মাগুরার ছোট্ট মেয়েটি বাংলাদেশের সন্তান হয়ে উঠেছিল। তার ওপর পাশবিক নির্যাতনের কাহিনি শুনে আমরা শিউরে উঠেছিলাম। ভেবেছিলাম, নির্যাতনের শিকার হলেও তাকে হয়তো বাঁচানো যাবে। 

মেয়েটিকে মাগুরা ও ফরিদপুর হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার সিএমএইচে। এসব হাসপাতালের চিকিৎসক, সেবিকা, কর্মী—সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মেয়েটিকে বাঁচিয়ে তুলতে। কিন্তু তাঁদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে মেয়েটি বৃহস্পতিবার বেলা একটায় মারা যায়।

মাগুরার এই মেয়ে হয়ে উঠেছিল সবার মেয়ে। তার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। মানবাধিকারকর্মীরা প্রতিবাদ করেছেন। নারী সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে। একটি আট বছরের শিশু বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে বোনের শ্বশুরের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হলো! ধর্ষক নিজের অপরাধ ঢাকতে তার বুকে ব্লেড দিয়ে কেটেছে। আমরা কোন সমাজে আছি? এই সমাজ-পরিবারে নীতিনৈতিকতা, মনুষ্যত্ববোধ বলে কিছু থাকবে না?

মাগুরার মেয়েটির নির্যাতনের বিরুদ্ধে গোটা দেশ জেগে উঠেছে। এটা হলো সমাজের এক দিক। অপর দিক হলো কোথাও কোথাও প্রতিবাদ করতে গিয়ে মানুষ বাধার মুখোমুখি হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ রকম একটি মানববন্ধন ভন্ডুল করে দিতে একটা পক্ষ মাঠে নেমেছে। তাদের উদ্দেশ্য কী? 

মাগুরার মেয়েটির মৃত্যু সর্বস্তরের মানুষকে মর্মাহত করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তার মৃত্যুতে শোক জানানোর পাশাপাশি আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার কথা বলেছেন। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে তাকে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কফিনের সঙ্গে ছিলেন একজন উপদেষ্টাসহ জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা দুজন নেতা এবং আরও অনেকে। 

বৃহস্পতিবার হাসপাতালে যাঁরা ছিলেন, মাগুরার মেয়েটির মায়ের কান্না তাঁদের স্পর্শ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘আমার মেয়েটা অসুস্থ হয়ে মরলে এত কষ্ট পাইতাম না। ওরে এত কষ্ট দিয়ে মারছে। বুকে ব্লেডের কাটার দাগ। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’ মা কেন, এই মৃত্যু কারও পক্ষে সহ্য করার কথা নয়। মায়ের স্বপ্ন ছিল মেয়েকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু তিনি সেই মেয়ের লাশ নিয়ে ফিরলেন নিজের বাড়িতে। এক পাষণ্ড পুরো পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। বাংলাদেশে ঘরে ঘরে এই পাষণ্ডদের হাতে নারী-শিশু ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হচ্ছে। 

এখানে দামিনীর স্থলে মাগুরার মেয়েটি এবং ভারতের স্থলে বাংলাদেশ বসালে পুরো চিত্রটি মিলে যাবে। দিল্লির নির্ভয়াকে বাঁচাতে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মাগুরার মেয়েটিকে বাঁচাতে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না। তারপরও বলব, মেয়েটি নিজের জীবন দিয়ে আমাদের চৈতন্যে মস্ত বড় নাড়া দিয়েছে। তার মৃত্যু আমাদের সবাইকে কাঁদিয়েছে।   

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে গতকাল ডেইলি স্টার এক প্রতিবেদনে জানায়, গত ১০ বছরে ৫ হাজার ৬০০–এর বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। 

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, এই আন্দোলন-প্রতিবাদের মধ্যেই তিন জেলায় পাঁচ শিশুকে ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সাভারে গত তিন দিনে তিনটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। পঞ্চগড়ে তিন বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে এক যুবককে আটক করে থানায় দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তিন বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এরপরও কি আমরা সভ্য সমাজের বাসিন্দা বলে দাবি করতে পারি? সাভারের ঘটনায় দেখা যায়, স্ত্রীর প্রথম ঘরের ১৪ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করেন স্বামী। প্রতিবেশীরা ধর্ষককে ধরে থানায় দিয়েছেন। আমরা তঁাদের ধন্যবাদ দিই। ধর্ষক-দুর্বৃত্তদের শায়েস্তা করতে এভাবে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

আবার ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে আইনের দুর্বলতাও আছে। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বিচার বিলম্বের কারণগুলো দূর করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। দিনাজপুরের ধর্ষণ মামলার এক আসামি গত ফেব্রুয়ারি মাসে জামিন পেয়ে যান। আইন ও বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। 

বৃহস্পতিবার মাগুরার মেয়েটির মৃত্যুর খবর পৌঁছানোর পরও দেশের অনেক জায়গায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গায়েবানা জানাজা পড়েছেন। তাঁরা মশালমিছিল করেছেন। ঢাকায় রাজু ভাস্কর্যের সামনে ছাত্র-জনতা এক মিনিট নীরবতা পালন করেছেন। কফিনমিছিল হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। শাহবাগ ছিল দীর্ঘদিনের মুক্তমঞ্চ। আওয়ামী লীগ আমলে মানুষ যখন প্রতিবাদ করার জন্য কোনো জায়গা পেতেন না, শাহবাগ মোড়ে জমায়েত হতেন। প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান নিতেন। এখনো নিচ্ছেন। সম্প্রতি সরকার শাহবাগ মোড়ে সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তাহলে কি মানুষ প্রতিবাদ করতে পারবে না?

সমাজের কোথাও মেয়েরা নিরাপদ নন। যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা লাগাতার প্রতিবাদ করছেন, সেই ক্যাম্পাসেও নয়। কয়েক দিন আগে এক ছাত্রীর পোশাক নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ছাত্রীর পক্ষে না দাঁড়িয়ে একদল লোক অভিযুক্তকে ছাড়িয়ে নিতে থানা ঘেরাও করলেন। এর আগে লালমাটিয়ার ঘটনায় দুই তরুণী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন। সে সময়েও এলাকাবাসী এগিয়ে আসেননি। 

মাগুরার শিশুটির জানাজায় সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছেন। জানাজা শেষে বিক্ষুব্ধ মানুষ অভিযুক্ত ব্যক্তির বাড়িতে আগুন দিয়েছেন। আমরা কোনো অবস্থায় আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার বিরোধী। বরং এলাকাবাসী বিচারপ্রার্থী মা ও বোনকে সহায়তা করলে পরিবারটি রক্ষা পাবে। মামলার কারণে মেয়েটির বড় বোন যাতে বিপদে না পড়েন, সেদিকে নজর দিতে হবে।

মাগুরার মেয়েটির ধর্ষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে যে গণপ্রতিবাদ উঠেছে, সেটা অবশ্যই ইতিবাচক। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন না। তাঁরা সব সময় ন্যায়ের পক্ষে থাকেন। 

সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা মাগুরার মেয়েটির ধর্ষণের বিচার দ্রুত করার কথা বলছেন। আইন উপদেষ্টা বিচারের সময়সীমা ১৮০ দিন থেকে ৯০ দিনে নিয়ে আসা হবে বলে জানিয়েছেন। আমাদের কথা হলো, বিচারের ক্ষেত্রে ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ থাকতে পারে না। আওয়ামী লীগ আমলে ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতের হত্যার বিচার হয়েছে দ্রততম সময়ে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে ত্বকী, চট্টগ্রামের মিতু, কুমিল্লার তনু হত্যা কিংবা সাংবাদিক সাগর–রুনি হত্যার বিচার থেমে গেছে অজ্ঞাত কারণে।  

মাগুরার মেয়েটির ঘটনা আমাদের দিল্লির নির্ভয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লিতে চলন্ত বাসে ২৩ বছরের তরুণী নির্ভয়াকে ধর্ষণ করে চার দুর্বৃত্ত। এরপর তারা চলন্ত বাস থেকে ছুড়ে ফেলে দেয় তরুণীকে। সেই নির্ভয়াকে বাঁচানোর জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফিরে এসেছিলেন লাশ হয়ে। এই ঘটনা পুরো ভারতে আলোড়ন তুলেছিল। 

সেই ঘটনা নিয়ে কবি সুবোধ সরকার লিখেছিলেন, ‘তোমাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি দামিনী/ সারা দেশজুড়ে আমরা কেঁদেছি, সারা দেশজুড়ে আমরা ফুঁসেছি/ ভারত রাষ্ট্র বাঁচাতে পারেনি তোমাকে/ ফেরত এসেছে রজনীগন্ধা কফিন, ফেরত এসেছে আমার ভারতকন্যা।’

এখানে দামিনীর স্থলে মাগুরার মেয়েটি এবং ভারতের স্থলে বাংলাদেশ বসালে পুরো চিত্রটি মিলে যাবে। দিল্লির নির্ভয়াকে বাঁচাতে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মাগুরার মেয়েটিকে বাঁচাতে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না। তারপরও বলব, মেয়েটি নিজের জীবন দিয়ে আমাদের চৈতন্যে মস্ত বড় নাড়া দিয়েছে। তার মৃত্যু আমাদের সবাইকে কাঁদিয়েছে।   

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন উপদ ষ ট কর ছ ন আম দ র হয় ছ ল ন র ভয় প রথম র ঘটন বছর র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

বকেয়া পরিশোধ করলেন সেই পুলিশ কর্মকর্তা

হঠাৎ প্রত্যাহার হওয়া নান্দাইল থানার ওসি ফরিদ আহমেদ অবশেষে কয়েকজন পাওনাদারের টাকা ফেরত দিয়েছেন এবং কয়েকজনকে দ্রুত দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। শুক্রবার বিষয়টি জানাজানি হলে রাতেই বেশ কয়েকজন পাওনাদারকে ডেকে নিয়ে টাকা পরিশোধ করেন।

গত ২৬ সেপ্টেম্বর নান্দাইল থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন ফরিদ আহমেদ। দায়িত্ব পালনকালে নান্দাইলে চুরি-ছিনতাইসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, নান্দাইলে কর্মরত অবস্থায় তিনি বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী কিনে টাকা পরিশোধ করেননি বলেও অভিযোগ ওঠে। এরপরও কয়েকবার জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি হিসেবে পুরস্কৃত হন।

বৃহস্পতিবার জেলা পুলিশ প্রশাসন ওসি ফরিদ আহমেদকে প্রত্যাহার করে ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করে একটি আদেশ জারি করে। পরদিন শুক্রবার ভোরেই তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগদানের উদ্দেশ্যে নান্দাইল ত্যাগ করেন। এ খবর পেয়ে শুক্রবার সকাল থেকে থানায় আসতে শুরু করেন পাওনাদাররা। তাঁকে না পেয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সবাই চলে যান। স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে চাপে পড়েন প্রত্যাহার হওয়া ওসি ফরিদ। 

এরপর শুক্রবার নান্দাইলে এসে বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পাওনাদারদের মোবাইল ফোনে ডেকে নিয়ে টাকা পরিশোধ করেন। কারও কারও কাছ থেকে টাকা পরিশোধের সময় চেয়ে নিয়েছেন বলেও জানা গেছে।

নান্দাইল পৌর বাজারের ইসহাক মার্কেটের পোশাক বিক্রেতা মোফাজ্জল হোসেন খান রেনু জানান, তিনি টাকা পেয়েছেন। শুক্রবার রাতে ওসি ফরিদ ফোন করে একটি জায়গায় ডেকে নিয়ে তাঁর পাওনা ১ লাখ ৪ হাজার ২৫০ টাকা পরিশোধ করেছেন।

সুবর্ণ ইলেক্ট্রনিকসের মালিক ফরহাদ জানান, তিনিও তাঁর বকেয়ার ১১ হাজার টাকা পেয়েছেন। এ ছাড়া অন্য কয়েকজন পাওনাদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে অচিরেই বকেয়া পরিশোধ করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।

শনিবার সন্ধ্যায় সাবেক ওসি ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘আমি নান্দাইল থেকে বদলি হয়েছি তা ঠিক, কিন্তু এখনও তো সেখানে আমার জিনিসপত্র রয়ে গেছে। তাই ভেবেছিলাম পরে এক সময় এসে পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করে যাব। কিন্তু এখন সবার দেনাই মিটিয়ে দিয়েছি।’

নান্দাইল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোজাহিদুল ইসলাম সমকালকে জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে অনেকের টাকা ইতোমধ্যেই পরিশোধ করছেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। বাকিদের টাকাও দ্রুতই পরিশোধ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ