হবে, তত বেশি সমাজে আরও ‘কঠোর’ দাবির উত্থাপন ঘটতে থাকবে। এমনকি ‘ক্রসফায়ার’ হাজির হতে পারে এ অছিলায়।মৃত্যুদণ্ড নারীর অধিকারের পরিপন্থী ব্যবস্থাদুনিয়াজুড়ে যাঁরা নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা ধর্ষণের সাজা হিসেবে ফাঁসির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁরা বলেন, ধর্ষণের সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড নারী অধিকারের পরিপন্থী একটি পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা।
তাঁদের যুক্তি মোতাবেক, ধর্ষণের সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড—এ ধারণার গোড়ায় রয়েছে এক পুরুষতান্ত্রিক পূর্বানুমান। ধর্ষণ যেন হত্যা বা খুনের চেয়ে ভয়াবহ এক পরিণতি। ‘ইজ্জত’-এর পুরুষতান্ত্রিক ধারণা থেকে এটার জন্ম হয়, নারীর জীবনে ধর্ষণই সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা এবং ধর্ষণের শিকার হওয়ার মাধ্যমে নারীর ‘ইজ্জত’ ভূলুণ্ঠিত হয়। সে নারীর যেন সমাজে আর কোনো স্থান নেই। জীবনের চেয়ে ‘সতীত্ব’কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। এটা একদিকে যেমন ‘ইজ্জত’ বা ‘সতীত্ব’-এর পুরুষতান্ত্রিক পূর্বানুমানগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করে, তেমনি সমাজে খুন বা হত্যাকে স্বাভাবিক বা প্রত্যাশিত অপরাধে পরিণত করে।
ফলে গবেষকেরা বলেন, ধর্ষণের সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড আসলে নারী অধিকারের প্রশ্নে পশ্চাৎযাত্রা। কাঠামোগত লিঙ্গবৈষম্য, যা কিনা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাকে টিকিয়ে রাখে ও জায়েজ করে, তা থেকে মনোযোগ দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় মৃত্যুদণ্ডকেন্দ্রিক আলোচনা। মৃত্যুদণ্ড আসলে ধর্ষণকে তো দূর করেই না, বরং রাষ্ট্র ও সমাজকে ধর্ষণের সংস্কৃতিকে মোকাবিলা করা থেকে দূরে রাখে। যে যুক্তিতে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলা হয়, তা পুরুষতান্ত্রিক ভাষা ও কাঠামোর পুনরুৎপাদনই করে। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি-সংক্রান্ত আলোচনা ভুক্তভোগীর পুনর্বাসনকেও প্রায়ই এড়িয়ে যায়।
জুলুমের কাঠামো ভাঙাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে নারী নিপীড়ন ও নারীর ওপর কর্তৃত্ববাদী চর্চার প্রতিবাদে দেশজুড়ে আন্দোলন চলছে। এ আন্দোলন আসলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানেরই ধারাবাহিকতা। যে নারীর অংশগ্রহণ ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম চাবিকাঠি, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে জনপরিসরে নারীর উপস্থিতিকে সংকুচিত করার যে মহড়া চলছে কত দিন যাবৎ, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
তবে আমাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ভাষা ও বয়ান যেন স্বৈরতান্ত্রিক বা জুলুমবাজির চক্রের মধ্যে গিয়ে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জুলুমের বিরুদ্ধে আমরা যে ভাষা ও পদ্ধতি দাঁড় করাব, সেটা যেন আরেক জুলুমের হাতিয়ার না হয়ে ওঠে। এমন সংকটকালীন মুহূর্তে বহু জনতুষ্টিবাদী দাবি উঠতে পারে, যেগুলো পরবর্তী সময়ে নিপীড়নমূলক হাতিয়ার হয়ে উঠবে। নিপীড়নমূলক সব আইনের ন্যায্যতা উৎপাদন করা হয়ে থাকে এমন সংকটের অজুহাতেই।
আইনের ভেতরে যে ধরনের পুরুষতান্ত্রিক উপাদান আছে, যা এই বিচারপ্রক্রিয়াকে ধীর করে বা খোদ ভুক্তভোগীর জন্য বিচার পাওয়াকে কঠিন করে তোলে বা ভুক্তভোগীকে আরেক দফা ভিকটিমে রূপান্তর করে, সেগুলোকে তাড়াতে হবে। বিচারব্যবস্থাকে সচল করতে হবে। বিচারব্যবস্থায় যত গাফিলতি হবে, তত বেশি সমাজে আরও ‘কঠোর’ দাবির উত্থাপন ঘটতে থাকবে। এমনকি ‘ক্রসফায়ার’ হাজির হতে পারে এ অছিলায়।
ইনসাফের দাবিকে কোনো বে-ইনসাফির উপলক্ষ হয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না। নারীর নিরাপত্তার জন্য আন্দোলনকে আরেক সহিংসতার ভাষিক কথকথার চক্র তৈরির উপলক্ষ করতে দেওয়া যাবে না।
সহুল আহমদ লেখক ও গবেষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র প রবণত ব যবস থ র পর প আম দ র অপর ধ একদ ক
এছাড়াও পড়ুন:
ইফতারের রাজনৈতিক অর্থনীতি
রাজনৈতিক দলগুলো ইফতার মাহফিলের নামে মূলত সমাবেশের আয়োজন করছে। এটিকে বলা যায় ইফতার রাজনীতি। আয়োজক দল সাধারণত সমমনাদের দাওয়াত দিয়ে থাকে। তবে সৌজন্যের খাতিরে প্রতিপক্ষকে দাওয়াত দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমন্ত্রিতদের হাজির হতে দেখা যায় না। যেমন গত ৪ মার্চ রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের সম্মানে জাতীয় পার্টির ইফতার আয়োজনে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলের নেতারা যাননি।
এ বছর অবশ্য ইফতার ঘিরে রাজনীতি বেশিই জমে উঠেছে। যেমন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী ঘোষণা দিয়েছিলেন– ‘আল্লাহ যদি আমাকে বেহেশতেও নিতে চান, আমি জামায়াতের সঙ্গে বেহেশতে যাব না। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। যুদ্ধের সময় মা-বোনের ইজ্জত হরণ করতে পাকিস্তানিদের সহযোগিতা করেছে। জামায়াত ছাড়া কারও সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই’। ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার হতেয়া হাজী হাফিজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তাঁর এই ঘোষণা সে সময় সংবাদমাধ্যমে যথেষ্ট আলোচিত হয়েছিল। আদতে দেখা গেল, গত ৮ মার্চ (২০২৫) টাঙ্গাইল প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে টাঙ্গাইল জেলা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ আয়োজিত ইফতার মাহফিলে অংশ নিয়েছেন তিনি।
কাদের সিদ্দিকী জামায়াত প্রসঙ্গে আরও বলেছিলেন, জামায়াত জাতির কাছে মাফ চাক, ভুল স্বীকার করুক, তারপর রাজপথে আসুক। জামায়াতে ইসলামী একাত্তরের ভূমিকার জন্য মাফ চেয়েছে– এমন খবর আমাদের জানা নেই। কাদের সিদ্দিকীর কাছে গোপনে মাফ চেয়েছে বলে কি আমরা ধরে নেব? মাফ না চাইলেও কাদের সিদ্দিকী জামায়াতের ইফতার অনুষ্ঠানে কেন হাজির হলেন?
জামায়াতের ইফতারে কাদের সিদ্দিকীর অংশগ্রহণ যদি নিরেট রাজনৈতিক হয়, নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির ইফতার ইস্যুটি তাহলে সম্ভবত রাজনৈতিক অর্থনীতি। মঙ্গলবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ইফতার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এনসিপি। রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, সাংবাদিক, ছাত্র-শ্রমিক, পেশাজীবী, সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে নিয়ে এনসিপি এই ইফতার পার্টির আয়োজন করে। পাঁচতারকা হোটেলে নতুন দল, যেটির এখনও নিবন্ধন হয়নি; এমন রাজনৈতিক দলের পক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ ইফতার আয়োজন চমকিত হওয়ার মতোই ঘটনা।
প্রশ্ন জাগে, এ রাজনৈতিক দলের অর্থের উৎস কোথায়? অবশ্য এনসিপি দলীয় তহবিল গঠনের জন্য ‘ক্রাউডফান্ডিং’ করবে বলে জানিয়েছে ইতোমধ্যে। গত ৮ মার্চ দলের এক সংবাদ সম্মেলনে বার্তা সংস্থা রয়টার্সে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা অনলাইন ও অফলাইনে একটি ক্রাউডফান্ডিংয়ের (গণচাঁদা সংগ্রহ) দিকে যাচ্ছি, যে ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে আমরা দলের কার্যালয় স্থাপনসহ নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করব’ (সমকাল অনলাইন, ৮ মার্চ ২০২৫)।
রাজনীতিতে গণচাঁদা সংগ্রহ অভিনব কিছু নয়। রাজনৈতিক দল ও সংগঠন গণচাঁদা সংগ্রহ করেই চলে। মওলানা ভাসানী মুষ্টি ধান-চাল সংগ্রহ করার বুদ্ধি দিয়েছিলেন তাঁর সমর্থকদের। এখন অবশ্য দিন বদলেছে। কেবল মুষ্টি ধান-চালের জোগান দিয়ে রাজনীতির চাকা ঘোরে না। ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো এখন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মুষ্টি ধান-চাল নিচ্ছে না, বরং ধান-চালের একাধিক
কারখানা নিজেদের পকেটে নিয়ে দিব্যি বসে আছে। এইভাবে দলের তহবিলের জন্য ফান্ড নেওয়ায় সমস্যা হয় তখন, যখন রাজনৈতিক দলগুলো বেনিয়া ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কাছ থেকে টাকা নেয় এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় একনিষ্ঠ থাকে। এভাবে চাঁদা নেওয়ার ফলে জনগণের সেবক হওয়ার বদলে রাজনৈতিক দলগুলো বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও মুনাফালোভীর সেবক হিসেবে কাজ করে।
সারাবিশ্বেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের পরিচালন ব্যয় নির্বাহের জন্য গণচাঁদা গ্রহণ করে। তবে আমাদের সঙ্গে তাদের ব্যবধান হচ্ছে– প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য। তারা চাঁদা নিয়ে থাকে প্রকাশ্যে, আমরা নিয়ে থাকি অপ্রকাশ্যে। আমাদের কোন রাজনৈতিক দলের তহবিলে কোন শিল্পপ্রতিষ্ঠান কত টাকা চাঁদা দিয়েছে, তার সুলুক সন্ধান করা কঠিন।
আমরা যদি উন্নত গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকার দিকে না তাকিয়ে প্রতিবেশী ভারতের দিকেও তাকাই, তাহলেও গণচাঁদার হিসাব পাওয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে দ্য হিন্দুর গত ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করা যায়। ভারতের আম আদমি পার্টির নেত্রী ও দিল্লির সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতিশী মার্লেনা দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে প্রচারণার খরচ মেটাতে একটি গণতহবিলের প্রচারণা চালিয়েছিলেন। নির্বাচনী ব্যয়ের জন্য ৪০ লাখ রুপি দরকার ছিল।
এখন ধরা যাক, আমাদের দেশের একটি নতুন রাজনৈতিক দলের ইফতার পার্টিতে দুই কোটি টাকা দরকার। এ পরিমাণ অর্থ গণচাঁদার মাধ্যমে উত্তোলন করা সম্ভব কিনা? রাজনৈতিক দল এবং দাতা উভয়েই স্বেচ্ছায় এ তথ্য প্রকাশ করবে কিনা? যদি নতুন দিনের রাজনীতির কথা বলা হয়, বিপরীতে সেই পুরোনো পথেই, অর্থাৎ তথ্য গোপন করার পথেই রাজনৈতিক দলগুলো এগিয়ে যায়, তাহলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বদল হবে কী করে?
আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে পবিত্র রমজান মাসের ইফতার ঘিরে যে নির্বাচনী হাওয়া বইছে, তাতে যেন কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর ভাগ্যবদল না ঘটে। জনগণের জন্য যে রাজনীতি, জনগণের উদ্দেশে যে ইফতারের আয়োজন করা হয়, সেটির খরচের খাতও জনগণের সামনে পরিষ্কার করা জরুরি। কেননা, সমর্থকদের মধ্যে রাজনৈতিক দলের এজেন্ডার গ্রহণযোগ্যতা মূল্যায়নের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণত সদস্যদের চাঁদা, অনুদান নিয়ে থাকে। এটিই রীতি। আবার শুভাকাঙ্ক্ষীরাও অর্থ দিয়ে থাকেন। তবে কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের উৎসের স্বচ্ছতা থাকতে হবে। একইভাবে গণতহবিলের ক্ষেত্রেও একই নীতি থাকা প্রয়োজন। সব তথ্য জনসমক্ষে উপস্থাপন করতে হবে। আবার নির্বাচন কমিশনেও আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত তথ্যে এসবের উল্লেখ থাকতে হবে। কমিশন চাইলেই যেন তা স্বতন্ত্রভাবে নিরীক্ষা করতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নেতাকর্মীকে আরও চাঙ্গা ও ঐক্যবদ্ধ করতে রমজানে ইফতার মাহফিল আয়োজনে করার উদ্যোগ নিয়েছে। দীর্ঘ দেড় দশক পরে দেশ স্বাভাবিক রাজনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ইফতার রাজনীতির মাধ্যমে দল বা জোট গোছানো এবং নিজেদের মধ্যে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে বলে মনে করি। ইফতার মাহফিলকে ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে দেখতে চাইলে, রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের মুখোমুখি হবার প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে হবে। নইলে ইফতার মাহফিল আয়োজনের আর্থিক দিক নিয়ে যেমন কথা হবে, তেমনি তা ইফতারের যে পুণ্য সেটিও অধরা থেকে যাবে।
এহ্সান মাহমুদ: সহকারী সম্পাদক,
সমকাল; কথাসাহিত্যিক