ভাতা, পুনর্বাসন কার্যক্রম নিয়ে হতাশা
Published: 15th, March 2025 GMT
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আহতদের তালিকা চূড়ান্ত না হওয়ায় আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে গতি আসছে না। এদিকে আহতদের চিকিৎসা ও সহায়তার জন্য করা ক্যাটেগরি নিয়ে অসন্তুষ্ট অনেকেই। কারও কারও উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন হলেও অর্থ সংকটে বিদেশ পাঠাতে বিলম্ব হচ্ছে।
আহতের অধিকাংশই ছিলেন উপার্জনক্ষম। তাদের কারও কারও পরিবারের অবস্থা এখন শোচনীয়। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ও মাসিক ভাতার কার্যক্রম শুরু না হওয়ায় হতাশ তারা। বিভিন্ন হাসপাতালে এখনও চিকিৎসাধীন আড়াইশ আন্দোলনকারী। ছুটি দিলেও পুনর্বাসন তালিকা থেকে বাদ পড়ার শঙ্কায় হাসপাতাল ছেড়ে যাচ্ছেন না অনেকেই।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জনবলের স্বল্পতা ও তথ্য যাচাইয়ে বিলম্ব হওয়ার কারণে তালিকা প্রস্তুত ও পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করায় বেশি সময় লেগে যাচ্ছে। তবে হাসপাতালে আহতদের বিশেষ বিবেচনায় স্মার্ট জাতীয় পত্র দেওয়া হয়েছে। এ মাসেই মিলবে জুলাই যোদ্ধাদের মাসিক ভাতা। বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে হেলথ কার্ড। দ্রুত শুরু হবে পুনর্বাসন কার্যক্রম।
এমন পরিস্থিতিতে প্রতি বছরের মতো এবারও পালিত হচ্ছে বিশ্ব পঙ্গু দিবস। আজ শনিবার এই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ক্ষতি প্রতিরোধ ও রূপান্তরিত জীবন’। তবে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে দিবসটি খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয় না।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদের চূড়ান্ত তালিকা করতে গত নভেম্বরে সরকার ‘গণঅভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেল’ করে। গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে আন্দোলনে আহত, নিহত বা নিখোঁজ, বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু কিংবা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে কোনোভাবে মারা গেছেন– এমন ব্যক্তিদের নাম তালিকাভুক্ত করার কথা বিশেষ সেলের।
গত ২১ ডিসেম্বর এ সেল ৮৬২ শহীদ ও ১১ হাজার ৫৫১ আহতের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেছে। তাদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন গড়ে ওঠে। গত ৪ মার্চ গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের সহায়তায় মোট ৮৩ কোটি ৬৩ হাজার টাকা ৫ হাজার ৪২৯টি পরিবারের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা ৭০৫টি শহীদ পরিবারের মাঝে এবং ৪৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ৪ হাজার ৭২৪ আহত ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে। জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর মাহবুবুর রহমান (স্নিগ্ধ) গতকাল বলেন, ফাউন্ডেশনের জনবলের স্বল্পতা ও আবেদনকারী সবার তথ্য যাচাই করতে গিয়ে প্রকৃত ভুক্তভোগীদের সহায়তা দিতে বিলম্ব হচ্ছে।
এখনও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আড়াইশ
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে এখনও ২৫০ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে রয়েছেন আরও ৩০ জন। বিদেশ থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছেন আটজন। দেশে চিকিৎসাধীনদের সবচেয়ে বেশি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) আছেন ১০৬ জন এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১২০ জন চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ শতাংশের অবস্থা গুরুতর।
চিকিৎসাসেবায় শ্রেণিকরণে অসন্তুষ্ট
আহতদের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতে তিনটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে। গুরুতর আহতদের ‘এ’, মাঝারি আহতদের ‘বি’ ও কম ঝুঁকিপূর্ণদের ‘সি’ ভাগে ভাগ করে তাদের চিকিৎসা চলছে। এসব ক্যাটেগরি তৈরির প্রক্রিয়া ও সমতা নিয়ে অসন্তোষও রয়েছে আহতদের মধ্যে। আহতরা বলছেন, এই ক্যাটেগরি ত্রুটিপূর্ণ। গতকাল দুপুরে পঙ্গু হাসপাতালে কথা হয় মো.
চিকিৎসাধীন আতিক হাসান বলেন, ‘আমি আহত হয়েছিলাম মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বরে। ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হই এবং সেদিনই একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। প্রায় চার মাস ধরে পঙ্গু হাসপাতালে (নিটোর) অবস্থান করছি। এ পর্যন্ত কোনো তালিকায় আমার নাম আসেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘যাদের অবস্থা বেশি জটিল, তাদের বিদেশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। তারা প্রশাসনের অবহেলা দেখছেন। অনেক সময় ভালোভাবে ফিজিওথেরাপি করা হয় না, প্রয়োজনীয় সেবাও দেওয়া হয় না।’
হাসপাতালটিতে আন্দোলনে আহত ৮৮৮ জনকে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ৬৯৬ জন গুলিতে আহত। ২৯২ জন বিভিন্নভাবে আহত। ২২ জনের পা, কয়েকজনের হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। আটজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান বলেন, জুলাই আন্দোলনে আহত ১০৬ রোগী ভর্তি আছেন। জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে জুলাই আন্দোলনের আহতদের জন্য বিশেষ কক্ষ রয়েছে। আহতদের সর্বোত্তম চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আহত অনেকের অবস্থা গুরুতর, দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন।
ছুটি দিলেও হাসপাতাল ছাড়ছেন আহতরা
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১২০ জন চিকিৎসাধীন। হাসপাতালটিতে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩ জনের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ৫০৩ জনের চোখ নষ্ট হয়েছে। দুই চোখ নষ্ট হয়েছে ৪৫ জনের। আহতদের মধ্যে সুস্থ হওয়ায় গত মঙ্গলবার ৩২ জনকে ছুটি দেওয়া হয়েছে। তবে একজন ছাড়া কেউই হাসপাতাল ছেড়ে যাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক চিকিৎসক বলেন, আন্দোলনকারীদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হেলথ কার্ড প্রস্তুত হচ্ছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে এককালীন আর্থিক অনুদানের কথা রয়েছে। এই কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। আহতরা মনে করছেন, এখনই হাসপাতাল ছেড়ে গেলে এসব তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারেন।
সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য সচিব সাইদুর রহমান বলেন, আহতদের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ দিচ্ছে সরকার। অন্য কার্যক্রমও দ্রুত শুরু হবে। এ মাসের মধ্যে জুলাই যোদ্ধাদের মাসিক ভাতা চালু করা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র র র অবস থ আহতদ র আর থ ক র জন য সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আমার দেখা সাংগ্রাই
সাংগ্রাই আমার কাছে এক মজার ব্যাপার ছিল। এখনও তাই। এ মজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এখনও খুঁজে ফিরি। কিন্তু এখনও কোনো কূলকিনারা করতে পারিনি।
আমি যেখানে জন্মেছি ও বড় হয়েছি, সেই জনপদের নাম ডংনালা। সেটা আধুনিক নাম। পরিসংখ্যান অনুযায়ী তাকে একটা গ্রাম বলা যায়। সরকারি হিসাবে বর্তমানে গ্রামের যে তালিকা রয়েছে তার মধ্যে এটি অন্তর্ভুক্ত আছে কিনা জানা নেই। তবে এটি এক পুরাতন জনপদ। এটি রাঙামাটি জেলার কাপ্তাইয়ের রাইখালী মৌজার দক্ষিণ-পূর্ব মাথা থেকে একটি জলধারা উত্থিত হয়ে ওই গ্রামের মাঝ বরাবর প্রবাহিত, যা চট্টগ্রাম জেলার দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া হয়ে কর্ণফুলী নদীতে সংযুক্ত হয়েছে ডংখাল নাম নিয়ে। জনপদ ও সাংগ্রাইয়ের মধ্যে কী এক মাতাল সম্পর্ক আছে জানা নেই। বছরের এ সময়টাতেই শুধু কোকিল, বউ কথা কও নয়, দূরদূরান্তের বন-পাহাড় থেকে নানারকম ও রঙের পাখি নানা আওয়াজ নিয়ে গ্রামে চলে আসে। যেমন– ঘুঘু, ফিঙে, কাঠঠোকরা, বসন্ত বাউড়ি, পোখলং, পাতিকাক, প্যাঁচা, ডাহুকসহ নাম অজানা হলুদ ও ঘাস রঙের আরও কয়েক জাতের পাখি চলে আসে। সারাদিন কোলাহল করে। এমনকি সাংগ্রাই না যাওয়া পর্যন্ত ঘুরেফিরে থাকে। আমরা এত এত ঝানু পাখিশিকারি ছিলাম কিন্তু তখন একটা পাখিও শিকার করতাম না। যেহেতু এরা সাংগ্রাইয়ের অতিথি পাখি। আমাদের মনের মধ্যেও এক ধরনের চঞ্চলতা চলে আসত পাখিদের মতো। কার জন্য উন্মুখ হয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি যেন! আমাদের অনেক ধর্মীয় দিবস থাকলেও দুটো পূর্ণিমা, কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান ও সাংগ্রাইয়ে চারটি দিবসই প্রধান এবং আবশ্যিক। পূর্ণিমা দুটো হলো– আষাঢ়ী পূর্ণিমা ও আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা। সাংগ্রাই কখনও সামাজিক উৎসব ছিল না এবং গহিন এলাকায় এখনও নেই। সাংগ্রাই মূলত ধর্মীয় অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক। এখানে মিয়ানমারের ঘজা: মাং কর্তৃক প্রবর্তিত মান্দালয় থেকে ম্রাইমা সাক্র: নামে প্রকাশিত বর্ষপঞ্জিকা অনুসরণ করে অনুষ্ঠান পালন করা হয়।
বর্ষপঞ্জির পূর্বাভাস মতে একেক বছর একেকভাবে করা হয়। যেমন সাংগ্রাই জা: পূর্বাভাস মতে, যদি গণেশের পচাগলা রক্ত পানিতে ফেলে দেওয়া হয় তবে পানি দূষিত হবে। তাই ফুল তোলার পূর্বদিন বিকেলে পানীয় জল যথেষ্ট পরিমাণে ঘরে তুলে রাখা হয়। ফুল তোলার দিন আর পানীয় জল তোলা হয় না। এ রেওয়াজ মারমা সমাজে স্বীকৃত সংস্কার। অবশ্য মূল রেওয়াজের পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ মারমাদের সাংগ্রাই মূলত তিন দিন হতে দেখি। প্রথম দিন পাইংছোয়াই, দ্বিতীয় দিন মূল সাংগ্রাই ও তৃতীয় দিন অপ্যাইং।
আসলে প্রথম ও দ্বিতীয় দিনই গুরুত্বপূর্ণ। পাইংছোয়াই দিনে ভোরের আলো ফোটার আগেই সাংগ্রাই পাইং নামে সেই বনফুল সংগ্রহের জন্য দল বেঁধে বন-পাহাড়ে চলে যেতাম। মনের আনন্দে যে যার মতো ফুল সংগ্রহ করে ফিরতাম। ততক্ষণে গ্রামের অদূরে বিহার থেকে বড় ঘণ্টি বাজিয়ে সাংগ্রাইয়ের সূচনা পর্বের জানান দেওয়া হয়ে যায়। মা স্নান সেরে প্রতীক্ষায় থাকত। আমরা পৌঁছার সাথে সাথে কয়েকটা ফুল বেছে নিয়ে প্রথমে বুদ্ধের উদ্দেশে আসনে নিবেদন করে। এরপর তিনি কিছু ফুল নিয়ে ডংখালের ঘাটে চলে যেতেন। সেখানে খ্যংশ্যাংমার উদ্দেশে কলা পাতার ডালা সাজিয়ে সাথে চার-পাঁচটা মোমবাতি জ্বালিয়ে পূজা দিতেন। এরপর মূল পর্বের জন্য আয়োজনে লেগে যেতেন। আমরা উৎসাহ নিয়ে ঘরের গরু, ছাগল, কুকুরের গলায় ফুল ঝুলিয়ে দিতাম। আর ঘরের প্রধান দরজায় পরিপাটি করে সাজিয়ে দিতাম। এসব করার মানে প্রিয় জিনিসের সাথে আলিঙ্গন করা বুঝতাম। কিন্তু কেন গৃহপালিত প্রাণীদের গলায় ঝুলিয়ে দিতাম তার তাৎপর্য বুঝি না।
এর আগের দিন সমস্ত ঘরদোর ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতাম। ঘরের উঠোনসহ চলাচলের পথ দল বেঁধে পরিষ্কার করে দিতাম। এ ছাড়া প্রতিটি পাড়ার যুবক-যুবতীরা যৌথভাবে বিহার ও এর আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে প্রস্তুত রাখত। এটা সাংগ্রাইয়ের পবিত্রতার অংশ মনে করা হয়।
এদিকে বাবা অন্যদের মতো সেদিন সন্ধ্যার দিকে অষ্টশীল পালনের জন্য বিছানাপত্তরসহ বিহারে চলে যেতেন। সেদিন রাতযাপন করতেন।
যুবক-যুবতীরা পাড়ার মাঠে অনানুষ্ঠানিকভাবে একদল দহ্ আকাজা: (গিলা খেলা) শুরু করে দুপুরের দিকে। আরেক দল কাংছি: আকাজা: (দাঁড়িয়াবান্দার মারমা সংস্করণ), অপর একটি দল বিশেষত বয়স্ক মহিলারা মঞ্চের মতো একটা বানিয়ে কপ্যা, চাগায়াং উচ্চ লয়ে গাইতে শুরু করে। সেখানে তারা অতীতের সুখস্মৃতি স্মরণ করে নানাভাবে গাইতে থাকে। কেউ কেউ পাংখু থেকে অংশবিশেষ গেয়ে রোমন্থন করতে থাকে। প্রাচীনকালের হারিয়ে যাওয়া সুখ-দুঃখগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। কেউ কেউ বাঁশি বাজায়, কেউ কেউ খ্রেখ্রং বাজায়, কেউ কেউ পাতার বাঁশি বাজায়। কেউ কেউ অতীতের কাঁইসার পাড়ের গান গেয়ে দুঃখ ভুলতে চেষ্টা করে। সেখানে কোনো তর্কাতর্কি বা মারামারির কিছুই হতো না, শুধু আনন্দ ভাগাভাগির মতো হইহুল্লোড়ে সময় কাটত। সন্ধ্যার দিকে সেগুলো শেষ হয়ে যেত।
আরেক দল যাদের হাতে বেশ টাকা জমিয়েছে তারা বিকেলের দিকে পাহাড়তলী মহামুনির উদ্দেশে মৌজ করে রওনা দিত। তারা সেখানে ধর্ম কাজসহ কেনাকাটা, আমোদ-প্রমোদ যেমন– সার্কাস, নাগরদোলা ইত্যাদি উপভোগ করে নির্ঘুম রাত কাটায়। পরদিন সকালে জিলাপি, বাতাসা, রসগোল্লা ইত্যাদি হাঁড়িতে করে, টিনের বাক্স, হাতপাখা, বাঁশি ইত্যাদি কিনে ফিরত।
দ্বিতীয় দিন সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে যেতেন মা। স্নান সেরে আরুং রান্নাসহ ভান্তে ও বাবার জন্য এগুলো নিয়ে বিহারে চলে যেতেন। সেদিন মূল সাংগ্রাই। কোনো খেলাধুলা নেই। হইহুল্লোড় নেই। তবে অভ্যাগতদের জন্য পায়েসসহ নানা পদের পিঠা তৈরির আয়োজন চলে। হাংসরভং (পাঁচন) রান্নার প্রস্তুতিও সমানে চলত। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে তেমন আয়োজন চলত ধুমধামে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নতুন কাপড় পরে এ ঘর-ও ঘরে বেড়ানো ও আপ্যায়ন চলে সানন্দে। বেলা ২টার দিকে সবাই আনুষ্ঠানিকভাবে শীল (সিলা) গ্রহণের জন্য বিহারে সবাই চলে যেত। ঘরের রাখালরাও সেদিন ছুটি কাটাত। অন্য লোককে বেশি মজুরিতে গরু চরানোর দায়িত্ব দেওয়া হতো।
এ ছাড়া এদিন সকালে বয়স্কদের সাবান দিয়ে স্নান করিয়ে দেওয়া হতো। তাদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেওয়া হতো এবং দুপুরে বিভিন্ন ঘর থেকে নানা পদের খাবার দেওয়া হতো। বয়স্করা নানা যত্নে সম্মানিত হতো।
বিহারে একসাথে সব পাড়ার লোক জমায়েত হতো। বিহারাধ্যক্ষ অগ্রবংশ ভান্তে গ্রামের কার্বারিকে কিছু বলতে পরামর্শ দিলে তিনি শুভেচ্ছামূলক বক্তব্য রাখেন। অতঃপর সমবেতভাবে পঞ্চশীল গ্রহণ ও ধর্মদেশনা শ্রবণ করা হতো। এদিন দুপুরে বিহারের লোকজন দল বেঁধে মঙ, ক্রিনাং সাইংজিসহ নানা কাঁসার দ্রব্য বাজিয়ে খালে নিয়ে যায়। সেখানে ভালোমতো পরিষ্কার করে আবার বাজিয়ে বাজিয়ে বিহারে প্রত্যাবর্তন করে। এসব শব্দ শুনে সবাই ধর্মানুষ্ঠানের আগে আগে বিহারে গিয়ে সমবেত হয়। এদিকে একটা দল বিহার প্রাঙ্গণে উঁচু বেদির মতো ব্যবস্থা করে সেখানে কাঁসার, পিতলসহ বুদ্ধ মূর্তিগুলো সযত্নে মুছে ডাবের পানি ও চন্দন পানি দিয়ে ধুয়ে দেয়। এরপর যথাস্থানে স্থাপন করা হয়। বিহারের সামনে খাবারসহ নানা ধরনের বেচা-বিক্রির দোকানপাট বসে। সন্ধ্যা বেলায় আবার বাদ পড়া পড়শিরা মিলিতভাবে শীল গ্রহণ ও মোমবাতি প্রজ্বলন করে।
অন্যদিকে আবার ঘরে ফিরে বেড়ানে ও খাওয়াদাওয়া করা হয়। আমাদের এখানে পাঁচন পদের চেয়ে বিন্নিচালের নানা ধরনের পিঠা ও জুমের কাউনের পায়েস বেশি লোকপ্রিয়। তাই এখনও সেখানে পিঠা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের গ্রামে একটা বড়সড় সীং (ভিক্ষুসীমা বা ঘ্যাংঘর) আছে। সেখানে সন্ধ্যার দিকে বুদ্ধ বন্দনার পর চারপাশ প্রদক্ষিণ করা হয়। প্রধানত ধর্মীয় কাজের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় দিনের কর্মসূচি সমাপ্ত হয়। ফাল্গুনী পূর্ণিমায় ডংসীং নামে বিশাল বুদ্ধমেলা হতো। সেখানে পাঙখু ও যাত্রাপালার আয়োজন হতো সারম্ভরে। ওই সময় প্রচুর লোক সমাগম হতো। বিশেষত পাঙখু ও যাত্রাগান উপভোগ করতে আসত।
তৃতীয় দিনের নাম অপ্যাইং। সেদিন তেমন আনুষ্ঠানিকতা বলে কিছু নেই। তবে দূর এলাকার স্বজনদের কাছে যাওয়া হয়। খোঁজখবর নেওয়া হয়। অবশ্য কিছু কিছু ঘরে আবারও আপ্যায়ন করা হয়। সেদিন কোনো কাজকর্ম না থাকায় বড়রা খোশগল্প করে সময় অতিবাহিত করে। যুবারা নানা ধরনের গ্রামীণ খেলায় মত্ত থাকে।
সাংগ্রাইকে পবিত্র কাল ধরা হয় মারমা সমাজে। তাই ওই সময়ে কোনো প্রকার মদ্যপান ও নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। ধর্মের কারণে গ্রামে কোনো মারমা ঘরে মদ প্রস্তুত করা হয় না।
আমাদের আশপাশের বসতি যেমন– পূর্ব কোদলা পাড়া, তংবঘোনা, খণ্ডাকাটা, বড়খোলা, মতিপাড়া, কারিগরপাড়া, বাঙ্গালহালিয়া, নাইক্যক, উদালবনিয়া রাজভিলা, ধলিয়াপাড়ার মারমা সম্প্রদায় আমাদের অনুরূপ সাংগ্রাই প্রতিপালন করে আসছে।
তবে সময় অনেক বয়ে গেছে। মানুষ ও সমাজ এক জায়গায় স্থির থাকেনি। অনেক মানুষের স্থানান্তর ঘটেছে। পাহাড়ের বন ধ্বংস হয়ে গেছে। যাতায়াতের পথ পাকা হয়েছে যেন এক অজগর শুয়ে আছে পথে পথে। নতুন নতুন সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ফলে আগের সাংগ্রাইয়ের উপাদানে অনেক ব্যত্যয় ঘটেছে আমাদের গ্রামে। আমারও সাংগ্রাইয়ের প্রাক্কালে সেখানে আর যাওয়া হয় না বিধায় প্রকৃত কী কী পরিবর্তন ঘটেছে তা বলা যাচ্ছে না।
অংসুই মারমা: পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা