মসজিদের মাইকে ডাকাত ঘোষণা দিয়ে সাতকানিয়ায় দু’জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের ছনখোলা পশ্চিমপাড়া এলাকায় গত ৩ মার্চ রাতে এ ঘটনা ঘটে।
রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে থাকতেন জাহাঙ্গীর আলম নামের একজন ব্যবসায়ী। সেখানে জুমার নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। কিন্তু চাঁদাবাজরা তাঁর প্রাণ কেড়ে নেয় পথেই। চাহিদামতো চাঁদা না দেওয়ায় একটি সন্ত্রাসী দল গত ২৪ জানুয়ারি প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলে জাহাঙ্গীরকে। এ ঘটনায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন আব্বাস উদ্দিন নামে তাঁর সাথে থাকা আরেক ব্যক্তি। রাউজানে গত পাঁচ মাসে বিএনপির দু’গ্রুপের মধ্যে অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে ৯টি। ৫ আগস্টের পর রাউজানে বিএনপির দুটি গ্রুপের মধ্যে হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনাও ঘটেছে অর্ধশত।
শুধু উপজেলা নয়; চট্টগ্রাম নগরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ এসে থানার ওসিকে পিটিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে প্রকাশ্যে। শনিবার মধ্যরাতে তাকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশেরই এক পরিসংখ্যান বলছে, ৫ আগস্ট-পরবর্তী ছয় মাসে চট্টগ্রামে খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও অপহরণের মতো অপরাধ আগের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খুন ও অপহরণ।
চট্টগ্রাম মহানগরী এলাকায় প্রায় ৭০ লাখ মানুষের জন্য রয়েছে ১৬টি থানা। পুলিশ সদস্য রয়েছে মাত্র সাত হাজার। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে পুলিশের অনেকে মামলার আসামি হয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে চলছে তদন্ত। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বেশির ভাগ থানা। লুট করা হয়েছে পুলিশের অস্ত্র। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও এখন আর আগের মতো সমীহ করছে না পুলিশকে। এসব কারণে এখনও সেভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারছে না পুলিশ। কমিয়ে দিতে হয়েছে ফাঁড়ি ও থানার টহল পুলিশের কার্যক্রম। যেতে পারছে না তারা কঠিন অ্যাকশনেও। অবশ্য পুলিশ দাবি করছে, তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করছে। ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে প্রাণপণে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ গণমাধ্যমকে বলেন, বিদ্যমান জনবল কাঠামো দিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা। সারাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে চট্টগ্রামে অপরাধের হারও তুলনামূলক কম।
তবে ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম সফরে এসে চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয় বলে মন্তব্য করেন অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লে.
বেশি বেড়েছে খুন ও অপহরণ: পুলিশের অপরাধ পরিসংখ্যান বলছে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকায় আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত মোট মামলা হয়েছে ২ হাজার ৬৭টি। এর মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৪৪, ডাকাতির মামলা ৪২, নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ১৬৭, অপহরণের ২৩, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ৩৪ ও চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৫৯টি। ২০২৪ সালের আগস্টে মেট্রোপলিটনের ১৬টি থানায় ২৪৬টি মামলা হলেও সেপ্টেম্বর থেকে মামলার পরিমাণ বেড়েছে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে ৩৮০টি মামলা, অক্টোবরে ৩৫৬, নভেম্বরে ৩৭৬, ডিসেম্বরে ৩৩৮ ও জানুয়ারিতে মামলা হয়েছে ৩৭১টি। চট্টগ্রাম মহানগরীর চিত্র আলাদা করে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগরীতে শুধু ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছে ১১৮টি। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৪টি বেশি। এখন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খুন ও অপহরণের ঘটনা।
অর্ধশত সংঘর্ষে আহত শতাধিক: ৫ আগস্টের পর শুধু রাউজানেই বিএনপির উভয় গ্রুপের মধ্যে অর্ধশত হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৬টি সংঘর্ষের ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য। সর্বশেষ ১৯ জানুয়ারি দুই গ্রুপের মধ্যে দুই দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে উপজেলা সদরে। উপজেলা বিএনপি ও পৌরসভা কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ৬ ডিসেম্বর বিজয় মেলাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের ১১ জন আহত হয়। এ ছাড়া জলিলনগর, নোয়াপাড়া, বেরুলিয়া, কদলপুর ফকিরহাট এলাকায় একাধিক ঘটনায় ৫০ থেকে ৬০ জন আহত হয়। গত সাড়ে পাঁচ মাসের সব ঘটনা আমলে আনলে আহতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে শতকের ঘর। গুরুতর আহত অনেকের হয়েছে অঙ্গহানি। কদলপুরের সংঘর্ষে মাথায় ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হন আনোয়ার হোসেন। নোয়াপাড়ায় দু’পক্ষের সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন মোহাম্মদ সুজন। এই ইউনিয়নের যুবদল নেতা ফরিদও হাতে গুলিবিদ্ধ হন।
বেড়ে গেছে অপহরণও: গত পাঁচ মাসে শুধু রাউজানেই বিএনপির দু’গ্রুপের মধ্যে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৯টি। দক্ষিণ রাউজানে ছয়টি ও উত্তরে দুটি অপহরণের ঘটনা ঘটে। গত ২৮ নভেম্বর নোয়াপাড়া থেকে গোলাম আকবর খন্দকার গ্রুপের তিনজনকে অপহরণ করে প্রতিপক্ষ। ২৩ ডিসেম্বর পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের বড় ঠাকুরপাড়া থেকে অপহরণ করে গিয়াস উদ্দিন কাদের অনুসারীকে। এ ছাড়া গত ২৮ ডিসেম্বর পৌর যুবলীগের সহসভাপতি আরিফুল হক চৌধুরীকে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবিতে অপহরণ করা হয়। ১৮ জানুয়ারি রাউজান কুণ্ডেশ্বরী এলাকা থেকে অপহরণ করা হয় লক্ষ্মীকান্ত নামে এক যুবলীগ নেতাকে। ২৯ ডিসেম্বর নুরুল ইসলাম নামে একজনকে অপহরণ করা হয় আঁধারমানিক এলাকা থেকে। বিএনপির এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে মনে করে স্থানীয়রা।
সাতকানিয়ায় ডাবল মার্ডার: মসজিদের মাইকে ডাকাত ঘোষণা দিয়ে সাতকানিয়ায় পিটিয়ে হত্যা করা দু’জন হলেন– কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্য কাঞ্চনা গ্রামের লতাপীর বাজার এলাকার মাহমুদুল হকের ছেলে নেজাম উদ্দিন (৪৪) ও ফুলতলা কাজীর জামে মসজিদ এলাকার আব্দুর রহমানের ছেলে আবু সালেক (৩৫)। দু’জনই জামায়াতে ইসলামীর ‘ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এলাকায়। তাদের বিরুদ্ধে ছিল চাঁদাবাজির অভিযোগও। কিন্তু নিহত হওয়ার আগে এসব অভিযোগে তাদের কখনও গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগর আমির ও সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর অনুসারী হওয়ায় এলাকায় প্রভাব খাটিয়েছে তারা বিনা বাধায়।
এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের স্ত্রী রুনা আকতার জেলা প্রশাসনের কাছে দেওয়া এক আবেদনে অভিযোগ করেন, নেজাম ও তার সহযোগী ইকবাল ও ফারুকের নেতৃত্বে জামায়াত ক্যাডার হিসেবে পরিচিত অন্তত ৫০ জন সন্ত্রাসী গত বছরের ডিসেম্বরের শুরু থেকে টানা ১৫ দিন ধরে নজরুল ইসলাম মানিকের মাছের খামার থেকে ৫০ থেকে ৬০ ট্রাক ভর্তি করে মাছ তুলে নিয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রাক নিয়ে এসে মানিকের মালিকানাধীন কেবিএম ব্রিকফিল্ড থেকেও ২ কোটি টাকার ইট নিয়ে যায়। সর্বশেষ মানিক চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীদের খোঁজে নেজাম উদ্দিন কাঞ্চনা ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। শুধু মানিক নয়, এলাকার প্রবাসী, ইটভাটার মালিক ও ধনাঢ্য লোকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির কারণে এলাকার লোকজনও ক্ষুব্ধ ছিলেন নেজামের ওপর। নেজাম ও তার সহযোগী আবু সালেক স্থানীয়দের ক্ষোভের বলি হয়েছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তারা আরও জানান, প্রতিশোধ নিতেই সেদিন এওচিয়া ইউনিয়নে আসে নেজাম ও তার বাহিনী। কারণ ২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী আবুল বশর ওরফে বদাইয়া নিহত হয়। বশরও জামায়াতের ক্যাডার হিসেবে পরিচিত। বশরের সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিল নিহত নেজাম উদ্দিন। বশরের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিকের হাত রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে এওচিয়া এলাকায় সাম্রাজ্য গড়ে তোলে মানিক।
তারও বাহিনী ছিল এলাকাতে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অপহরণ র ঘটন র ল ইসল ম ও অপহরণ ড স ম বর ব এনপ র ৫ আগস ট এল ক র স ঘর ষ এল ক য় ঘটন য় উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
টেকনাফে পাহাড়ি এলাকায় দিনমজুর অপহৃত
কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড়ি এলাকায় লাকড়ি সংগ্রহ করতে গিয়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন এক দিনমজুর।
সোমবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৮টার দিকে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবনিয়া এলাকায় তাকে অপহরণ করা হয়। এ সময় দুজন দিনমজুর অপহরণকারীদের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। অপহৃত দেলোয়ার হোসেন (২৫) মারিশবনিয়া মৃত আব্দুল মালেক মিস্ত্রির ছেলে।
বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ ফরিদ উল্লাহ জানিয়েছেন, সকালে তিন জন দিনমজুর লাকড়ি আনতে পাহাড়ে গেলে একদল অপহরণকারী তাদের ধাওয়া দেয়। এ সময় এক জনকে অপহরণ করা হয় এবং বাকি দুই জন দৌড়ে পালিয়ে আসে।
তিনি বলেন, “এ ঘটনা এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ভুক্তভোগীর পরিবার প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অবগত করেছি।”
মোহাম্মদ ফরিদ উল্লাহ জানান, মারিশবনিয়া পাহাড়-সংলগ্ন এলাকা হওয়ায় এখানে প্রায়ই অপহরণ হয়। তাই, পাহাড়ি এলাকাগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বক্ষণিক টহল নিশ্চিত করা জরুরি।
ঢাকা/তারেকুর/রফিক