বাংলাদেশের হয়ে বড় টুর্নামেন্ট জিততে চান মিরাজ
Published: 15th, March 2025 GMT
বাংলাদেশের ক্রিকেট এখন নতুনদের হাতে। দিনকয়েকের ব্যবধানে মুশফিকুর রহিম ওয়ানডে ও মাহমুদউল্লাহ বিদায় বলেছেন সব সংস্করণের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকেই। দেশের ক্রিকেটের দায়িত্ব এখন নতুন একটা প্রজন্মের হাতে। তাঁরা কতটুকু এগিয়ে নিতে পারবেন, এটা নিয়ে অবশ্য সংশয়ও আছে বেশ।
কাল বিসিবি পরিচালক নাজমূল আবেদীন বলেছেন, ‘নতুনরাও যোগ্য’ এই বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে হবে। এ প্রজন্মের ক্রিকেটারদের নেতৃত্বে অন্যতম বড় নাম মেহেদী হাসান মিরাজ। প্রায় এক দশকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার তাঁর। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে মিরাজের ভাবনা কী?
দুই-আড়াই বছর বাকি আছে বিশ্বকাপের, এখন থেকেই দলের একটা সেটআপ ঠিক করতে হবে। কারা খেলবে, কোন পজিশনে খেলবে, তা নিয়ে অনুশীলন করতে হবে। খেলোয়াড়দের সুযোগ দিতে হবে। সবাই সবাইকে ব্যাক করতে হবে।মেহেদী হাসান মিরাজ, বাংলাদেশমিরপুরে মোহামেডান-লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ ম্যাচের পর আজ সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘সবাইকে একটা সময় নিজের জায়গা থেকে সরে যেতে হয়। তাঁদের (আগের প্রজন্মের) যে ভূমিকা ছিল, তাঁরা বাংলাদেশকে একটা ধাপে নিয়ে এসেছেন। আমাদের কাজ থাকবে এখান থেকে আরেকটা ধাপে নিয়ে যাওয়া। আমরা এখনো একটাও ট্রফি জিততে পারিনি। আমাদের লক্ষ্য থাকবে যেকোনো বড় টুর্নামেন্টে যেন একটা ট্রফি জিততে পারি, তখন এটা আমাদের প্রজন্মের জন্য ভালো হবে।’
প্রিমিয়ার লিগে আজ ৪ উইকেট পেয়েছেন মিরাজ.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রজন ম র
এছাড়াও পড়ুন:
ক্ষমা কর ‘আছিয়া’
মাগুরার ধর্ষিত শিশুটির চলে যাওয়া আমাদের সমাজের ‘অধিকার সচেতন’ মানুষের জন্য তীব্র এক আঘাত যেন। একুশ শতকের সভ্য সমাজ নাকি প্রাগৈতিহাসিক যুগের শ্বাপদ পরিবেষ্টিত সমাজ, যেখানে আমাদের সন্তানরা বেড়ে উঠছে এক অজানা-অদেখা ভবিষ্যতের লক্ষ্যে। ‘আছিয়া’ তো একটি নামমাত্র, কিন্তু সে এ সমাজের বাস্তবতার অস্বস্তিকর একটা ছবি, যে সমাজে একটি শিশুও হয়ে ওঠে একটা ভোগ্যবস্তুমাত্র; যাকে যে কোনো বয়সী পুরুষ চাইলেই ধর্ষণ করতে পারে এবং ধর্ষণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে নারী নির্যাতনের যতো ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের এক ভয়াবহ চিত্র। পথেঘাটে নানা অজুহাতে নারীকে হেনস্তা করা, নারীর পোশাক নিয়ে কটূক্তি করা, শরীরে হাত দেওয়া, কোথাও কোথাও ম্যুরাল পুলিশিংয়ের নামে বেধড়ক মারধর করা– এসব যেন নিতান্তই মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী ধর্ষণ, দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ এবং ধর্ষণ শেষে হত্যার ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আজকাল পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের খবর; যা প্রজন্মের স্বাভাবিক মানস গঠনের জন্য বিরাট এক বাধা।
প্রতিবাদে নারীরাও নেমে এসেছেন রাজপথে, তীব্রভাবে জানান দিচ্ছেন যথেষ্ট হয়েছে। চুপ থাকা নয়, আর সহ্য করা হবে না। সব বয়সী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারীর স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হচ্ছে রাজপথ। এমনকি প্রতিবাদ করতে গিয়েও তারা হেনস্তার শিকার হয়েছেন। নানা শ্রেণি-পেশার নারীরা কেন আজ এমন প্রতিবাদী? তারা কি জুলাই আন্দোলনে ব্যাপকভাবে অংশ নেননি? তাদের অবদান ছাড়া এই আন্দোলন কি সফল হতো? কিন্তু আন্দোলনের পুরস্কার তারা কী পেল? রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তারা উপেক্ষিতপ্রায়। এমনকি পরিবর্তন আনার নামে নতুন যে দল গঠন করা হলো, তাতেও তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বরং টোকেনিজমের অংশ হিসেবে রাখা হয়েছে নারীকে; যা কিনা অপমানেরই নামান্তর। তাই বলা যায়, নারীর অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে; তাঁর মর্যাদার হানি করা হয়েছে। নারীর অসন্তোষ চাপা থাকেনি বরং নারীরা এর সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছেন। নারীকে ‘সাইডলাইন’-এ রাখার বিষয়টি উদ্বেগজনক। কারণ এর পেছনে রয়েছে সেই পুরোনো রাজনীতি, যে রাজনীতিতে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। রয়েছে সেই চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, যে মানসিকতায় নারী তো নারী, একটি তিন বছরের শিশুও ভোগের বস্তু হয়ে যায়; তার আবার অধিকার কী? সমানাধিকার তো অনেক দূরের ব্যাপার। সমাজের উঁচু-নিচু সব স্তরের মানুষই আছে, যারা এই মানসিকতা ধারণ করে। গত বছরই ফেব্রুয়ারিতে চা শ্রমিকের মেয়ে গৃহকর্মী প্রীতি ওরাং ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে মানুষ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল। ধর্ষক ছিল একটি ক্ষমতাধর পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক; যার বিরুদ্ধে আগেও শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ ছিল অথচ সে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। ভাবুন একবার, এই ধর্ষকের হাতেই কত কত নারী ও শিশু নির্যাতন এবং ধর্ষণের ভয়াবহ খবরগুলোর প্রকাশনার দায়িত্ব পড়েছিল। সত্যি ‘সেলুকাস’!
সম্প্রতি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, ফেব্রুয়ারি মাসেই ২৯১ নারী ও কন্যাশিশুর নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। কখনও দেখা গেছে, শিশুটির বয়স বড়জোর ৩ বা ৪ এবং ধর্ষকের বয়স ১৪। এ কেমনতরো বিকৃত অবক্ষয়! এমনকি ছেলেশিশু ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে চলেছে। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই দেশে ধর্ষণের মহোৎসব শুরু হয়ে গেছে যেন। প্রতি মাসে ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অথচ প্রশাসনের কোনো নড়ন-চড়ন নেই; তারা বলছে অবস্থা নাকি আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। হ্যাঁ, ভালো তো হয়েছেই বটে; ‘আছিয়া’ দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়ার লিড নিউজ হয়েছে, তাকে দেখতে উপদেষ্টারা গেছেন হাসপাতালে যখন সে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, আর কয়েকজন উপদেষ্টা হেলিকপ্টারে করে মাগুরা গেছেন তার জানাজায় অংশ নিতে। ভাবা যায়, কোথাকার কোন ‘অখ্যাত আছিয়া’ সারেদেশের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। এমন ঘটনা না ঘটলে কেউ কি কখনও আছিয়াকে চিনত? কে চিনত কুমিল্লার সেই হতভাগী তনুকে, যদি সেনানিবাসের মতো সুরক্ষিত এলাকায় সে ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার না হতো! হতভাগ্য মেয়েগুলো কেবল ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হয় আর পত্রপত্রিকা, ইলেকট্রনিক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ‘নিউজ’ হয়ে যায়। না জানি আরও কত তনু, প্রীতি ওরাং আর আছিয়া এই ‘নিউজ’ হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছে।
মাগুরার ‘আছিয়া’ সারাদেশের মানুষকে একটা তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভাসিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত চলেই গেল; তার জন্য শোক প্রকাশ করেই অনেকে ক্ষান্ত হয়নি। জানা গেছে, ধর্ষকের বাড়িঘর সব পুড়িয়ে দিয়েছে ‘সাধারণ ক্ষুব্ধ জনতা’। ক্ষোভের এই বহিঃপ্রকাশ একটা স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু সমাধান এভাবে আসে কি? ঠিক এই জায়গাটিতে আমাদের সবার একযোগে কাজ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কাজটি হলো, একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্যে কাজ করা।
এখানে একটু ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে, সামাজিক আদর্শ বা নিয়মের দোহাই দিয়ে নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন করা মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই নামান্তর। সাংস্কৃতিক বিপ্লব হবে সেই বিপ্লব, যা সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লিঙ্গ বৈচিত্র্যের মানুষের জন্য সমানাধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবে। যার যে ধর্ম পালন করার সে তা করবে, যে কোনো ধর্মই পালন করতে চাইবে না, সেই অধিকারও তার থাকবে। আমাদের মতো দেশে যেখানে ছয় বছরের শিশুকে বোরকা পরানো হয় পর্দা করানোর নামে, যে মেয়েটি হয়তো তার ধর্মান্ধ পিতামাতার ধর্মান্ধতার বলি হয়ে স্বাভাবিক আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠার সুযোগই পাবে না জীবনে, বরং হয়তো তার মা-বাবার মতোই অন্য কোনো ধর্মান্ধের নিপীড়নের শিকার হবে– সেই দেশে এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন হওয়াটা আরও বেশি দরকার। কারণ, উন্নত দেশগুলোয় নারীরা কী পোশাক পরল না পরল তাঁর দিকে মানুষ নজর দেয় না। তারা নারী-পুরুষ সমানে সমানে কাজ করে। কাজটাই মুখ্য, পোশাক নয়। কিছু ব্যতিক্রম নারী নির্যাতনের ঘটনা ছাড়া সেখানে নারীর অপদস্ত হওয়ার ঘটনা আমাদের মতো দেশের তুলনায় কম ঘটে। কারণ পোশাকই যদি নারীর মর্যাদার নিয়ামক হতো, তাহলে সেসব দেশের সি-বিচগুলোয় অবাধ ও নিয়মিত ধর্ষণ ঠেকানো যেত না, অথচ আমাদের দেশে মেয়েরা সি-বিচে সন্ধ্যায় কেন গেল, একা কেন গেল ইত্যকার নানা প্রশ্নে নারীকে অপদস্ত করা হয়। সঙ্গে জুটে যায় ধর্ষক মানসিকতার আরও অনেক পুরুষ। মনে রাখা দরকার, আজকের যে শিশুটি বস্তাবন্দি হয়ে জীবন কাটানোর চর্চার মধ্যে চলে গেল, একদিন সেও অন্য নারীকে বস্তাবন্দি অবস্থায়ই দেখতে চাইবে। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা এ বিষয়টিকে চিরস্থায়ী করতে চায় তার নিজের সুবিধার জন্য, নিজের আরাম-আয়েশ ও ভোগবিলাসের জন্য।
নারীকে তাঁর মর্যাদা রক্ষায় নিজেকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে, নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। শিক্ষা, বাসস্থান, চাকরি কিংবা ব্যবসা, চিকিৎসা, ভ্রমণ ইত্যাদিতে তাঁর নির্বিঘ্নে কাজ করে যাওয়া এবং চলাচলের পরিবেশ আদায় করে নিতে হবে।
আরেকটি অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে– আর তা হলো, শাহবাগ আন্দোলনে যুক্ত নারীদের গায়ে নাকি দুর্গন্ধ, তারা নাকি গোসল করে না। বিষয়টার উল্লেখ এ কারণেই করা, এটাও সেই হীনপুরুষতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষী রুচিহীনতা; যেখানে নারীকে হেয়প্রতিপন্ন করাতেই তাদের অগাধ সুখ। তারা ভুলে যায়, ঝাঁ-চকচকে পোশাকগুলো গায়ে দিয়ে তারা নারী-বিদ্বেষের বমি করে যাচ্ছে, সেই পোশাক প্রস্তুতের পেছনে আছে অজস্র নারী শ্রমিকের ঘাম। আজ পোশাকশিল্পের চরম দুর্গতির সময়ে যখন অনেক শিল্পকারখানা ধ্বংসের মুখে, লাখ লাখ নারী শ্রমিক বেকার, শ্রমের বিনিময়ে তাদের জীবন ধারণ করার স্বাভাবিক সময়টা অনুপস্থিত– সেই পোশাক শ্রমিকদের বেঁচে থাকার উপায় নিয়ে তাদের মুখে কোনো কথা নেই। তাহলে কীভাবে এসব নারী বেঁচে থাকবেন? তারা এটাও ভুলে যাচ্ছে, যে মা তার জন্য রান্না করতে, তার কাপড় ধুতে, সারাদিন সংসারের সবার চাহিদা মেটাতে গলদঘর্ম হচ্ছেন, সেই মায়ের শরীরেও ঘাম হয়। আমরা চাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা সবাই মানুষের মতো করে বেড়ে উঠুক, ধর্ষক হয়ে এবং ধর্ষকের সমর্থনকারী হয়ে বেড়ে না উঠুক।
একজন নারী যদি মনে করেন তিনি একা থাকবেন এবং তাতেই তিনি স্বচ্ছন্দ, তার এই একা থাকার অধিকারও নিশ্চিত করতে হবে। পুরুষের পোশাক নিয়ে সাধারণত নারীরা মন্তব্য করেন না, নারীর পোশাক নিয়েও মন্তব্য করা, তার ওপর হামলে পড়ার অধিকার কোনো পুরুষ বা কারোরই নেই। নারীর ওপর যে কোনো অজুহাতে যদি কেউ আক্রমণ করে, তবে তাকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এখন দেখার পালা, রাষ্ট্র আমাদের দেশটিকে আদৌ নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ করতে চায় কিনা।
সে ক্ষেত্রে এমন একটি স্লোগানই হয়তো বর্তমান সমাজের জন্য প্রযোজ্য– ‘যদি না থাকে নারীর সম্মান/জাতির তাতে ঘোর অপমান।’ v
লেখক: সমন্বয়ক, সাংগাত বাংলাদেশ