একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল এক জনযুদ্ধ। আপামর সিপাহি, কৃষক, মজুর তথা সর্বস্তরের মানুষ এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৎকালে এ অঞ্চলে একটি প্রাগ্রসর শিক্ষাঙ্গন হিসেবে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্ররা এর ব্যতিক্রম ছিলেন না; বরং শিক্ষায়তন হিসেবে এই কলেজের বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে কর্মরত প্রাক্তন ছাত্ররা এক মহিরুহ ভূমিকা পালন করেন। জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিরল বীরত্বের পরিচয় দিয়ে সাহসিকতা বা গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড পাওয়াদের মধ্যে এগিয়ে ছিল ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ। এই কলেজের আটজন মহান শহীদের সঙ্গে ১১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা অসীম সাহসিকতা প্রদর্শনের জন্য বিভিন্ন পদক লাভ করেন; যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিবেচনায় যা সর্বোচ্চ। নিম্নোক্ত আটজন শহীদের জীবনই বলে দেয় তাদের ত্যাগের গল্প।
শহীদ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন, বীরউত্তম: ১৯৭১ সালে যশোর সেনানিবাসে অবস্থানরত ১০৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অধীনে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র তৎকালীন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দেশব্যাপী গণহত্যাযজ্ঞ শুরুর অব্যবহিত পর ২৯ মার্চ তাঁর রেজিমেন্টে কর্মরত সব বাঙালি সৈনিক ও অফিসারকে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ৩০ মার্চ সেই নির্দেশ অমান্য করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের হামলা পরিকল্পনা বুঝতে পেরে তৎকালীন লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আনোয়ারের নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদ্রোহ করেন এবং অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র ছিনিয়ে এনে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর পাল্টা হামলা করেন। আট ঘণ্টাব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা অনেকে হতাহত হলেও তাদের অস্ত্রে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ প্রথম সামরিক অফিসারকে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করে। ঢাকা সেনানিবাসে শহীদ লে.
শহীদ বদিউল আলম, বীরবিক্রম: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র বদিউল আলম (বদি) ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর ২৭ তারিখ সান্ধ্য আইন শিথিল করার প্রথম সুযোগে আরও তিন বন্ধুসহ তৎকালীন মুক্তাঞ্চল কিশোরগঞ্জ গিয়ে মেজর কে.এম. সফিউল্লাহর (পরবর্তীকালে এস ফোর্সের প্রধান ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সেনাপ্রধান) দলে যুক্ত হয়ে যুদ্ধ কৌশল প্রশিক্ষণ নেন এবং অস্ত্র সংগ্রহ করে ঢাকায় ফিরে এসে গেরিলা দল গঠন করেন। ঢাকায় প্রথম গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যদের সমন্বয়ে বদি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও দুঃসাহসিক অপারেশনে অংশ নেন। ২৯ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের গোপন সংবাদের ভিত্তিতে আকস্মিকভাবে বদি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। বন্দিদশায় চরম নির্যাতনের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ নির্মিত হয়েছে ক্র্যাক প্লাটুনের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বদিকে নিয়েই।
শহীদ ক্যাপ্টেন এ কে এম নূরুল আবসার: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্র নূরুল আবসার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন পদে কর্মরত ও সেখানকার ট্যাঙ্কবহর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন গণহত্যার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে শতাধিক ট্যাঙ্ক আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়, তখন অকুতোভয় দেশপ্রেমিক আবসার নিরস্ত্র কোটি বাঙালি জনতার প্রাণ রক্ষার তাগিদে বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন। নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও যে ট্যাঙ্কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে তিনি ছিলেন, তার মধ্যে ২০টি ট্যাঙ্ক তিনি সম্পূর্ণ অকেজো করে দিয়েছিলেন। ২৮ মার্চ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে গিয়ে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এর কিছুকালের মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন এবং ২৮ মে ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ মেজর এম এ খালেক: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র এম এ খালেক ১৯৭১ সালের মার্চে কুমিল্লা সেনানিবাসে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। ২৩ মার্চ থেকে সেনানিবাসে সব প্রবেশ ও বহির্গমন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ২৬ মার্চ রাতে ১৫ সেনা পরিবার মেজর খালেকের বাসায় উপস্থিত হয় সেনানিবাস থেকে পালানোর পথনির্দেশনা ও পরামর্শ নিতে। মেজর খালেক ইতোমধ্যে ২৭ মার্চ সেনানিবাসের বন্দি অবস্থা থেকে বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারদের নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ছক কষেছিলেন। পরিকল্পনা বিফল হয়। পাকিস্তানি সেনারা বাসা ঘেরাও করে তুলে নিয়ে যায় মেজর খালেককে। ২৮ মার্চ বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ ক্যাপ্টেন মো. শামসুল হুদা: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র ক্যাপ্টেন হুদা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদাতিক কোরের কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৭১ সালে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয় তখন তিনি পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। তবে ছুটি শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ না দিয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিজয় অর্জনের প্রাক্কালে শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রফিক আহমেদ সরকার: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ১০ম ব্যাচের ছাত্র সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট রফিক আহমেদ সরকার ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালে রংপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে ও নির্দেশনায় সাড়া দিয়ে ২৬ মার্চই তিনি দলত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন। ৩০ মার্চ বেলা ৩টার দিকে এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে তিনি গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সাঁজোয়া বহরে আক্রমণ করেন, এতে তাদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে সক্ষম হলেও এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন। রংপুর সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে নৃশংস অত্যাচারের পর পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ মোহাম্মদ মুফতি কাসেদ: ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের সময় থেকেই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র স্বাধিকারসচেতন মুফতি মোহাম্মদ কাসেদ (০৮/২৪৫) থাকতেন সব আন্দোলন আর মিছিলের সম্মুখ সারিতে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর মুফতি নিশ্চিত হন যে এটিই যুদ্ধের চূড়ান্ত বার্তা। সেই অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ১৪ জুন মুফতি একাই রাজাকারদের একটি ছোট দলের বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে শত্রুদের কবল থেকে এক বাঙালি বন্দিকে উদ্ধার করে আনতে সক্ষম হন। উদ্ধার পর্ব শেষে শত্রুর গুলিতে ঘটনাস্থলেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
শহীদ মোশাররফ হোসেন: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র মোশাররফ হোসেন ১৯৭১ সালের মার্চে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী পেপার মিলে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। প্রতিরোধের এক পর্যায়ে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সফল সংগঠক দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হন এবং পরে গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন।
মামুন রশীদ: ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের প্রাক্তন ছাত্র
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ১৯৭১ স ল র ম ম হ ম মদ র প রথম প রথম স অবস থ তৎক ল
এছাড়াও পড়ুন:
আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের রাজনীতি
নামাজ-রোজার মতোই পহেলা বৈশাখ-পাহাড়ি উৎসব আমাদের সংস্কৃতি।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা, বাংলাদেশ সরকার।
প্রতি বছর এপ্রিলে সংস্কৃতি আলোচনায় আমরা মেতে উঠি। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করেই আমাদের এ মেতে ওঠা।
কেন এই মেতে ওঠা?
মেতে ওঠার ইতিহাসটি নতুন তো নয়ই, উল্টো এই মেতে ওঠার সঙ্গে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পরস্পরের হাত ধরে চলছে, কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা এখনও পূর্ণতা পায়নি বলে প্রতি বছর এই মেতে ওঠা। সাধারণ ধারণায় ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে লাখ লাখ পাকিস্তানি এ দেশে রয়ে গেছে। পরাজিত জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি ও তাদের তৎপরতা যে কোনো যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূমিতে একটি বাস্তবতা। মধ্যযুগে বা সামন্তকালে এমন পরাজিতদের সাধারণত হত্যা করা হতো অথবা ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো। এ বাস্তবতার মোকাবিলায় আদালত বা আইনি প্রক্রিয়ায় পরাজিতদের বিচার আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপীয় চর্চা। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে ‘বিচার’ একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া হলেও, তৎকালীন বিজয়ী বা বাংলাদেশের নেতৃত্বদানকারীরা মানবতার সর্বশেষ চর্চাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তবে তারা ঝুঁকি মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হন এবং শীর্ষ নেতাসহ অসংখ্য জন নিহত হন। এ রাজনৈতিক বাস্তবতাই প্রতি বছর পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করতে মাতিয়ে তোলে। কেন সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনা এপ্রিলে বা পহেলা বৈশাখে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ‘সাংস্কৃতিক’ কর্মীদের অবদান রাজনৈতিক কর্মীদের চেয়ে কম নয়। ভাষা আন্দোলন দিয়ে যার শুরু হলেও, কাগমারী সাহিত্য সম্মেলন কিংবা অনুরূপ আয়োজন শুধু কেন্দ্রীয়ভাবে হয়েছে তা নয়, পাড়ায় পাড়ায় যে সংস্কৃতির চর্চা সেটিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাংলার মুক্তি সংগ্রামে। ছায়ানটের পহেলা বৈশাখ আয়োজন একটি স্বীকৃত মাইলফলক। এটিই পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনার অন্যতম কারণ।
সংস্কৃতি বিষয়টি আসলে কী?
বাউল গান যেমন আমাদের সংস্কৃতি, তেমনি হিন্দুর পূজা, সাওতালি নাচ, চাকমার পূজা, মুসলমানের নামাজ আমাদের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির সব উপাদান ভূমি থেকে উৎসারিত হয় তা নয়। বাণিজ্য বিনিময়, আমদানি ও শাসনের মধ্য দিয়ে চাপিয়ে দেওয়াও বহু কিছু জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেয়। এ দেশের নারীর ঐতিহ্যবাহী পোশাক শাড়ি, ইংরেজ শাসনের প্রভাবে ব্লাউস তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ঐতিহ্য তথা সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। যে বাউল গান ছিল বৌদ্ধ পরবর্তী ব্রাহ্মণবাদের সমালোচক, সে বাউল গান হয়ে উঠেছে ইসলামের তত্ত্বালোচক। মনে রাখতে হবে এ দেশে ইসলাম যখন আসে, তখন কোনো মাদ্রাসা পাস মুফতি এ দেশে ছিলেন না। লোককবি, গায়কেরাই ইসলামের তত্ত্বালোচনা করেছিলেন বলেই ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এ দেশে। এ দেশে মাদ্রাসা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটে ইংরেজদের ইচ্ছায়। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয় দফা মাদ্রাসা-সংস্কৃতির প্রসার ঘটে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায়। তৃতীয় দফা বা বর্তমান রূপের মাদ্রাসা-সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের সামরিক শাসকগোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায়। অর্থাৎ এই যে আমাদের সংস্কৃতির উপাদান হিসেবে ‘মাদ্রাসা শিক্ষা’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, তা ভূমিজাত নয়, বিদেশি শক্তি ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের চাপিয়ে দেওয়া।
একটি জাতি যখন স্বাধীন হতে চায়, স্বাধীন থাকতে চায় তখন তাকে সংস্কৃতির বিবিধ উপাদান নিয়ে ভাবতে হয়। কোনটি তার স্বাধীনতার পক্ষে, কোনটি তার স্বাধীনতার বিপক্ষে তা চিনতে পারতে হয়। সাধারণভাবে ভূমি থেকে যা উৎসারিত তা হচ্ছে নিজস্ব। আমদানিকৃত এবং ভূমি কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত উপাদানগুলোও গুরুত্বপূর্ণ; তবে তা ‘অন্ধকার’ ডেকে আনতে পারে। ইসলামী সংস্কৃতি বা আরব-পারস্য-তুর্কি সংস্কৃতি বাংলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে গৃহীত হয়েছে। হাজার বছর ধরে তা জীবনচর্চারও অংশ। সে অর্থে তা এখন বাংলার সংস্কৃতিও বটে, কিন্তু তা সতর্কতার সঙ্গে, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে চর্চা না হলে দেশের স্বাধীনতাই বিপন্ন হবে।
এখন প্রশ্ন হলো, ভূমি থেকে যা উৎসারিত বা নিজস্ব সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে কীভাবে চিনব ও চর্চা করব?
এই চেনা ও চর্চার প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীদের বিশেষত গবেষক, লেখক ও সাংবাদিকদের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার গুরুত্বকে স্বীকার করেও বলতে হয় এ কাজে মুখ্য ভূমিকা গবেষক, লেখক ও সাংবাদিকদের। তাদের প্রধান শত্রুও আবার বুদ্ধিজীবীরাই। তাই তাদের কাজটি সহজ নয়। ব্রিটিশ শাসনামলে বাঙালি বুদ্ধিজীবীতা বহু উপাদানকে চিহ্নিত করেছেন, পাকিস্তানকালে সে সবই হয়ে উঠেছিল প্রতিরোধের তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের অস্ত্র। লোকগান, যাত্রাপালা, কবিগান, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-সুকান্ত ইত্যাদি। এমন কি নামাজ-মোনাজাতও এই অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। ১৯৭৫-এর পর ভূমিজ উপাদানগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে, নিগ্রহ চালানো হয়েছে কি হয়নি তা এখানে আলোচ্য নয়, এখানে আলোচ্য এটাই যে সংগীত ও চলচ্চিত্রের মতো সাংস্কৃতিক পণ্যের বাণিজ্যিক সাফল্য নির্ভর করে ভূমিজ উপাদানগুলোর যথাযথ ব্যবহারের ওপর। দেশের জনপ্রিয় গান ও চলচ্চিত্রগুলো তার সাক্ষী। লোকজ বিবিধ পণ্য এক পহেলা বৈশাখেই যে অর্থনৈতিক লেনদেন ঘটায় তা সারাবছরের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে, এমনকি বিদেশি বিনিয়োগোর ‘স্বাধীনতা’ হরণের ঝুঁকিকেও মোকাবিলা করে ভূমিজ পণ্য বা লোক পণ্য।
পহেলা বৈশাখের যে আয়োজনটি বিগত বছরগুলোয় ‘সংস্কৃতি’বিষয়ক আলোচনার কেন্দ্রে তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র চর্চায় ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজন যেমন একটি মাইলফলক, এটিও তেমনি। এর প্রভাব ব্যাপক। এই শোভাযাত্রার প্রভাবে দেশে এখন বিবিধ রকম শোভাযাত্রা হয়ে থাকে সেটা যেমন রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, তেমনি স্রেফ সামাজিক। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা আকাশ থেকে হঠাৎ পতিত কোনো ঘটনা নয়। এটি দেশে প্রচলিত হাজার বছরের বিবিধ শোভাযাত্রারই একটি সংঘটিত তথা আধুনিক রূপ বা নাগরিক রূপ। যুক্তিসঙ্গত কারণেই এ শোভাযাত্রার একটি রাজনৈতিক পরিচয় আছে। যার ফলে প্রতিবছর এ শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করেই বৈশাখী সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনায় আমরা মেতে উঠছি প্রতিবছর। এ আলোচনার মধ্য দিয়েই দেশের স্বাধীনতা সুসংহত হবে; তবে বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্ব নিতে হবে স্বরূপ সন্ধানের। ব্রিটিশ কালের বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের পর মৌলিক সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর সন্ধানে বুদ্ধিজীবীদের অনীহা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যই হুমকিস্বরূপ।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর জন্ম দিয়েছে, আরও দেবে। এ উপাদানগুলো স্রেফ বিনোদনের বিষয় নয়; অর্থনীতি ও রাজনীতিতেও রয়েছে তার বিশাল ভূমিকা।
পরিশেষ
ইউরোপীয় ড্রাম আমরা বাজাব, আরবি তাবলও বাজাব, কিন্তু ঢোল ভুলে নয়। এই ঢোল বাজাতে পারাতেই আমাদের স্বাধীনতা। v