নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে পুরুষ হোক সহযোগী
Published: 15th, March 2025 GMT
অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশ এখন অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। নানাবিধ সংস্কার, নির্বাচন, দ্রব্যমূল্যের চড়া আঁচ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রসঙ্গের পাশাপাশি নারী অধিকারের বিষয়টিও নিয়ত মূলধারার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনায় আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্যি, নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের নানা রকম নজিরের জের ধরে হওয়া এসব আলোচনা জন্ম দিচ্ছে একরাশ আশঙ্কার। আশঙ্কাগুলো আরও প্রকট হয়ে ওঠে যখন সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার বেশ কিছু বছরের মধ্যে প্রথমবার হ্রাস পাওয়ার খবর চোখে পড়ে।
গত বেশ কিছু বছর বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৪০ শতাংশের আশপাশে ঘোরাঘুরি করেছে। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে এই হার ছিল ৪২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা এর পূর্ববর্তী জরিপ বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি ছিল। তবে গত দুই বছরের জরিপের তথ্য অনুযায়ী শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার কমছে, সর্বশেষ ২০২৪ সালে যা ৩৬ দশমিক ৬১ শতাংশে এসে ঠেকেছে। ফলে শ্রমবাজারে নারীদের সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে কার্যত ২০১৬ সালে আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই ফিরে গেছি। শহরের নারীদের বেলায় এ চিত্র আরও সঙিন যেখানে ২০১০ সাল থেকেই নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
নারীর সার্বিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন একটি অপরিহার্য বিষয়। নারী যখন জীবিকা অর্জন করার সুযোগ তৈরি করতে পারেন এবং উপার্জিত অর্থ নিজ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যয় করতে পারেন, তখন পরিবার ও সমাজে গুরুত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে নারী আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তাঁর সামনে নতুন নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত হয় এবং সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করা ও নানা অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে প্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন তিনি। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন শুধু তাঁর একারই নয়, বরং পুরুষ, পরিবার ও সমগ্র সমাজের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বাংলাদেশ বেশ খানিকটা এগোলেও আমরা যে এখনো পাস নম্বর থেকে অনেক দূরে, সে কথা অনস্বীকার্য। আমাদের দেশে শ্রমবাজারে নারীরা কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হন, সেগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে গৃহস্থালির কাজ, সন্তান জন্মদান, লালন-পালনসহ পুনরুৎপাদনশীল কাজের দায়িত্ব, গুটিকয়েক পেশার বাইরে বিকল্পের অভাব, দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতা, জনপরিসরে নারীর চলাচলের ওপর সামাজিক বিধিনিষেধ, হয়রানি ও নারী নির্যাতনের বিষয়গুলো অন্যতম।
এসব অন্তরায়ের সঙ্গে পুরুষতন্ত্র এবং সমাজে বিদ্যমান জেন্ডারসম্পর্কিত প্রথাগুলোর যে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে, তা খানিকটা মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। ক্ষমতা কাঠামোয় নারীর ওপর পুরুষের অবস্থানের কারণে জীবিকা অর্জন ও নিজের উপার্জনের ওপর নিয়ন্ত্রণের মতো মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে নারী বঞ্চিত হচ্ছেন যুগের পর যুগ, যা তাঁদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পুরুষতন্ত্রের অন্যায্য শর্তগুলো মেনে চলতে বাধ্য করায় ভূমিকা রাখছে। একই কারণে জীবিকার তাগিদে আন্দোলনরত নারীরা শুনছেন, ‘স্বামীর সংসার কর, এখানে আসছোস ক্যান?’
নারী অধিকারবিরোধী সর্বসাম্প্রতিক যেসব ঘটনা সামনে এসেছে, তার প্রতিটি পুরুষতন্ত্রের উগ্র চেহারার প্রতিচ্ছবি, যা নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক খাতে নারীর বিদ্যমান সংকুচিত পদচারণকে আরও খর্ব করার আশঙ্কা সৃষ্টি করবে। পুরুষতন্ত্রের এই বহিঃপ্রকাশ যে আগে ছিল না বা এগুলো যে একেবারেই নতুন, এমন কিন্তু নয়। কিন্তু অভ্যুত্থানকালীন নারীপুরুষ–নির্বিশেষের বৈষম্যহীন একটি দেশের প্রত্যাশার বিপরীতে নারী যখন এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হন, যেখানে তাঁদের অধিকারের লড়াইটা একটুও সহজ হয়নি, তখন দেশের তরুণ নাগরিক হিসেবে প্রচণ্ড হতাশা অনুভূত হয়।
এই হতাশা কাটিয়ে উঠতে এবং নারী-পুরুষের সম–অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ যা নারী-পুরুষের অসম সামাজিক সম্পর্কের অবসান ঘটাবে। আর সে উদ্দেশ্যেই অধিকার আদায়ের প্রতিবাদের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে এই অসম সম্পর্কের অন্যায্যতা ও ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার উন্নয়ন। যদিও এ ধরনের উন্নত বোঝাপড়া নারীর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম, এই লেখায় শুধু অর্থনৈতিক দিকটির ওপরই নজর দিচ্ছি।
আমাদের সমাজে নারী ও পুরুষ পরস্পরের জীবন সম্পর্কে খুব বেশি যে জানেন, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। বিশেষ করে কৈশোর ও যৌবনের প্রারম্ভে, যে সময় মানুষ পরিবার, সমাজ ও কর্মজীবনে তাঁর ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে সংবেদনশীল হওয়া শুরু করেন, সে সময় বিপরীত লিঙ্গের আকাঙ্ক্ষা, ভাবনা, সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি জানার সুযোগ থাকে খুবই কম। ফলে আমাদের সমাজব্যবস্থায় নারীর অপরিহার্য ভূমিকা ও তাঁর কাজের মূল্যায়ন সম্পর্কে পুরুষ যেমন একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠেন, তেমনি নারীও পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে গড়া কঠোর, আগ্রাসী, কর্তৃত্ববাদী পুরুষের ছবি নিয়েই বড় হন।
ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুষ ও নারী একে অপরের সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত না হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান। কৈশোর থেকেই পুরুষ সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোয় নিজের উঁচু অবস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়ার পাশাপাশি টের পেতে থাকেন রোজগার করার চাপ। অতিরিক্ত কাজের চাপের জন্য অনেক পুরুষ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো থেকে বঞ্চিত হন, অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়েন। আর নারী হয় উৎপাদনশীল কাজে পুরুষের কর্তৃত্ব স্বীকার করে সমাজ, এমনকি নিজের কাছেও মূল্যহীন, ধন্যবাদহীন গৃহস্থালি কাজে মনোযোগ দেন অথবা প্রতিপক্ষ পুরুষের সঙ্গে জীবিকা অর্জনের এক অসম লড়াইয়ে লিপ্ত হন। এভাবে পুরুষতন্ত্র নারী-পুরুষের মধ্যে তৈরি করে একটি অন্যায্য, দ্বান্দ্বিক ও অকল্যাণকর সম্পর্ক।
অথচ ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে পুরুষ যদি নারীর চোখে জীবন দেখার চেষ্টা করতে শেখেন, জীবিকা অর্জনে নারীদের সম্মুখীন হওয়া প্রতিবন্ধকতাগুলো সম্পর্কে অনুধাবন করতে শেখেন, তবে তার মা, বোন বা বন্ধুরা কোন পেশা বেছে নিতে চান, কোন কাজ করতে আগ্রহ বোধ করেন, সেগুলো জানার সুযোগ হয়তো তিনি পাবেন। নিজের জীবিকার স্বপ্নের সঙ্গে হয়তো তাদের স্বপ্নের মিল-অমিল খুঁজে নেবেন এবং অসম ব্যবস্থার যুক্তিহীনতা ধীরে ধীরে ধরতে পারবেন। নিজে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, কর্মক্ষেত্রকে হয়তো নারীবান্ধব করে তোলার চেষ্টা করবেন। হয়তো ঘরের কাজের মূল্যায়ন করতে শিখবেন এবং দায়িত্ব ভাগ করে নেবেন, সময় দিতে চেষ্টা করবেন পরিবারকে।
এ ক্ষেত্রে মীনা কার্টুনের একটি পর্বের কথা মনে পড়ে যেখানে এক দিনের জন্য নিজেদের কাজ অদলবদল করে মীনা ও রাজু উভয়েই পরস্পরের জীবন সম্পর্কে জানার সুযোগ পায় এবং আগের তুলনায় আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে পরিণত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মীনার পরিবার ও সামাজিক সংগঠনগুলো যেমন এগিয়ে এসেছে, তেমনি আমাদেরও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে হবে।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের নানাবিধ চাহিদা, জীবিকা অর্জনের বিষয়ে পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে আমাদের অকপট আলোচনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া উন্নয়নের পাশাপাশি দরকার ছেলে বা মেয়েসন্তানের আকাঙ্ক্ষা, আগ্রহ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানা এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণে সামাজিক বাধা-বিপত্তিগুলো উত্তরণে সাহায্য করা।
সামাজিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠন যেমন বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজনৈতিক দল, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদিতে নারী-পুরুষের অন্যায্য সম্পর্ক কেন নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তথা গোটা সমাজের জন্য অকল্যাণকর, সে বিষয়ে জনমত সৃষ্টি করা জরুরি। রোকেয়া সাখাওয়াতের কথা ধার করে বললে, সমাজের অর্ধাঙ্গের অগ্রগতি ছাড়া আমাদের অগ্রসর হওয়া যে অসম্ভব, সামাজিকভাবে সেই বোধ গড়ে তোলা ও সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজে বের করা আবশ্যক।
আর এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে, তার বিভিন্ন নীতিমালা ও চর্চার মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সহযোগী হওয়ার পথ সুগম করা। সে জন্য প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার বৈষম্যের বিষয়গুলো শুধু অন্তর্ভুক্ত না করে সেগুলোর পাঠদান নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের অঙ্গসংগঠনগুলোয় নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে এ–সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা, যেন রাষ্ট্রের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো নারীকে তাঁর জীবিকার লড়াইকে বাধা না দিতে পারে, হেয় না করতে পারে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে নারী-পুরুষ উভয়ের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সব সামাজিক সম্পর্কের মতোই নারী-পুরুষের বিদ্যমান অসম সম্পর্কের রাতারাতি পরিবর্তন ঘটবে না। তবে নতুন বাংলাদেশকে যদি সত্যিই একটি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের দেশ হিসেবে আমরা গড়ে তুলতে চাই, তাহলে অন্যান্য সম্পর্কের পাশাপাশি নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কেও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এই সম্পর্ককে গড়ে তুলতে প্রয়োজন শক্তিশালী, নিরলস সামাজিক আন্দোলন, যেখানে পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষে নারী-পুরুষ একে অপরের সহযোগী হবে, প্রতিপক্ষ নয়।
জাহিদ নূর
পিএইচডি গবেষক, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সহযোগী, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন য য য আম দ র র অন য র জন র র জ বন র জন য পর ব র সহয গ র ওপর গ রহণ
এছাড়াও পড়ুন:
নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে পুরুষ হোক সহযোগী
অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশ এখন অনেকগুলো প্রশ্ন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। নানাবিধ সংস্কার, নির্বাচন, দ্রব্যমূল্যের চড়া আঁচ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ইত্যাদি বিভিন্ন প্রসঙ্গের পাশাপাশি নারী অধিকারের বিষয়টিও নিয়ত মূলধারার ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনায় আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছে এবং দুঃখজনক হলেও সত্যি, নারীর স্বাধীনতা ও অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপের নানা রকম নজিরের জের ধরে হওয়া এসব আলোচনা জন্ম দিচ্ছে একরাশ আশঙ্কার। আশঙ্কাগুলো আরও প্রকট হয়ে ওঠে যখন সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার বেশ কিছু বছরের মধ্যে প্রথমবার হ্রাস পাওয়ার খবর চোখে পড়ে।
গত বেশ কিছু বছর বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার ৪০ শতাংশের আশপাশে ঘোরাঘুরি করেছে। ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে এই হার ছিল ৪২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, যা এর পূর্ববর্তী জরিপ বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি ছিল। তবে গত দুই বছরের জরিপের তথ্য অনুযায়ী শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণের হার কমছে, সর্বশেষ ২০২৪ সালে যা ৩৬ দশমিক ৬১ শতাংশে এসে ঠেকেছে। ফলে শ্রমবাজারে নারীদের সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে কার্যত ২০১৬ সালে আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই ফিরে গেছি। শহরের নারীদের বেলায় এ চিত্র আরও সঙিন যেখানে ২০১০ সাল থেকেই নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে।
নারীর সার্বিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাঁর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন একটি অপরিহার্য বিষয়। নারী যখন জীবিকা অর্জন করার সুযোগ তৈরি করতে পারেন এবং উপার্জিত অর্থ নিজ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যয় করতে পারেন, তখন পরিবার ও সমাজে গুরুত্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে নারী আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তাঁর সামনে নতুন নতুন সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত হয় এবং সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করা ও নানা অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে প্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন তিনি। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন শুধু তাঁর একারই নয়, বরং পুরুষ, পরিবার ও সমগ্র সমাজের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে।
স্বাধীনতার ৫৩ বছরে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রশ্নে বাংলাদেশ বেশ খানিকটা এগোলেও আমরা যে এখনো পাস নম্বর থেকে অনেক দূরে, সে কথা অনস্বীকার্য। আমাদের দেশে শ্রমবাজারে নারীরা কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হন, সেগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে গৃহস্থালির কাজ, সন্তান জন্মদান, লালন-পালনসহ পুনরুৎপাদনশীল কাজের দায়িত্ব, গুটিকয়েক পেশার বাইরে বিকল্পের অভাব, দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের অপ্রতুলতা, জনপরিসরে নারীর চলাচলের ওপর সামাজিক বিধিনিষেধ, হয়রানি ও নারী নির্যাতনের বিষয়গুলো অন্যতম।
এসব অন্তরায়ের সঙ্গে পুরুষতন্ত্র এবং সমাজে বিদ্যমান জেন্ডারসম্পর্কিত প্রথাগুলোর যে নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে, তা খানিকটা মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। ক্ষমতা কাঠামোয় নারীর ওপর পুরুষের অবস্থানের কারণে জীবিকা অর্জন ও নিজের উপার্জনের ওপর নিয়ন্ত্রণের মতো মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে নারী বঞ্চিত হচ্ছেন যুগের পর যুগ, যা তাঁদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও পুরুষতন্ত্রের অন্যায্য শর্তগুলো মেনে চলতে বাধ্য করায় ভূমিকা রাখছে। একই কারণে জীবিকার তাগিদে আন্দোলনরত নারীরা শুনছেন, ‘স্বামীর সংসার কর, এখানে আসছোস ক্যান?’
নারী অধিকারবিরোধী সর্বসাম্প্রতিক যেসব ঘটনা সামনে এসেছে, তার প্রতিটি পুরুষতন্ত্রের উগ্র চেহারার প্রতিচ্ছবি, যা নিঃসন্দেহে অর্থনৈতিক খাতে নারীর বিদ্যমান সংকুচিত পদচারণকে আরও খর্ব করার আশঙ্কা সৃষ্টি করবে। পুরুষতন্ত্রের এই বহিঃপ্রকাশ যে আগে ছিল না বা এগুলো যে একেবারেই নতুন, এমন কিন্তু নয়। কিন্তু অভ্যুত্থানকালীন নারীপুরুষ–নির্বিশেষের বৈষম্যহীন একটি দেশের প্রত্যাশার বিপরীতে নারী যখন এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হন, যেখানে তাঁদের অধিকারের লড়াইটা একটুও সহজ হয়নি, তখন দেশের তরুণ নাগরিক হিসেবে প্রচণ্ড হতাশা অনুভূত হয়।
এই হতাশা কাটিয়ে উঠতে এবং নারী-পুরুষের সম–অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ যা নারী-পুরুষের অসম সামাজিক সম্পর্কের অবসান ঘটাবে। আর সে উদ্দেশ্যেই অধিকার আদায়ের প্রতিবাদের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে এই অসম সম্পর্কের অন্যায্যতা ও ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার উন্নয়ন। যদিও এ ধরনের উন্নত বোঝাপড়া নারীর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম, এই লেখায় শুধু অর্থনৈতিক দিকটির ওপরই নজর দিচ্ছি।
আমাদের সমাজে নারী ও পুরুষ পরস্পরের জীবন সম্পর্কে খুব বেশি যে জানেন, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। বিশেষ করে কৈশোর ও যৌবনের প্রারম্ভে, যে সময় মানুষ পরিবার, সমাজ ও কর্মজীবনে তাঁর ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে সংবেদনশীল হওয়া শুরু করেন, সে সময় বিপরীত লিঙ্গের আকাঙ্ক্ষা, ভাবনা, সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদি জানার সুযোগ থাকে খুবই কম। ফলে আমাদের সমাজব্যবস্থায় নারীর অপরিহার্য ভূমিকা ও তাঁর কাজের মূল্যায়ন সম্পর্কে পুরুষ যেমন একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বেড়ে ওঠেন, তেমনি নারীও পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে গড়া কঠোর, আগ্রাসী, কর্তৃত্ববাদী পুরুষের ছবি নিয়েই বড় হন।
ফলে অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুষ ও নারী একে অপরের সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত না হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান। কৈশোর থেকেই পুরুষ সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোয় নিজের উঁচু অবস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়ার পাশাপাশি টের পেতে থাকেন রোজগার করার চাপ। অতিরিক্ত কাজের চাপের জন্য অনেক পুরুষ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো থেকে বঞ্চিত হন, অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নও হয়ে পড়েন। আর নারী হয় উৎপাদনশীল কাজে পুরুষের কর্তৃত্ব স্বীকার করে সমাজ, এমনকি নিজের কাছেও মূল্যহীন, ধন্যবাদহীন গৃহস্থালি কাজে মনোযোগ দেন অথবা প্রতিপক্ষ পুরুষের সঙ্গে জীবিকা অর্জনের এক অসম লড়াইয়ে লিপ্ত হন। এভাবে পুরুষতন্ত্র নারী-পুরুষের মধ্যে তৈরি করে একটি অন্যায্য, দ্বান্দ্বিক ও অকল্যাণকর সম্পর্ক।
অথচ ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে পুরুষ যদি নারীর চোখে জীবন দেখার চেষ্টা করতে শেখেন, জীবিকা অর্জনে নারীদের সম্মুখীন হওয়া প্রতিবন্ধকতাগুলো সম্পর্কে অনুধাবন করতে শেখেন, তবে তার মা, বোন বা বন্ধুরা কোন পেশা বেছে নিতে চান, কোন কাজ করতে আগ্রহ বোধ করেন, সেগুলো জানার সুযোগ হয়তো তিনি পাবেন। নিজের জীবিকার স্বপ্নের সঙ্গে হয়তো তাদের স্বপ্নের মিল-অমিল খুঁজে নেবেন এবং অসম ব্যবস্থার যুক্তিহীনতা ধীরে ধীরে ধরতে পারবেন। নিজে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করবেন, কর্মক্ষেত্রকে হয়তো নারীবান্ধব করে তোলার চেষ্টা করবেন। হয়তো ঘরের কাজের মূল্যায়ন করতে শিখবেন এবং দায়িত্ব ভাগ করে নেবেন, সময় দিতে চেষ্টা করবেন পরিবারকে।
এ ক্ষেত্রে মীনা কার্টুনের একটি পর্বের কথা মনে পড়ে যেখানে এক দিনের জন্য নিজেদের কাজ অদলবদল করে মীনা ও রাজু উভয়েই পরস্পরের জীবন সম্পর্কে জানার সুযোগ পায় এবং আগের তুলনায় আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে পরিণত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে মীনার পরিবার ও সামাজিক সংগঠনগুলো যেমন এগিয়ে এসেছে, তেমনি আমাদেরও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভূমিকা রাখতে হবে।
ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের নানাবিধ চাহিদা, জীবিকা অর্জনের বিষয়ে পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে আমাদের অকপট আলোচনা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া উন্নয়নের পাশাপাশি দরকার ছেলে বা মেয়েসন্তানের আকাঙ্ক্ষা, আগ্রহ ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানা এবং তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যপূরণে সামাজিক বাধা-বিপত্তিগুলো উত্তরণে সাহায্য করা।
সামাজিক পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠন যেমন বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাজনৈতিক দল, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদিতে নারী-পুরুষের অন্যায্য সম্পর্ক কেন নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন তথা গোটা সমাজের জন্য অকল্যাণকর, সে বিষয়ে জনমত সৃষ্টি করা জরুরি। রোকেয়া সাখাওয়াতের কথা ধার করে বললে, সমাজের অর্ধাঙ্গের অগ্রগতি ছাড়া আমাদের অগ্রসর হওয়া যে অসম্ভব, সামাজিকভাবে সেই বোধ গড়ে তোলা ও সম্ভাব্য সমাধানের পথ খুঁজে বের করা আবশ্যক।
আর এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে, তার বিভিন্ন নীতিমালা ও চর্চার মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সহযোগী হওয়ার পথ সুগম করা। সে জন্য প্রয়োজন পাঠ্যপুস্তকে জেন্ডার বৈষম্যের বিষয়গুলো শুধু অন্তর্ভুক্ত না করে সেগুলোর পাঠদান নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের অঙ্গসংগঠনগুলোয় নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে এ–সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা, যেন রাষ্ট্রের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী কোনো নারীকে তাঁর জীবিকার লড়াইকে বাধা না দিতে পারে, হেয় না করতে পারে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে নারী-পুরুষ উভয়ের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলন ঘটানোও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
সব সামাজিক সম্পর্কের মতোই নারী-পুরুষের বিদ্যমান অসম সম্পর্কের রাতারাতি পরিবর্তন ঘটবে না। তবে নতুন বাংলাদেশকে যদি সত্যিই একটি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের দেশ হিসেবে আমরা গড়ে তুলতে চাই, তাহলে অন্যান্য সম্পর্কের পাশাপাশি নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কেও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এই সম্পর্ককে গড়ে তুলতে প্রয়োজন শক্তিশালী, নিরলস সামাজিক আন্দোলন, যেখানে পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষে নারী-পুরুষ একে অপরের সহযোগী হবে, প্রতিপক্ষ নয়।
জাহিদ নূর
পিএইচডি গবেষক, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সহযোগী, বিআইজিডি, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]