মাদক মাফিয়ারা কারাগারে তবু সক্রিয় ১৪ চক্র
Published: 15th, March 2025 GMT
রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের ৪ নম্বর সেক্টরে সাকিল বুক ডিপো থেকে ৭ নম্বর সেক্টরের ডাস্টবিন পর্যন্ত চলে গেছে একটি রাস্তা। এর মধ্যেই তিনটি পয়েন্টে দেখা মেলে তিন দল মাদক বিক্রেতার। শুরুতে পাপ্পু স্যালুন এলাকায় ইমতিয়াজ ও শাহ আলমের লোকজন ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন বিক্রি করছে। কিছুদূর এগোনোর পর নাসিরের সিমেন্টের দোকানের আশপাশে হাসিব এবং আরও পরে ভাঙাড়ি দোকান এলাকায় মাদক বিক্রি করছিল আজাদ-বিল্লালের সহযোগীরা। রাস্তায় নতুন কাউকে দেখলেই তারা হাঁকডাক শুরু করে। কেউ বলছিল, ‘পাতা লাগবে, পাতা?’ আবার কেউ বলে, ‘ছোট না বড়?’ আরেক দল শুধু বলছিল, ‘পঞ্চাশ-একশ, পঞ্চাশ-একশ’।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাতা মানে হেরোইন, ছোট না বড় বলতে ইয়াবার আকারের ভিত্তিতে দুটি ধরন এবং পঞ্চাশ-একশ বলতে গাঁজার পুরিয়ার দাম বোঝানো হচ্ছে। নিয়মিত ক্রেতা সাংকেতিক শব্দ শুনলেই বুঝতে পারেন কোন কারবারি কী বিক্রি করছে।
ঢাকায় মাদকের প্রধান এই স্পট ঘিরে কয়েক মাসে দফায় দফায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে ভূঁইয়া সোহেল ও চুয়া সেলিমের মতো ‘মাদক মাফিয়া’সহ বহু কারবারি ধরা পড়ে। তবু থেমে নেই মাদক কারবার। এখনও ছোট-বড় ও নতুন-পুরোনো মিলিয়ে অন্তত ১৪টি মাদক চক্র রয়েছে। এর কোনোটি নতুন করে সক্রিয় হয়েছে, কোনোটি আগে ছোট পরিসরে ছিল এখন বিস্তৃত, আবার গ্রেপ্তার কারবারির জায়গা দখল করে চালানো হচ্ছে কোনো কোনো চক্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্যাম্পের পূর্ব পাশের (হুমায়ুন রোড) ৬ নম্বর লাইনে বড় কারবারির অন্যতম ইমতিয়াজ ও শাহ আলম। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা চুয়া সেলিম এই চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিত। সেই সঙ্গে কোপ মনু গ্রুপের সমর্থনও ছিল। এখন মাঠে বড় কারবারি কম থাকার সুযোগে আগে ছোট পরিসরে চলা চক্রটি বেচাকেনার পরিধি আরও বাড়িয়েছে। এই চক্রের ম্যানেজার পিচ্চি সামির। তার হয়ে কালা ফয়সাল, লালন, কালা ভিকি গাঁজা সংগ্রহ করে দেয়। চক্রটি ইয়াবা ও হেরোইনও বিক্রি করে।
একই (৬ নম্বর) লাইনের আরেকটি শক্তিশালী চক্র চালায় হাসিব, তার ভাই মনির, সোনু ও মিঠু। তাদের আরেক ভাই হীরা এখন কারাগারে। টিপু তাহেরীর সার্বিক সহায়তা নিয়ে চলা চক্রটির পরিবারের নারী সদস্যরাও এ কারবারে জড়িত। এ ছাড়া তাদের ৭ থেকে ৮ বিক্রয়কর্মী আছে, যারা নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে মাদক বিক্রি করে। একই লাইনে নতুন করে কারবার শুরু করেছে আজাদ, তার ভাই ইকবাল ও বিল্লাল। তারা তিন ভাই ছাড়াও পাঁচ-ছয়জন বিক্রয়কর্মী মূলত গাঁজাই বিক্রি করে।
ভূঁইয়া সোহেল গ্রেপ্তারের পর কারবারের হাল ধরেছে তার ভাই টুনটুন। সেই সঙ্গে আছে নাস্সো, গেঞ্জিওয়ালা মনু, ফরিদ, নাদিম ও নাসিম। ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের আল-ফালাহ মডেল ক্লিনিক এলাকার পাবলিক টয়লেটের আশপাশে তারা মূলত হেরোইন বিক্রি করে। সেই সঙ্গে মেলে ইয়াবা, গাঁজাও। বড় এই চক্রের আছে ৩০ থেকে ৪০ বিক্রয়কর্মী।
আরেকটি বড় গ্রুপ চালায় সৈয়দপুরিয়া বাবু। ক্যাম্পের ‘সি’ ব্লকের এ-ওয়ান মোড় এলাকায় তাদের ২০ জনের মতো বিক্রয়কর্মী মূলত হেরোইন বিক্রি করে। তাদের পরিচালনা করে নওশাদ, লম্বু রানা ও ভাতিজা রুবেল। চক্রের আরেক সদস্য বম এখন জেলে। পিচ্চি রাজার আলাদা কারবার থাকলেও সে এই চক্রকে সহায়তা করে। তার চক্রে সহযোগী হিসেবে আছে শ্বশুর খুরশিদ, আদিল, বড় রাজা ও তার ভাই শাহজাদা। চক্রের অন্যতম সদস্য দিলদার চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবা নিয়ে আসে।
আরেক মাদক মাফিয়া চুয়া সেলিম কারাগারে থাকলেও ‘বি’ ব্লকে তার পরিবারের সদস্যরা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। একই এলাকায় নতুন করে গজিয়ে ওঠা একটি চক্র চালায় সামির ওরফে নেটা সামির ও তার মামা কামরান। তারা মূলত দিলদার নামের এক পাইকারি সরবরাহকারীর মাদক বিক্রি করে। ‘বি’ ব্লকের পুরোনো আরেকটি চক্র চালায় আলমগীর। অন্যতম সহযোগী তার ভাই পারভেজ এখন কারাগারে। তবে পরিবারের সদস্যরাও নেমে পড়েছে কারবারে। সেই সঙ্গে বিক্রয়কর্মী আছে ১০ থেকে ১৫ জন। জয়নুল, মোনা ও সাফিনের চক্র ‘সি’ ব্লক থেকে পাইকারি গাঁজা বিক্রি করে। একইভাবে ক্যাম্পের ৬ নম্বর সেক্টরে আগে থেকেই পাইকারি গাঁজা বিক্রি করে আসছে গলি জাহিদ। ৫ নম্বর সেক্টরের আরেকটি পুরোনো চক্র চালায় নাদিম, সাজু, মুরাদ ও সিঁথি। তারা গাঁজা, ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রি করে। মাহমুদ, মামুন ও মাহবুবের একটি চক্র আছে। তারা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী সুবিধামতো স্থানে মাদক পৌঁছে দেয়।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান সমকালকে বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে নিয়মিতভাবে মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে। গত ছয় মাসে মাদক ও অস্ত্রসংক্রান্ত প্রায় দেড়শ মামলা হয়েছে। এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। তবে শুধু পুলিশি অভিযানে ক্যাম্পের মাদক কারবার নির্মূল করা কঠিন। সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দরকার।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: হ র ইন ব ক র ব ক রয়কর ম এল ক য় ক রব র র আর ক সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
মাদক মাফিয়ারা কারাগারে তবু সক্রিয় ১৪ চক্র
রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের ৪ নম্বর সেক্টরে সাকিল বুক ডিপো থেকে ৭ নম্বর সেক্টরের ডাস্টবিন পর্যন্ত চলে গেছে একটি রাস্তা। এর মধ্যেই তিনটি পয়েন্টে দেখা মেলে তিন দল মাদক বিক্রেতার। শুরুতে পাপ্পু স্যালুন এলাকায় ইমতিয়াজ ও শাহ আলমের লোকজন ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন বিক্রি করছে। কিছুদূর এগোনোর পর নাসিরের সিমেন্টের দোকানের আশপাশে হাসিব এবং আরও পরে ভাঙাড়ি দোকান এলাকায় মাদক বিক্রি করছিল আজাদ-বিল্লালের সহযোগীরা। রাস্তায় নতুন কাউকে দেখলেই তারা হাঁকডাক শুরু করে। কেউ বলছিল, ‘পাতা লাগবে, পাতা?’ আবার কেউ বলে, ‘ছোট না বড়?’ আরেক দল শুধু বলছিল, ‘পঞ্চাশ-একশ, পঞ্চাশ-একশ’।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাতা মানে হেরোইন, ছোট না বড় বলতে ইয়াবার আকারের ভিত্তিতে দুটি ধরন এবং পঞ্চাশ-একশ বলতে গাঁজার পুরিয়ার দাম বোঝানো হচ্ছে। নিয়মিত ক্রেতা সাংকেতিক শব্দ শুনলেই বুঝতে পারেন কোন কারবারি কী বিক্রি করছে।
ঢাকায় মাদকের প্রধান এই স্পট ঘিরে কয়েক মাসে দফায় দফায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে ভূঁইয়া সোহেল ও চুয়া সেলিমের মতো ‘মাদক মাফিয়া’সহ বহু কারবারি ধরা পড়ে। তবু থেমে নেই মাদক কারবার। এখনও ছোট-বড় ও নতুন-পুরোনো মিলিয়ে অন্তত ১৪টি মাদক চক্র রয়েছে। এর কোনোটি নতুন করে সক্রিয় হয়েছে, কোনোটি আগে ছোট পরিসরে ছিল এখন বিস্তৃত, আবার গ্রেপ্তার কারবারির জায়গা দখল করে চালানো হচ্ছে কোনো কোনো চক্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্যাম্পের পূর্ব পাশের (হুমায়ুন রোড) ৬ নম্বর লাইনে বড় কারবারির অন্যতম ইমতিয়াজ ও শাহ আলম। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা চুয়া সেলিম এই চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিত। সেই সঙ্গে কোপ মনু গ্রুপের সমর্থনও ছিল। এখন মাঠে বড় কারবারি কম থাকার সুযোগে আগে ছোট পরিসরে চলা চক্রটি বেচাকেনার পরিধি আরও বাড়িয়েছে। এই চক্রের ম্যানেজার পিচ্চি সামির। তার হয়ে কালা ফয়সাল, লালন, কালা ভিকি গাঁজা সংগ্রহ করে দেয়। চক্রটি ইয়াবা ও হেরোইনও বিক্রি করে।
একই (৬ নম্বর) লাইনের আরেকটি শক্তিশালী চক্র চালায় হাসিব, তার ভাই মনির, সোনু ও মিঠু। তাদের আরেক ভাই হীরা এখন কারাগারে। টিপু তাহেরীর সার্বিক সহায়তা নিয়ে চলা চক্রটির পরিবারের নারী সদস্যরাও এ কারবারে জড়িত। এ ছাড়া তাদের ৭ থেকে ৮ বিক্রয়কর্মী আছে, যারা নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে মাদক বিক্রি করে। একই লাইনে নতুন করে কারবার শুরু করেছে আজাদ, তার ভাই ইকবাল ও বিল্লাল। তারা তিন ভাই ছাড়াও পাঁচ-ছয়জন বিক্রয়কর্মী মূলত গাঁজাই বিক্রি করে।
ভূঁইয়া সোহেল গ্রেপ্তারের পর কারবারের হাল ধরেছে তার ভাই টুনটুন। সেই সঙ্গে আছে নাস্সো, গেঞ্জিওয়ালা মনু, ফরিদ, নাদিম ও নাসিম। ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের আল-ফালাহ মডেল ক্লিনিক এলাকার পাবলিক টয়লেটের আশপাশে তারা মূলত হেরোইন বিক্রি করে। সেই সঙ্গে মেলে ইয়াবা, গাঁজাও। বড় এই চক্রের আছে ৩০ থেকে ৪০ বিক্রয়কর্মী।
আরেকটি বড় গ্রুপ চালায় সৈয়দপুরিয়া বাবু। ক্যাম্পের ‘সি’ ব্লকের এ-ওয়ান মোড় এলাকায় তাদের ২০ জনের মতো বিক্রয়কর্মী মূলত হেরোইন বিক্রি করে। তাদের পরিচালনা করে নওশাদ, লম্বু রানা ও ভাতিজা রুবেল। চক্রের আরেক সদস্য বম এখন জেলে। পিচ্চি রাজার আলাদা কারবার থাকলেও সে এই চক্রকে সহায়তা করে। তার চক্রে সহযোগী হিসেবে আছে শ্বশুর খুরশিদ, আদিল, বড় রাজা ও তার ভাই শাহজাদা। চক্রের অন্যতম সদস্য দিলদার চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবা নিয়ে আসে।
আরেক মাদক মাফিয়া চুয়া সেলিম কারাগারে থাকলেও ‘বি’ ব্লকে তার পরিবারের সদস্যরা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। একই এলাকায় নতুন করে গজিয়ে ওঠা একটি চক্র চালায় সামির ওরফে নেটা সামির ও তার মামা কামরান। তারা মূলত দিলদার নামের এক পাইকারি সরবরাহকারীর মাদক বিক্রি করে। ‘বি’ ব্লকের পুরোনো আরেকটি চক্র চালায় আলমগীর। অন্যতম সহযোগী তার ভাই পারভেজ এখন কারাগারে। তবে পরিবারের সদস্যরাও নেমে পড়েছে কারবারে। সেই সঙ্গে বিক্রয়কর্মী আছে ১০ থেকে ১৫ জন। জয়নুল, মোনা ও সাফিনের চক্র ‘সি’ ব্লক থেকে পাইকারি গাঁজা বিক্রি করে। একইভাবে ক্যাম্পের ৬ নম্বর সেক্টরে আগে থেকেই পাইকারি গাঁজা বিক্রি করে আসছে গলি জাহিদ। ৫ নম্বর সেক্টরের আরেকটি পুরোনো চক্র চালায় নাদিম, সাজু, মুরাদ ও সিঁথি। তারা গাঁজা, ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রি করে। মাহমুদ, মামুন ও মাহবুবের একটি চক্র আছে। তারা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী সুবিধামতো স্থানে মাদক পৌঁছে দেয়।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান সমকালকে বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে নিয়মিতভাবে মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে। গত ছয় মাসে মাদক ও অস্ত্রসংক্রান্ত প্রায় দেড়শ মামলা হয়েছে। এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। তবে শুধু পুলিশি অভিযানে ক্যাম্পের মাদক কারবার নির্মূল করা কঠিন। সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দরকার।