বোমা মেরে গুলি করে সোনার দোকানে ডাকাতিতে ৮ চক্র
Published: 15th, March 2025 GMT
ঢাকা ও এর উপকণ্ঠে সোনার দোকানে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত আট চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বোমা মেরে, গুলি করে তাঁরা শুধু সোনার দোকানেই ডাকাতি করেন। রাজধানীর বনশ্রীতে বাসার সামনে থেকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার মামলা তদন্তে নেমে এসব চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে।
শুধু বনশ্রীর সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি করে ডাকাতি নয়, ৯ মার্চ সাভারের আশুলিয়ায় এবং গত বছরের জুলাই ও আগস্টে ঢাকার ডেমরা ও কেরানীগঞ্জে বোমা ও ককটেল ফাটিয়ে দুটি সোনার দোকানে ডাকাতির ঘটনায় এসব চক্রের সদস্যরা জড়িত বলে জানিয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
আরও পড়ুনবনশ্রীতে হামলা ও ধানমন্ডির ঘটনায় সরেজমিনে যা জানা গেল২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, প্রতিটি চক্রে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছেন। সোনার দোকানে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত এসব চক্রের সদস্যদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা থাকে। সোনার দোকানে ডাকাতি করতে গিয়ে কখনো তাঁরা দোকানের মালিক ও কর্মচারীকে গুলি করেন। আবার কখনো বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক তৈরি করে ডাকাতি করেন তাঁরা।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, সোনার দোকানে ডাকাতিতে জড়িত একাধিক চক্রকে শনাক্ত করা হয়েছে। বনশ্রীর ঘটনার পর এসব চক্রের সদস্যরা আরও একাধিক সোনার দোকানে ডাকাতির প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এসব চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র বলছে, বোমা মেরে সোনার দোকানে ডাকাতিতে সারা দেশে অর্ধশতাধিক চক্রের তিন শতাধিক সদস্য সক্রিয় রয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশের বাড়ি বরিশাল। এ ছাড়া এসব চক্রে কুমিল্লা, পাবনা, কুড়িগ্রাম ও মানিকগঞ্জের চরাঞ্চলের কিছু লোক রয়েছেন।
শুধু বনশ্রীর সোনার ব্যবসায়ীকে গুলি করে ডাকাতি নয়, ৯ মার্চ সাভারের আশুলিয়ায় এবং গত বছরের জুলাই ও আগস্টে ঢাকার ডেমরা ও কেরানীগঞ্জে বোমা ও ককটেল ফাটিয়ে দুটি সোনার দোকানে ডাকাতির ঘটনায় এসব চক্রের সদস্যরা জড়িত বলে জানিয়েছে তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।ঢাকায় সক্রিয় আট চক্রতদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঢাকা ও আশপাশের এলাকার সোনার দোকানে ডাকাতি করলেও তাঁদের অধিকাংশই থাকেন ঢাকার দয়াগঞ্জ, মীরহাজীরবাগ, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও আড়াইহাজার এলাকায়। প্রতিটি চক্রের কয়েকজন থাকেন, যাঁরা ঘুরে ঘুরে ‘টার্গেট’ ঠিক করেন। সেই দোকান রেকি করে আরেক দল। পরে মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ইমো অ্যাপ ব্যবহার করে ঢাকার বাইরে বসে পরিকল্পনা করেন। ডাকাতির দুই থেকে তিন দিন আগে অস্ত্র, বোমা নিয়ে ঢাকার একটি বাসায় ওঠেন। সেখান থেকে সোনার দোকানে ডাকাতি করেন তাঁরা। ডাকাতি শেষে সোনা ও নগদ টাকা ভাগাভাগি করে যাঁর যাঁর নিজ গ্রামে চলে যান। প্রতিটি ডাকাতির ঘটনার পর বাসা পরিবর্তন করেন চক্রের সদস্যরা। পরিকল্পনা থেকে ডাকাতি করা পর্যন্ত মুঠোফোনে যোগাযোগ করেন না তাঁরা।
ঢাকা ও এর উপকণ্ঠে ডাকাতি করে অন্তত আটটি চক্র। চক্রগুলো হলো লেংড়া হাসান, দেলোয়ার ওরফে কাইল্যা দেলোয়ার, ইয়াসিন মাল, গোড়া মনির, ছগির, বড় ছগির, আল-আমিন ও কাউসার। প্রতিটি চক্রে ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য কাজ করেন। দলের প্রধানদের নামে এসব চক্রের নামকরণ করা হয়েছে। তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় একাধিক মামলা রয়েছে। ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে একাধিকবার কারাগারে গেছেন। জামিনে বেরিয়ে আবারও ডাকাতি করেন চক্রের সদস্যরা।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ঢাকা ও আশপাশের এলাকার সোনার দোকানে ডাকাতি করলেও তাঁদের অধিকাংশই থাকেন ঢাকার দয়াগঞ্জ, মীরহাজীরবাগ, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও আড়াইহাজার এলাকায়। প্রতিটি চক্রের কয়েকজন থাকেন, যাঁরা ঘুরে ঘুরে ‘টার্গেট’ ঠিক করেন। সেই দোকান রেকি করে আরেক দল। পরে মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম ইমো অ্যাপ ব্যবহার করে ঢাকার বাইরে বসে পরিকল্পনা করেন।ডাকাতির সোনা কেনেন দুলালতদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বনশ্রীতে ব্যবসায়ীকে গুলি করে সোনা ডাকাতির ঘটনা তদন্তে নেমে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে একটি ডাকাত দলের প্রধান ইয়াসিন মালকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তবে জিজ্ঞাসাবাদে বনশ্রীর ঘটনায় তিনি জড়িত নন বলে দাবি করেন। তবে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে দুলাল চৌধুরী নামের এক ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়। এই দুলাল সোনার দোকানে ডাকাতিতে জড়িত চক্রগুলোর কাছ থেকে সোনা কিনে বিক্রি করেন। তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দুলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুলালকে জিজ্ঞাসাবাদে বনশ্রীতে ডাকাতিতে জড়িত সাতজনের তথ্য পাওয়া যায়। পরে ঢাকা ও বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চক্রের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মো.
দুলাল সম্পর্কে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, দুলাল চৌধুরীর একসময় ঢাকার তাঁতীবাজার এলাকায় সোনার দোকান ছিল। পরে ডাকাত চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকায় যতগুলো চক্র ডাকাতি করে, তাদের থেকে সোনা কিনে নেন দুলাল চৌধুরী। বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে ডাকাতির সোনা কিনে বিক্রি করেন তিনি। পাশাপাশি সম্প্রতি তিনি ডাকাত দলের সঙ্গে ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।
বংশপরম্পরায় ডাকাত তাঁরাঢাকায় সোনার দোকান ডাকাতি করে যে আটটি চক্র তাদের একটির প্রধান ইয়াসিন মাল। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বরিশালের ইয়াসিন মালের বড় ভাই ইয়াকুব মাল ছিলেন দুর্ধর্ষ ডাকাত সরদার। কয়েক বছর আগে বন্ধুকযুদ্ধে মারা যান ইয়াকুব। পরে ইয়াসিন মাল এই চক্রের প্রধান হয়ে যান।
ইয়াসিন মালের সঙ্গে ডাকাতি করেন তাঁর ভাতিজা রাকিব মাল। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, তাঁরা বংশপরম্পরায় সোনার দোকানে ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। ইয়াসিন মালের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ১৫টির মতো মামলা রয়েছে। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গেছেন। জামিনে বেরিয়ে আবার জড়িয়ে পড়েছেন ডাকাতিতে।
ঢাকায় যতগুলো চক্র ডাকাতি করে, তাদের থেকে সোনা কিনে নেন দুলাল চৌধুরী। বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে ডাকাতির সোনা কিনে বিক্রি করেন তিনি। পাশাপাশি সম্প্রতি তিনি ডাকাত দলের সঙ্গে ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ র প ত র কর ড ক ত র ঘটন ব যবস য় ক স ত র বলছ র এল ক য় র ঘটন য় র ঘটন র বনশ র র বনশ র ত এক ধ ক কর ন ত তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
নসরুল হামিদের সুপারিশে কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ, পরে জানা গেল স্কুলের অস্তিত্ব নেই
ঢাকা জেলা পরিষদের উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় কেরানীগঞ্জ উপজেলার শুভাঢ্যা ইউনিয়নে স্কুল নির্মাণের একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয় ২০২২ সালের ২২ জুন। প্রকল্পের সব ধাপের কাজ শেষ করে ঠিকাদার অর্থছাড়ের চেক নিতে গেলে সন্দেহ হয় একজন কর্মকর্তার। পরে তদন্তে উঠে আসে এ স্কুলের কোনো অস্তিত্ব নেই।
অভিনব এ ঘটনা ঘটেছে শুভাঢ্যা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কৈবর্তপাড়া এলাকায়। ছাত্র–জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সুপারিশে ‘কৈবর্তপাড়া স্কুল’ নামের ওই বিদ্যালয় নির্মাণে অর্থ বরাদ্দ করেছিল ঢাকা জেলা পরিষদ। নসরুল কেরানীগঞ্জ থেকে দলটির সংসদ সদস্য ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চলতি মার্চে কয়েকবার নসরুল হামিদের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে কৈবর্তপাড়ায় গিয়ে মার্চের ২ তারিখে এ প্রতিবেদক এলাকাবাসীর কাছে তাঁর অবস্থান সম্পর্ক জানতে চান। তাঁরা কেউ সেটি জানাতে পারেননি। গত ৫ আগস্টের পর নসরুলকে এলাকায় দেখা যায়নি বলে জানান তাঁরা।
সরেজমিনে কৈবর্তপাড়ারাজধানীর সদরঘাট হয়ে বুড়িগঙ্গা পার হলেই শুভাঢ্যা ইউনিয়ন। এরপর রিকশা নিয়ে পূর্ব দিকে এগোলে কালিগঞ্জ বাজার। এটির ডান পাশে একটা গলির মুখ থেকেই শুরু কৈবর্তপাড়া। সংকীর্ণ গলি ধরে কিছুদূর গেলে রাস্তার বাঁ পাশে একটা মাঠ। এর দক্ষিণে এক ইটের একটি দেয়াল আর পূর্বে একটি টিনশেড ঘর। মাঠটি এলাকাবাসীর কাছে স্কুলমাঠ নামে পরিচিত।
মাঠের পাশে আবদুর রউফ নামে স্থানীয় এক বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। প্রায় ২৫ বছর এ এলাকায় আছেন তিনি। মাঠের পাশে তাঁর একটি ওষুধের দোকান।
আবদুর রউফ বলেন, এলাকার সবাই জানে এখানে একটি স্কুল হওয়ার কথা ছিল কয়েক বছর আগে। আওয়ামী লীগের আমলে ঘটা করে একদিন দেখা গেল, শুভাঢ্যার চেয়ারম্যান ইকবাল ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মিজান একটি দেয়াল নির্মাণের কাজ তদারক করছেন। ওইটুকু পর্যন্তই। এরপর আর কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
একই স্থানে বিএনপির আমলে একবার স্কুল করার চেষ্টা করা হয়েছিল বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
বছর কয়েক আগে আমরা মাঠে আওয়ামী লীগ নেতাদের আসা-যাওয়া দেখতাম। এলাকার লোকমুখে স্কুলের টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার কথা শুনেছি কয়েকবার। এসব নিয়ে তখন তো কথা বলা যেত না। —জামাল উদ্দিন, কৈবর্তপাড়ার বাসিন্দাএ প্রসঙ্গে আবদুর রউফ বলেন, এই জায়গায় ২০০২ সালে একটি কেজি স্কুল (কিন্ডারগার্টেন) করার জন্য একটা টিনশেড স্থাপনা করা হয়েছিল। কিছু ছাত্র-ছাত্রীও ভর্তি হয়েছিল। এরপর আর এগোয়নি উদ্যোগটা। আওয়ামী লীগ আমলে নতুন স্কুল করার নাম দিয়ে ওই স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়।
কৈবর্তপাড়ার আরেক বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বছর কয়েক আগে আমরা মাঠে আওয়ামী লীগ নেতাদের আসা–যাওয়া দেখতাম। এলাকার লোকমুখে স্কুলের টাকা ভাগ–বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার কথা শুনেছি কয়েকবার। এসব নিয়ে তখন তো কথা বলা যেত না।’
এই এলাকায় মোট চারটি মাদ্রাসা ও একটি বেসরকারি স্কুল দেখেছেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক।
দুই দফায় বরাদ্দ ১ কোটি ১০ লাখ টাকাঢাকা জেলা পরিষদ ২০২২–২৩ অর্থবছরে স্কুলটির জন্য বরাদ্দ দেয় ৭০ লাখ টাকা। পরের অর্থবছর অবশিষ্ট কাজ শেষ করতে আরও ৪০ লাখ মোট ১ কোটি ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়।
এ–সংক্রান্ত নথি অনুযায়ী, স্কুল নির্মাণের কাজ পেয়েছে মেসার্স আওয়াল ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ঢাকার ধামরাইয়ের বান্নাল এলাকার।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ আওয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছর আগে স্কুল নির্মাণের কার্যাদেশ পাই। পরে স্থানীয় একজন আমার লাইসেন্সের অধীনে নির্মাণের কাজটি নেয়। সেখানে একটা বাউন্ডারি, না কী একটা করেছে। আমি কোনো খবর নিইনি।’
চলতি মার্চে কয়েকবার নসরুল হামিদের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে কৈবর্তপাড়ায় গিয়ে মার্চের ২ তারিখে এ প্রতিবেদক এলাকাবাসীর কাছে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জানতে চান। তাঁরা কেউ সেটি জানাতে পারেননি। ৫ আগস্টের পর নসরুলকে এলাকায় দেখা যায়নি বলে জানান তাঁরা।কাজ না করলে বিল নিতে ঢাকা জেলা পরিষদে কেন গেছেন—জানতে চাইলে আওয়াল তা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি ঝামেলায় আছি। এক বছর ধরে এই এলাকায় যাই না। বিলও নিতে যাইনি।’
স্কুলটির বিষয়ে তদন্ত করেন কেরানীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিনাত ফৌজিয়া। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কৈবর্তপাড়ায় সরকারি কোনো বৈধ স্কুল নেই।
রিনাত ফৌজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছরের ২৯ জানুয়ারি আমি তদন্তে যাই। গিয়ে স্কুলের কোনো অস্তিত্ব পাইনি। কৈবর্তপাড়া স্কুল করার জন্য ঢাকা জেলা পরিষদ থেকে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। অর্থছাড়ের সময় সন্দেহ হলে জেলা পরিষদ থেকে আমাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মূলত সরকারি টাকা আত্মসাতের জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল।’
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এলএনজি ব্যবসায় চক্র, নেপথ্যে নসরুল হামিদ০৮ নভেম্বর ২০২৪প্রকল্প পরিদর্শন না করেই প্রাক্কলনের অভিযোগঢাকা জেলা পরিষদের কোনো প্রকল্প গ্রহণ করার আগে প্রকল্পের স্থান প্রকৌশলীদের পরিদর্শনের বিধান রয়েছে।
কিন্তু ওই প্রকল্পের স্থান পরিদর্শন না করে প্রকল্প প্রাক্কলন করায় গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলা পরিষদের সাবেক সহকারী প্রকৌশলী আবদুস ছামাদ পত্তনদার, সাবেক উপসহকারী প্রকৌশলী মো. খলিলুর রহমান ও ফজলুল হককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে পরিষদ।
প্রতারণা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনৈতিকতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে এটি একটি বহুমাত্রিক দুর্নীতির ঘটনা। যে কর্মকর্তা এ টাকা হস্তান্তর আটকে দিয়েছেন, তিনি সাধুবাদ পাওয়ার মতো কাজ করেছেন।—ইফতেখারুজ্জামান, টিআইবির নির্বাহী পরিচালকআবদুস ছামাদ এখন গাজীপুরের শ্রীপুরের উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকল্প পরিদর্শন করার দায়িত্ব ছিল উপসহকারী প্রকৌশলী খলিলুর রহমানের। এটা আমার দায়িত্ব ছিল না। আমি নোটিশের জবাব দেব।’
বর্তমানে ভোলার দৌলতখানে উপজেলা প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ডিও লেটারের ভিত্তিতে নেওয়া প্রকল্প। আমি যথাযথ নিয়ম মেনে প্রকল্পের সাইট পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দিয়েছি। আমি জানি না, কেন তারা আমাকে নোটিশ দিয়েছে।’
প্রকৌশলী খলিলুর রহমানের বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুনবনানীতে নসরুল হামিদের কার্যালয় ‘প্রিয়প্রাঙ্গণে’ অভিযান, এক কোটি টাকা জব্দ২১ আগস্ট ২০২৪ঢাকা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, কৈবর্তপাড়া স্কুল নির্মাণ প্রকল্পটি প্রশাসনিক অনুমোদন, ই-টেন্ডারে ঠিকাদার নির্বাচন, কার্যাদেশ প্রদান ও সর্বশেষ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর অর্থছাড়ের সময় বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ তৈরি হলে তদন্তের জন্য বলি। জানতে পারি, কৈবর্তপাড়া নামে কোনো স্কুলের অস্তিত্ব নেই। এ ঘটনায় দায়ী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
প্রসঙ্গত, ঢাকা জেলা পরিষদের ষষ্ঠ সভার কার্যবিবরণীতে ১৩টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর সবই নেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সুপারিশ এবং অভিপ্রায়ে। ১৩টির মধ্যে ৯টি নেওয়া হয়েছিল সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের অভিপ্রায়ে। এখানে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয় এমন প্রকল্পও আছে, যেমন ঢাকা-১৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কামাল মজুমদারের সুপারিশে হাজী আলী হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের ভবন সম্প্রসারণে নেওয়া প্রকল্পে ভবনটির নামকরণ হয়েছে তাঁর নিজের নামে।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতারণা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অনৈতিকতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে এটি একটি বহুমাত্রিক দুর্নীতির ঘটনা। যে কর্মকর্তা এ টাকা হস্তান্তর আটকে দিয়েছেন, তিনি সাধুবাদ পাওয়ার মতো কাজ করেছেন।’
কর্মকর্তা যে অর্থছাড় আটকে দিতে পেরেছেন, এটা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফল বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান।
মন্ত্রীর ওই ধরনের সুপারিশ করার এখতিয়ার নেই বলে জানান ইফতেখারুজ্জামান। বলেন, ‘মন্ত্রী বহুমাত্রিক দুর্নীতির যে সিন্ডিকেট, সেটিকে সহায়তা করেছেন। মূল দায়টা মন্ত্রীর। ডিও লেটার ইস্যু করে এ ধরনের দুর্নীতি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটাকে (এমন দুর্নীতিকে) মূলত স্বাভাবিক ঘটনায় রূপান্তর করা হয়েছিল। তারই প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত এটি।’
যাঁরা ওই ঘটনায় জড়িত, তাঁদের সবাইকে চিহ্নিত করে যথাযথ উপায়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।
আরও পড়ুনসাবেক ৪১ মন্ত্রী–এমপির বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক১৯ আগস্ট ২০২৪