মাগুরায় বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ধর্ষণের শিকার শিশু আছিয়াকে বাঁচানো গেল না। আসলে ৮ বছরের এই বালিকার দেহে যে ধরনের পাশবিক নির্যাতন চলেছে, তাতে তাকে বাঁচানো কঠিন ছিল। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, তাকে তার বোনের শ্বশুর যৌন নির্যাতন করেছে। বোনের স্বামীও তার সঙ্গে একই আচরণ করেছে। মানসিক বিকৃতি কতটা চরম হলে বাবা-ছেলে একটা শিশুর সঙ্গে এ রকম আচরণ করতে পারে, তা কল্পনা করাও কঠিন। আছিয়ার সঙ্গে যা হয়েছে তা শুধু উদ্বেগে কিংবা শঙ্কা অথবা ক্ষুব্ধতার নয়। বিষয়টি আতঙ্কের। 

নারীকে আক্রমণ এবং তার বিরুদ্ধে সহিংসতা সমাজে বেড়েই চলেছে। সেই আক্রমণ বিভিন্ন বলয়ে বিভিন্নরূপে আত্মপ্রকাশ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা রূপ নিচ্ছে দেহজ এবং মানসিক নির্যাতনের; কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষণসহ নানান যৌন নিপীড়ন ও প্রত্যক্ষ আঘাতে। এ বছর জানুয়ারি মাসে ২০৫ জন নারী ও কিশোরী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা রয়েছে ৬৭টি। পরের মাস অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে সারাদেশে ১৮৯টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ৪৮টি। চলমান মার্চে শুধু গত এক সপ্তাহে ১০টি ধর্ষণের ঘটনা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এসেছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, বাস্তবে ঘটনার সংখ্যা প্রদত্ত উপাত্তের চেয়ে অনেক বেশি। অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারী ওড়না নিয়ে উত্ত্যক্ত এবং নিপীড়ন করেছে। মেট্রোরেলের মধ্যে যৌন নিপীড়নের সংবাদও এসেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে।

নারীর প্রতি পুরুষের ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ– বিষাক্ত পুরুষতন্ত্র, চরম শ্রেষ্ঠবাদিতা, উগ্র মৌলবাদের বিস্তার, নারীবিদ্বেষী চর্চার বিস্তৃতি ইত্যাদি। এ রকম বিদ্বেষের কারণেই পুরুষ নারীর স্বাধিকার কেড়ে নিতে চায়। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়; রোধ করতে চায় নারীকণ্ঠ; সীমিত করতে চায় তার সত্তা ও আত্মপরিচয়।
প্রথমত, বিষাক্ত পুরুষতন্ত্র আত্মপ্রকাশ করে ক্ষমতা প্রদর্শন, ক্রোধ ও যৌনতার মাধ্যমে। নারী যেখানে মনোবলে বলীয়ান, পুরুষ সেখানে বলীয়ান দেহবলে। দেহবলে বলীয়ান পুরুষ তার পেশিশক্তি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে। দেহবলই পুরুষকে উন্মত্ত  ও যুক্তি-বিবর্জিত করে; সংঘাতপ্রবণ করে তোলে। এই পুরো দ্বন্দ্বে পুরুষ নারীকে তার ইচ্ছা পূরণের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দেখে। অতএব এমন বাধাকে তো শৃঙ্খলিত করতেই হবে পুরুষকে। বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিকতা মানবকে দানবে পরিণত এবং পুরুষকে করে তোলে নারীবিদ্বেষী। 

দ্বিতীয়ত, নারী বিষয়ে পুরুষের এক চরম শ্রেষ্ঠবাদী ধারণা কাজ করে। পুরুষ মনে করে, সে সর্ববিষয়ে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এবং তার অসাধ্য কিছু নেই। অন্যদিকে নারী জানে, কোথায় তার শক্তি, কোথায় তার দুর্বলতা। নারীর দুর্বলতা পুরুষের পরিহাসের বিষয়, আর তার শক্তি পুরুষের অস্বস্তির কারণ। জীবনধারায় নারী পুরুষকে পরিপূরক হিসেবে দেখে। কিন্তু পুরুষ দেখে নারীকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। সুতরাং সম্পূরক হতে পুরুষের প্রবল আপত্তি। এই উগ্র শ্রেষ্ঠবাদী মনোভাবের কারণেই পুরুষ নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ হিসেবে গণ্য করে; তার বুদ্ধি-বিবেচনা নিয়ে পরিহাস করে; তার মনন ও চিন্তাকে খাটো করে।
নারীর বাস্তববাদিতা ও যুক্তিনির্ভরতা অযৌক্তিক পুরুষকে ক্ষিপ্ত করে এবং তখনই সে নারীকে বন্দি করার জন্য ব্রতী হয়। একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দেখা হয় পুরুষের ভোগ্যপণ্য হিসেবে। ভোগের পণ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তার মালিকানা নিশ্চিত করতে হলে। তাকে শাসনে রাখতে হয় অবাধ্যতা নির্মূল করার জন্য। 
তাকে আটকে রাখতে হয় যখন খুশি তখন ভোগ করার জন্য।

তৃতীয়ত, বলার অপেক্ষা রাখে না, নারীর পরিপ্রেক্ষিতে উগ্র চিন্তাচেতনা নারীকে নিয়ন্ত্রণ করাকে সঠিক বলে মনে করে; নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্বকে অনুমোদন করে এবং পুরুষকে নারীর ক্ষেত্রে ‘নৈতিক পুলিশ’-এর দায়িত্ব দেয়। আমাদের সমাজে এ জাতীয় উগ্র চিন্তাচেতনা যত বিস্তার লাভ করবে, বিশেষত পুরুষের মাঝে, ততই নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্ববাদ, নিপীড়ন ও নারীর স্বাধিকারের ওপরে পুরুষের হস্তক্ষেপ বেড়ে যাবে। তখন পুরুষ বলে দেবে– নারীর কী পোশাক পরিধান করা উচিত; কোথায় কোথায় নারী যেতে পারবে; কী কী করার অনুমতি আছে। সেগুলোর কোনোটা লঙ্ঘিত হলে যে কোনো পুরুষ শুধু পুরুষের অধিকারবলে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবে; নারীকে নিপীড়ন করতে পারবে; তাকে শাস্তি দিতে পারবে। নারীবিদ্বেষী চর্চার বিস্তৃতি এই উগ্র শ্রেষ্ঠত্ববাদকে আরও পাকাপোক্ত করেছে।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে, বৈশ্বিক প্রেক্ষিতেও নারীর অধিকার ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। এ দুর্বলতার পেছনে রয়েছে বিভিন্ন দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পিছিয়ে পড়া; নানান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা; নারী অধিকার বিষয়ে দীর্ঘদিনের অর্জিত নানান ঐকমত্যকে ক্ষুণ্ন করার ক্ষেত্রে নারী অধিকারবিরোধীদের সাফল্য ইত্যাদি। এর ফলে সংঘাত-সম্পৃক্ত যৌন সহিংসতা গত ১৯ বছরে ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে, যার শিকার ৮৫ শতাংশই শিশু বা তরুণী। অন্তত ১২টি দেশে ৫৩ শতাংশ নারী আন্তর্যোগ (ইন্টারনেট) বা অন্যান্য মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হয়েছে। বিশ্বব্যাপী নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। 

বাংলাদেশের জন্য নারীর প্রতি বিদ্বেষ সহিংসতা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে। নারীর প্রতি সহিংসতা যেন এক নিয়মে পরিণত হয়েছে, এটা যেন আর ব্যতিক্রম নয়। সেই সঙ্গে এ সহিংসতা একটি ‘মব’ সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়েছে। একটি গোষ্ঠী পরিস্থিতি তৈরি করে ‘মব’ সহিংসতা করছে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দায় স্বীকার করে শক্ত ব্যবস্থা নিতেই হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে শক্ত হাতে। নারীবিদ্বেষী চর্চা প্রতিহত করতে হবে যূথবদ্ধ ও সামাজিকভাবে। প্রতিবাদ ও প্রতিকার করতে হবে সবাই মিলে।
আজকের বাংলাদেশে নারীর প্রতি যে সহিংসতা ঘটেছে, তা শুধু নারীর প্রতি সহিংসতা নয়; সেটি মানবতার বিরুদ্ধেও সহিংসতা; স্বাধিকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ; শুভবুদ্ধির প্রতি হুমকি। এ লড়াই আমাদের সবার এবং এই লড়াইয়ের কোনো বিকল্প নেই। চূড়ান্ত বিচারে এই লড়াইয়ে দেশকে জিততে হবে। এ জন্য আছিয়া ধর্ষণের বিচার চেয়ে ইতোমধ্যে যে সামাজিক জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, তা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি সরকারও এর দ্রুত ও কার্যকর বিচার করার যে তাগিদ অনুভব করছে, সেটিও পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হতে হবে।

ড.

সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য
দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন
কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ র বলত র জন য দ র বল পর প র র ঘটন ত করত

এছাড়াও পড়ুন:

২৩ কোটি রুপির চাপ টের পাচ্ছেন কলকাতা অলরাউন্ডার

ভেঙ্কটেশ আইয়ার কি দামের চাপ অনুভব করছেন? হ্যাঁ, বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার নিজেই চাপে থাকার কথা স্বীকার করছেন। ২৩ কোটি ৭৫ লাখ রুপি খরচে এবার তাঁকে দলে নিয়েছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। এই অলরাউন্ডারকে নিলামের জন্য না ছেড়ে ধরে রাখলেও এত টাকা খরচ করতে হতো না কলকাতার। স্বাভাবিকভাবেই পারফর্ম করার চাপ একটু বেশিই থাকবে আইয়ারের ওপর।

আইপিএল নিলামে দামি ক্রিকেটারদের নিয়ে আলোচনাটা একটু বেশিই হয়। ২০২৪ আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সে খেলা মিচেল স্টার্কের (২৪.৭৫ কোটি) প্রতিটি ডেলিভারি পিছু খরচ ছিল ৯.৬৮ লাখ টাকার বেশি। প্রতিটি উইকেট পিছু খরচ ১.৪৫ কোটি টাকা। এটাকে চাপ বলুন বা আশীর্বাদ, মোটা দামের খেলোয়াড়দের জন্য প্রত্যাশার চাপ থাকেই। আইয়ারও এর ব্যতিক্রম নন।

টানা ১৩ মৌসুম পর ২০২৪ সালে কলকাতা তৃতীয় শিরোপা জেতে। যেখানে আইয়ারের বড় ভূমিকা ছিল। ব্যাট হাতে ১৫৮.৭৯ স্ট্রাইক রেটে ৩৭০ রান করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে মেগা নিলামে কৌশলের কারণে কলকাতা তাঁকে ছেড়ে দিয়ে পরিণামে ২৩ কোটি ৭৫ লাখ রুপি খরচ করে!

দুই দিন আগে দলে যোগ দিয়েছেন আইয়ার

সম্পর্কিত নিবন্ধ