এক বছরে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ১৭ টাকা
Published: 15th, March 2025 GMT
গত বছর রমজানে কুষ্টিয়ার খাজানগর মোকামে সরু চালের কেজি ছিল ৬২ থেকে ৬৪ টাকা। সেই চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮১ টাকা। কেজিতে বেড়েছে অন্তত ১৭ টাকা। একইভাবে বেড়েছে মাঝারি ও মোটা চালের দাম।
এই রমজানেও দফায় দফায় চালের দাম বাড়ছে। ১০ দিনের ব্যবধানে কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। বোরো ধান বাজারে না আসা পর্যন্ত এটা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দামের লাগাম টানতে আমদানির পরামর্শ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। মিল মালিক, ব্যবসায়ী আর ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে দাম বাড়ার এ চিত্র পাওয়া গেছে।
মিল মালিকরা জানান, খাজানগর মোকামে অটো ও হাসকিং মিলে সাড়ে ৩ শতাধিক চালকল আছে। গত আমন মৌসুমে বাম্পার ফলন হলেও দামে প্রভাব পড়েনি। কারণ হিসেবে তারা বলেন, ধানের দাম দেশের বাজারে রেকর্ড ছুঁয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মোকামে সরু জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ১০০ টাকা মণ। আর সর্বনিম্ন মোটা জাতের ধান বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ। এর মাঝামাঝি নানা দামে মিলছে ধান।
খাজানগরের দাদা রাইস মিলের মালিক আরশাদ আলী জানান, দেশের বাজারে এখন রেকর্ড দামে সরু ধান বিক্রি হচ্ছে। উত্তরবঙ্গে এক মণ (৩৭ কেজি) সরু ধান বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১০০ টাকায়। তাও চাহিদা অনুযায়ী মিলছে না।
গত বছর এই সময়ে সরু ধান ১ হাজার ৬০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। তখন চালের কেজি ছিল ৬৪ থেকে ৬৬ টাকা। এবার ধান ও চাল দুটির দামই বেড়েছে।
আরশাদ আলী বলেন, ‘গত বছর আট জেলায় বন্যায় ক্ষতি হওয়ায় আমরা চাল আমদানি করতে বলেছিলাম। এলসির চাল ঠিকমতো দেশে এসেছে কিনা, নজরদারি করতে হবে। আর কৃষি বিভাগ ধান উৎপাদন নিয়ে যে পরিসংখ্যান দেয়, সেটা যাচাই করা দরকার। বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল থাকলে ধান ও চালের দাম এত হওয়ার কথা না।’
মিল মালিকরা অভিযোগ করেন, আমদানি করা চাল অনেক মিল মালিক বস্তা পরিবর্তন করে মিনিকেট বলে বেশি দামে বেচেন। এ কারণে বাজারে প্রভাব পড়ছে না।
বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, আমদানি করা সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭১ টাকা কেজিতে। মান খুব একটা ভালো নয়।
চৌড়হাসের খুচরা ও পাইকারি দোকান মিরাজ স্টোরের মালিক মিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘রমজানের আগের তুলনায় এখন প্রতি কেজিতে বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা। ২৫ কেজির এক বস্তা চালে আগের চেয়ে প্রায় ৬০ টাকা বেশি দিয়ে কিনছি। তাও অর্ডার দিয়ে চাল পাচ্ছি না। আগে কেনা চাল ৭৯ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। গত বছরের তুলনায় এই সময় সরু, মাঝারি ও মোটা চালের দাম অনেক বেড়েছে।’
মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৬২ থেকে ৬৬ টাকা কেজিতে। এর চেয়ে একটু মোটা চাল ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা। আর একেবারে মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকা।
খাজানগর মোকামে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধান সংকট ও দাম বেশি হওয়ায় ৬০ ভাগ মিলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বৈশাখ মাসের আগে আরও ১০ থেকে ১৫ ভাগ মিল সাময়িক বন্ধ হতে পারে। নতুন বোরো ধান বাজারে আসার পর আবার উৎপাদনে ফিরতে পারবে এসব মিল। এ কারণে মোকামে উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। এক মাসের বেশি ধান ও চাল মজুত রাখত যারা, এখন তা পারছে না। এ কারণে বাজারে সরবরাহ কমেছে চালের। ধানও কম আসছে বাইরের মোকাম থেকে।
দফায় দফায় চালের দাম বাড়ার বিষয়ে মিল মালিকরা বলছেন, আমন মৌসুম শেষের দিকে। বাজারে ধানের সংকট আছে। যে ধান পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে মিল চালানো কঠিন।
চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, ‘ধানের বাজারে মনিটরিং নেই। এখন তো কৃষকের ঘরে ধান নেই। অসাধু ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা ধান স্টক করে বেশি দামে বিক্রি করছে। দেশের বাজারে ধান বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ১০০ টাকায়। সেখানে চালের দাম কমার সম্ভাবনা নেই।’
তিনি জানান, চাল আমদানির ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি খোলাবাজারে কম দামে চাল বিক্রির পরিমাণ বাড়াতে হবে।
জেলা খাদ্য কর্মকর্তা আল ওয়াজিউর রহমান বলেন, ‘আমন মৌসুম শেষের দিক হওয়ায় ধানের সংকট আছে। আমরা প্রতিনিয়ত ধানের বাজার মনিটর করছি। কিছু জাতের ধান কম থাকায় দাম বাড়ছে। মিলগুলোতে নজরদারি আছে। ইচ্ছা করে দাম বাড়ানো ও মজুত করলে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: খ জ নগর গত বছর আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
নতুন চেতনায় বর্ষবরণের আয়োজন
‘তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥ ... এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।’ কালের গর্ভে হারাল পুরোনো বছরের সব পঙ্কিলতা, সব পাপ-তাপ ধুয়ে-মুছে নতুন দিনের উজ্জ্বল আভায় হাসবে স্বদেশভূমি, বর্ণিল সুখচ্ছটায় ভাসবে মানবজীবন– এই প্রত্যাশা নিয়েই শুরু বঙ্গাব্দ ১৪৩২। স্বাগত বাংলা নববর্ষ।
আজ পহেলা বৈশাখ। বাংলা সংস্কৃতির সবচেয়ে প্রাণবন্ত, হৃদয়ছোঁয়া ও সর্বজনীন উৎসব। বছরের প্রথম সূর্যের আলোয় বাঙালির হৃদয়ে জেগে ওঠে আশার গান। এই দিনে পুরোনো গ্লানি ঝেড়ে শুরু হয় নতুন পথচলা। বাংলা নববর্ষ শুধু একটি দিন নয়; এটি বাঙালির জীবনে ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ঐক্য ও প্রাণের মিলনমেলা।
এবারের পহেলা বৈশাখের আবহ অন্যবারের চেয়ে একটু আলাদা। গেল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পালাবদলের পর এটাই প্রথম বাংলা নববর্ষ উদযাপন। নতুন চেতনায় বর্ষবরণ আয়োজনের প্রচেষ্টা চলছে দেশজুড়ে। বাংলা বর্ষবরণের অন্যতম আয়োজন ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামটি বদলে নতুন নাম হয়েছে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। তিনি দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি দেশ ও বিশ্বের সব মানুষের উত্তরোত্তর সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। দেশবাসীকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
এদিকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম বদলের বিষয়টি নিয়ে এখনও বিভিন্ন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ইউনেস্কোর অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতির সনদে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা অন পহেলা বৈশাখ’ নামেই বাংলা বর্ষবরণের আয়োজনটিকে উল্লেখ করা হয়েছে। এখন নাম বদলের ফলে জাতিসংঘের সংস্থার স্বীকৃতিতে প্রভাব পড়বে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৬ সালে বাংলা বছরকে বরণ করে নেওয়ার এই উৎসবটি ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। এ ছাড়া আনন্দ শোভাযাত্রায় প্রদর্শনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নির্মীয়মাণ ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফ দুটি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায়ও বিতর্ক চলছে।
এমন আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্কের মধ্যেই গোটা জাতি আজ প্রাণের উচ্ছ্বাসে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে মাতবে। বর্ণিল আয়োজনে নতুন বছর উদযাপনের অনুষ্ঠানমালা থাকবে দেশজুড়ে। ঢাকায় ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ ছাড়াও সারাদেশে থাকবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন। গ্রাম-শহরে বৈশাখী মেলা, যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, নাগরদোলা ছাড়াও থাকবে ঐতিহ্যবাহী খাবার পান্তা-ইলিশ। সেই সঙ্গে থাকবে হালখাতার ঐতিহ্য। ব্যবসায়ীরা লাল খাতা ও নতুন ক্যালেন্ডার বিতরণ করবেন, সঙ্গে থাকবে মিষ্টান্ন বিতরণ।
মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে তাঁর শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে বাংলা সাল প্রবর্তন করেন। সেই সময় রাজস্ব আদায় হতো হিজরি চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী, যা ছিল পুরোপুরি চন্দ্রনির্ভর। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে এটি ছিল অনুপযোগী। কারণ, কৃষির মৌসুম অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ইত্যাদি কৃষি মৌসুম ও আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মিশ্র সৌর ও চন্দ্র পদ্ধতির ভিত্তিতে তৈরি হয় ‘তারিখ-ই-ইলাহি’, যা-ই পরে পরিচিতি পায় বাংলা সাল নামে। এই পঞ্জিকা প্রস্তুত করেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজী।
যদিও শুরুতে নববর্ষ ছিল প্রশাসনিক কর আদায়ের দিন, ধীরে ধীরে এটি রূপ নেয় একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে। গ্রামবাংলার মানুষ একে একত্রে পালন করতে শুরু করে। রাজস্ব পরিশোধের পর আয়োজিত হতো ‘হালখাতা’, যেখানে ব্যবসায়ীরা পুরোনো হিসাব শেষ করে মিষ্টিমুখ করতেন নতুন খাতা খুলে।
আদিবাসীরা নববর্ষ ঘিরে নিজেদের মতো করে স্বাজাত্যবোধ বজায় রেখে উৎসবের রং ছড়ান। পাবর্ত্য তিন জেলায় আদিবাসীরা উদযাপন করে ঐতিহ্যবাহী উৎসব বৈসাবি। এর নামকরণ হয়েছে বৈসুক, সাংগ্রাই ও বিজু এই শব্দগুলোর আদ্যক্ষর থেকে। এ উৎসবকে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক বলে অভিহিত করেন।
দিনভর নানা আয়োজন
উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। রাজধানীতে আজকের দিনের মূল আকর্ষণ থাকবে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ প্রতিপাদ্য নিয়ে এই শোভাযাত্রা আজ সোমবার সকাল ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে বের হবে। পরে এটি শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে ফের চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হবে।
রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনে সকাল সোয়া ৬টা থেকে সোয়া ৮টা পর্যন্ত থাকবে বর্ষবরণের বর্ণাঢ্য আয়োজন। সকাল থেকে ধানমন্ডি রবীন্দ্র সরোবরে থাকবে সুরের ধারার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানমালা। শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বিকেল ৩টায় কনসার্ট এবং সন্ধ্যা ৭টায় চীনা দূতাবাসের সহযোগিতায় ড্রোন শো অনুষ্ঠিত হবে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী রাজধানীর তোপখানা রোডের সত্যেন সেন চত্বরে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দিনভর লোকসংস্কৃতি উৎসব ও বৈশাখী আড্ডার আয়োজন করেছে। সেখানে থাকবে চারুকারুপণ্যসহ বৈশাখী মেলার আয়োজন। নবপ্রাণ আন্দোলনের আয়োজনে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী ‘বৈশাখী উদযাপন আয়োজন’ থাকবে।
মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাঙ্গনে আজ ও আগামীকাল দু’দিনের ধর্মীয় অনুষ্ঠান-পূজা-পার্বণ, মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রথম দিনে আজ সোমবার সকাল ৮টায় সংগীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
এ ছাড়া বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ (ডিআরইউ) বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন বর্ণিল আয়োজনে বাংলা নববর্ষকে বরণ করবে।