Samakal:
2025-04-14@10:05:46 GMT

ওয়াইচিংনু

Published: 14th, March 2025 GMT

ওয়াইচিংনু

ওয়াইচিংনু মারমা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। চারপাশে শুধু গাড়ির হর্ন, ধোঁয়া, ভিড়, কোলাহল। ঢাকার আকাশটাও যেন ধূসর। একটুও নীল নয়। সবকিছুই কেমন যেন বেমানান লাগছে তার কাছে।
বান্দরবানের পাহাড়ি বাতাসে মিশে থাকা বাঁশির সুর, ঝরনার শব্দ, পাখির ডাক, এসবের কিছুই এখানে নেই। ছোট্ট কাঠের ঘরের উঠোনের পাশে ছিল লাল-নীল ফুলের গাছ। আর ঢাকার এই বাসার বারান্দায় শুধু কয়েকটা শুকনো টব পড়ে আছে।
‘তোর চেহারাটা এমন গম্ভীর কেন?’ মা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।
ওয়াইচিংনু কোনো উত্তর দিল না। পাহাড়ের উঁচু ঢালে বসে বাবা-মায়ের সঙ্গে সূর্যাস্ত দেখা, ছড়ার পানিতে পা ভিজিয়ে বসে থাকা, এসব কথা মনে পড়ছে। বান্দরবানে সবাই তার নাম জানত। সবাই তাকে চিনত। কিন্তু এখানে?
কাল তার স্কুলে প্রথম দিন। মাও দুশ্চিন্তায় আছে, সে টের পাচ্ছে। কিন্তু মা কিছু বলছে না।
‘স্কুলটা ভালোই হবে, তাই না মা?’ ওয়াইচিংনু আস্তে করে বললো।
‘অবশ্যই হবে!’ মা হেসে বললেন। ‘নতুন জায়গা, নতুন বন্ধু। তোর সব ঠিক হয়ে যাবে।’
স্কুলের ক্লাসরুমটায় ঢুকতেই হালকা একটা গুঞ্জন উঠল। নতুন ছাত্র-ছাত্রী এলেই নাকি এমন হয়। সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কারো চোখে কৌতূহল, কারো চোখে নিছকই অবজ্ঞা। ওয়াইচিংনু ধীরে ধীরে পা বাড়ালো।
শিক্ষক বললেন, ‘নতুন বন্ধু এসেছে। সবাই ওকে স্বাগত জানাও।’
সবাই স্বাগত জানালো।
শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কী?’
ওয়াইচিংনু একটু ইতস্তত করলো।
‘ওয়াই.

..চিং...নু,’ সে আস্তে করে বললো।
ক্লাসে হাসির রোল উঠলো। কেউ বললো, ‘ওয়াই-চিনা?’ কেউ বললো, ‘ইচিনু?’ কেউ আবার বললো, ‘চিনু-মিনু?’
ওয়াইচিংনুর গলা শুকিয়ে গেলো। ক্লাসের সব মুখ যেন কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এতোদিন তার নাম শুনে কেউ হাসেনি। বান্দরবানে সবাই ঠিকঠাক বলতো, কেউ কখনো ভুল উচ্চারণ করতো না। আর এখানে? 
শিক্ষক সবাইকে ধমক দিয়ে থামালেন। ‘তোমার আর কোনও ডাক নাম আছে? থাকলে বলো।’ 
কথাটা শোনার পর ওয়াইচিংনুর মনে হলো, সে যেন কোথাও খুব নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। না তার ডাক নাম নেই। তার নিজের নাম তাহলে কঠিন? বাবা বলতেন, ‘তোর নামটা আমাদের গর্ব, ওয়াইচিংনু।’ ওয়াইচিংনু মাথা নেড়ে বললো, তার কোনও ডাক নেম নেই। সবাই আবার একটু হাসলো। স্যার আবার ধমক দিয়ে সবাইকে ওয়াইচিংনু নামে ডাকতে বললো।
বাসায় ফিরে সে আর কারো সঙ্গে কথা বললো না। বিছানায় চুপচাপ বসে থাকলো। মা এসে পাশে বসলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে সোনা?’
ওয়াইচিংনু কোনো উত্তর দিল না। শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। ঢাকার আকাশটা আজও ধূসর। একটুও নীল নয়।
বিকেলে দাদুর ফোন এলো।
‘ওয়াইচিংনু, কেমন আছিস?’
ওয়াইচিংনু চুপ।
দাদু আবার বললেন, ‘নতুন শহর, নতুন স্কুল, ভালো লাগছে তো?’
ওয়াইচিংনু এবারও চুপ।
দাদু হেসে বললেন, ‘আমি জানি, তুই মন খারাপ করে বসে আছিস। তোর নাম নিয়ে সবাই হয়তো হাসছে, তাই না?’
ওয়াইচিংনুর গলা কেঁপে উঠলো। কীভাবে দাদু জানলেন?
দাদু আবার বললেন, ‘শোন, তোর নাম বদলানোর দরকার নেই। তোর নাম কোনো সাধারণ নাম না। তোর নাম মানে জানিস? শুভ আলোর কন্যা। তুই তো আমাদের আলো! আলো কি অন্য নামে ডাকা যায়?’
ওয়াইচিংনুর চোখ ভিজে এলো।
দাদু গল্প শুরু করলেন।
‘যখন তুই জন্মালি, তখন আকাশে বিশাল চাঁদ ছিলো, পাহাড়ের ওপরে ছিলো নরম আলো। তোর বাবা-মা ভাবল, এই আলোই তো আশীর্বাদ! তোর নাম রাখলো ওয়াইচিংনু। তুই পাহাড়ের আলো।’
ওয়াইচিংনু চোখ বন্ধ করলো। পাহাড়ের সবুজ মাঠ, ঝর্ণার ঠান্ডা জল, বাঁশবনের নরম বাতাস–সব চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
ঢাকার ধুলোভরা রাস্তা, বাসের বিকট হর্ন, অপরিচিত মুখগুলো যেন কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরে গেলো।
দাদু বললেন, ‘শোন, নাম বদলানো মানে নিজের শিকড় ভুলে যাওয়া। পাহাড়ের মেয়ে কি নিজের পরিচয় হারাতে পারে?’
ওয়াইচিংনুর মন হঠাৎই শক্ত হয়ে গেলো।
সে কি সত্যিই নিজের পরিচয় হারাবে?
পরদিন সকালে সে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বললো, ‘আমার নাম ওয়াইচিংনু।’
নরম অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বর।
তার নাম বদলাবে না। কিছুতেই না।
স্কুলের করিডোরে ওয়াইচিংনু ধীরে ধীরে হাঁটছে। মনে হচ্ছে, আজ কিছু একটা বদলে গেছে। ক্লাসরুমে ঢুকতেই আবার গুঞ্জন। কেউ বললো, ‘ওই চিনু-টিনু আসছে!’ কেউ বললো, ‘ওয়াই-চিনা? আবার কোন দেশ থেকে এলো?’ ওয়াইচিংনু এবার থামলো। আজ আর চুপ করে থাকবে না। লম্বা একটা শ্বাস নিলো। তারপর স্পষ্ট করে বললো, ‘আমার নাম ওয়াইচিংনু। ওয়াই-চিং-নু। আমি আদিবাসী। তাই তোমাদের মতো আমার নাম না। আমাদের নিজস্ব ভাষায় আমার নাম। তোমরা চেষ্টা করলে ঠিক বলতে পারবে!’
ক্লাস হঠাৎ থমথমে। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আরিয়ান, যে সবচেয়ে বেশি তার নাম নিয়ে মজা করতো, এবার বিড়বিড় করে বললো, ‘ওয়াই... চিং... নু?’
ওয়াইচিংনু হাসলো। ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। এবার আর ভুল হবে না!’
শিক্ষক হঠাৎ ক্লাসে এসে শুনে খুশি হলেন। বললেন, ‘দেখলে? চেষ্টায় সব হয়।’
কিন্তু ওয়াইচিংনুর গল্প এখানেই শেষ নয়। সেই দুপুরে টিফিনের সময় তার পাশে এসে বসলো রেশমা। বললো, ‘তোমার নামের মানে কী?’ ওয়াইচিংনু একটু থামলো। তারপর বললো, ‘আমার নামের মানে শুভ আলোর কন্যা।’ রেশমার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেলো। ‘আরে, কী সুন্দর নাম! কে রেখেছে?’
ওয়াইচিংনু বললো, ‘আমার দাদু। আমি যখন জন্মেছিলাম, পাহাড়ের ওপরে তখন চাঁদের আলো ছড়াচ্ছিলো। সবাই বললো, আমি নাকি সেই আলো নিয়ে এসেছি। তাই আমার নাম রাখা হলো ওয়াইচিংনু।’
রেশমা মুগ্ধ হয়ে বললো, ‘তুমি তো দারুণ গল্প বলতে পারো!’ 
তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন বন্ধু এসে যোগ দিলো। তারা জানলো, বান্দরবানের পাহাড়ে কেমন জীবন। কীভাবে মানুষ নদী পেরিয়ে স্কুলে যায়। কীভাবে পাহাড়ি উৎসব হয়।
আরিয়ানও চুপচাপ এসে বসে রইলো। তারপর বললো, ‘ওয়াইচিংনু, তুমি আমাদের আরও গল্প বলবে?’
ওয়াইচিংনু এবার সত্যিই হাসলো। তাদের জন্য তার অনেক গল্প আছে। তার নাম নিয়ে কেউ আর হাসবে না। বরং সবাই জানবে, সে কে, কোথা থেকে এসেছে এবং কীভাবে পাহাড়ের আলো ঢাকা শহরের বুকে এসে জ্বলে উঠেছে! n

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব ন দরব ন আম র ন ম ক উ বলল আম দ র ত রপর বলল ন র বলল

এছাড়াও পড়ুন:

সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কড়া বার্তা দিলেন নোবিপ্রবি উপচার্য

সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিঘ্ন করার চেষ্টা করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) উপাচার্য (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রেজওয়ানুল হক।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। নোবিপ্রবিতেও সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই এবং এক্ষেত্রে আমরা জিরো টলারেন্স। এসব নিয়ে নোবিপ্রবির পরিবেশ বিঘ্ন করার চেষ্টা যারাই করবে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।”

সোমবার (১৪ এপ্রিল) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে নববর্ষের শোভাযাত্রা শেষে তিনি এসব কথা বলেন।

আরো পড়ুন:

নতুন চুক্তি করতে তুরস্ক সফরে নোবিপ্রবি উপাচার্য

গাজায় নির্যাতিতদের পক্ষে নোবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন

নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে উপাচার্য বলেন, “আশা করি এই নববর্ষ আমাদেরকে নতুন উদ্যোমে কাজ করার অনুপ্রেরণা দেবে।  বিশ্ববিদ্যালয়েকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করব। এক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যেক সদস্যের দায়িত্ব হচ্ছে আমরা দায়িত্বশীল আচরণ করব এবং  বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও নীতি বিরুদ্ধ কিছু করব না।”

এর আগে, বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় সেখানে এসে শেষ হয়।

এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হানিফ, রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ তামজীদ হোছাইন চৌধুরীসহ বিভিন্ন অনুষদের ডিন, ইনস্টিটিউটের পরিচালক, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, হল প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টর, বিভাগের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও দপ্তর সমূহের কর্মকর্তা, কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা/ফাহিম/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ