ধর্ষকের ‘প্রকাশ্যে শাস্তির’ দাবিতে বায়তুল মোকাররম এলাকায় খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ
Published: 14th, March 2025 GMT
‘ধর্ষকের প্রকাশ্যে’ শাস্তি এবং শাহবাগে পুলিশের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতা-কর্মীরা। তাঁদের মতে, ধর্ষণে অভিযুক্তদের প্রকাশ্যে শাস্তি দিলে দেশে ধর্ষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
আজ শুক্রবার জুমার নামাজের পর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে এ বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে পল্টনের সুরমা টাওয়ারের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ এই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে। এতে দুই শতাধিক মানুষ উপস্থিত ছিলেন। বিক্ষোভকারীরা ‘রশি লাগলে রশি দে, ধর্ষকদের ফাঁসি দে’, ‘ফাঁসি, ফাঁসি, ধর্ষকদের ফাঁসি চাই’সহ নানা স্লোগান দেন।
বিক্ষোভ ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর অবস্থানে ছিলেন। এ সময় পুলিশের সাঁজোয়া যানের পাশাপাশি জলকামানও দেখা গেছে বায়তুল মোকাররম এলাকায়।
বিক্ষোভ মিছিল শেষে সুরমা টাওয়ারের সামনে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন বলেন, ‘আমরা ধর্ষকের প্রকাশ্যে শাস্তি দাবি করছি, এটি করলে দেশে ধর্ষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। আমরা দেশের সব মা-বোনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছি।’
খেলাফত মজলিসের এই নেতা বলেন, দেশের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সব অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
বিক্ষোভ কর্মসূচিতে দলটির কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির শাহিনুল পাশা চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুর রহমান হেলাল, আবুল হাসান আফজাল আলী, মহানগর সভাপতি সানাউল্লাহ আমিন উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুনমাগুরায় ৮ বছরের শিশু ধর্ষণের মামলার তদন্ত দ্রুততম সময়ে শেষ করা হবে: আইজিপি১৩ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
পয়লা বৈশাখ: আনন্দের ছায়ায় ইতিহাস ও আত্মপরিচয়ের লড়াই
যখন বৈশাখের সকালটা কুয়াশা সরিয়ে রঙের খেলা শুরু করে, তখনই যেন এ অঞ্চলের বাংলাভাষী মানুষের প্রাণ জেগে ওঠে। ঢোলের শব্দে, পান্তা-ইলিশের গন্ধে, লাল-সাদা শাড়ির ছটায় বাংলা নববর্ষ হয়ে ওঠে এক উজ্জ্বল, আনন্দঘন, বর্ণিল দিন।
কিন্তু এই উল্লাস-আনন্দ কি কেবল অভিজাত সৌরভে মোড়ানো? নাকি এর পেছনে আছে দীর্ঘ এক সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা—রাজনীতি, প্রতিরোধ আর আত্মপরিচয়ের সন্ধান?
বাংলা নববর্ষের সূচনা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ বলেন, মোগল সম্রাট আকবর রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি ও সৌর বর্ষের মিলনে ‘ফসলি সন’ চালু করেছিলেন।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, সম্রাট আকবর তৎকালীন খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে উপদেষ্টা ফতেউল্লা সিরাজীকে নতুন পঞ্জিকা তৈরি করার দায়িত্ব দেন। ফতেউল্লা সিরাজী ছিলেন সম্রাট আকবরের দরবারের একজন বিদ্বান আলিম ও প্রশাসনিক উপদেষ্টা। বাংলা সনের সংস্কারের দায়িত্ব পেয়ে তিনি স্থানীয় সৌর সন ও আরবি হিজরি সন মিলিয়ে একটি নতুন পঞ্জিকা তৈরি করেন। তাঁর উদ্যোগেই প্রবর্তিত এই বর্ষপঞ্জি থেকেই বর্তমান বাংলা সনের সূচনা, যা শুরু হয় ১৫৮৪ সালে সম্রাট আকবরের শাসনামলে।
কেউ কেউ আবার মনে করেন, এর শিকড় আরও প্রাচীন বিক্রমি সনে, যার প্রবর্তক ছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্য। এই সন খ্রিষ্টপূর্ব ৫৭ সালে শুরু হয়েছিল এবং উত্তর ভারতে এখনো ব্যবহৃত হয়।
আবার অনেকে মনে করেন, বাংলার প্রথম স্বাধীন শাসক রাজা শশাঙ্ক নিজ প্রশাসনিক প্রয়োজনে একটি বর্ষপঞ্জি চালু করেন। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, শশাঙ্ক তাঁর রাজ্যাভিষেকের সময় আনুমানিক ৬১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই সনটি চালু করেন।
যদিও বিক্রম সন এবং রাজা শশাঙ্কের বাংলা সন চালুর বিষয়ে মতভেদ ও বিতর্ক রয়েছে এবং এ দুজনের পক্ষে নির্দিষ্ট প্রমাণও সীমিত, আকবরের পক্ষেই জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়। তবুও বিক্রম সন ও শশাঙ্ক বাংলা পঞ্জিকার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
তবে একটি ব্যাপার স্পষ্ট—পয়লা বৈশাখ এই দিনটি যুগে যুগে রূপ বদলেছে, অর্থও বদলেছে।
পয়লা বৈশাখে নতুন বছরের শুরুতে কৃষকদের সব খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এদিন জমিদারেরা তাঁদের প্রজাদের মিষ্টিমুখ করালেও উৎসবটি ছিল মূলত জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির; সাধারণ মানুষের জন্য এটি কোনো উৎসব ছিল না। জমিদারদের হালখাতার অনুষ্ঠানে মিষ্টিমুখ মানে ছিল কিছুটা রেহাই, কিন্তু সে রেহাই সম্মানজনক ছিল না—ছিল একপেশে দয়ার দান। শ্রমজীবী মানুষ কখনোই ইলিশ-পান্তা দিয়ে নববর্ষ উদ্যাপন করত না। তারা করত রোদে-ঘামে, ধানের ভাতে জীবনের উৎসব।১৯৮৯ সালের কথা। তখনকার স্বৈরাচার এরশাদ শাসনের ছায়া পেরিয়ে একঝাঁক সাহসী ছাত্র-শিল্পী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের নেতৃত্বে রাজপথে বেরিয়ে এল এক প্রতীকী আনন্দের বহর—আনন্দ শোভাযাত্রা। বাঘ-সিংহ, মুখোশ, পাখি আর হাতি—সব মিলিয়ে যেন এক জীবন্ত ক্যানভাস। প্রতিটি রং, প্রতিটি রূপ ছিল প্রতিবাদের ভাষা। তারা বলল, ‘আমরা কে?’ আর উত্তরে তুলে ধরল, ‘আমরা প্রতিবাদী, আমরা সংস্কৃতির আলোয় পথ খুঁজি।’ তাদের প্রতিবাদের সেই রঙিন বহর ছিল নিছক শোভাযাত্রা নয়, ছিল এক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নান্দনিক প্রতিরোধ।
সেই মুহূর্ত থেকেই পয়লা বৈশাখ হয়ে ওঠে সংস্কৃতির শক্তিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দিন। এবং আজ, অনেক বছর পর, ২০২৫ সালের নববর্ষ হতে যাচ্ছে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যাবর্তন—প্রথমবারের মতো বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন হবে এক ফ্যাসিস্ট সরকার, শেখ হাসিনার দমন-পীড়নমুক্ত পরিবেশে। দুনিয়া কাঁপানো জুলাই বিপ্লব এনে দিয়েছে আমাদের সেই পরিবেশ।
এরশাদ পতনের সময়কার মতো যেভাবে নববর্ষ হয়েছিল মুক্তির প্রতীক, এবারও নববর্ষ ফিরে আসছে মানুষের দখলে—সংস্কৃতির স্বাধীন প্রকাশ আর রাজনৈতিক মুক্তচিন্তার মঞ্চ হয়ে। ভবিষ্যৎ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ উৎসব হিসেবে।
এই আনন্দ শোভাযাত্রাই পরে হয়ে ওঠে মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সালে ‘মঙ্গল’ শব্দটি যুক্ত হয়। নামের এই পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তা এড়িয়ে গিয়ে বলা যায়—এই পদযাত্রা এখন এক কল্যাণবোধের প্রতীক। ২০১৬ সালে ইউনেসকো এটিকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়। বিশ্ব বলল, এটি শুধুই উৎসব নয়, এটি এক ‘কল্যাণচিন্তার পদযাত্রা’।
আজকাল পয়লা বৈশাখ মানেই পান্তা-ইলিশ। অথচ ইতিহাস বলে, কৃষক-প্রজাদের কাছে এই দিনটি ছিল খাজনা দেওয়ার আতঙ্কের দিন। পয়লা বৈশাখে নতুন বছরের শুরুতে কৃষকদের সব খাজনা পরিশোধ করতে হতো। এদিন জমিদারেরা তাঁদের প্রজাদের মিষ্টিমুখ করালেও উৎসবটি ছিল মূলত জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির; সাধারণ মানুষের জন্য এটি কোনো উৎসব ছিল না। জমিদারদের হালখাতার অনুষ্ঠানে মিষ্টিমুখ মানে ছিল কিছুটা রেহাই, কিন্তু সে রেহাই সম্মানজনক ছিল না—ছিল একপেশে দয়ার দান। শ্রমজীবী মানুষ কখনোই ইলিশ-পান্তা দিয়ে নববর্ষ উদ্যাপন করত না। তারা করত রোদে-ঘামে, ধানের ভাতে জীবনের উৎসব।
ফরাসি দার্শনিক জঁ বদ্রিয়ার বলেছিলেন, ‘আধুনিক সমাজে অনেক কিছুই বাস্তব নয়—তাকে বাস্তবের চেয়ে উজ্জ্বলতর এক “হাইপার রিয়েলিটি”তে রূপান্তরিত করা হয়।’ পয়লা বৈশাখও কি এমনই এক রূপান্তর? যেখানে প্রতীক থাকে, ইতিহাস হারিয়ে যায়?
বাংলার ইতিহাস এই নববর্ষে লুকিয়ে আছে। রাজা শশাঙ্ক ও সেন আমলে বৌদ্ধ নিপীড়ন, চর্যাপদের ম্লান বিদায়, খিলজির বিজয়ের পর বাংলা ভাষার বিকাশ—সবই যেন এক সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের সূচনা করে। এই সহাবস্থানে গড়ে ওঠে বৈচিত্র্যময় বাংলা সাহিত্য, সংগীত ও চিত্রকলার ভিত্তি।
পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার ভাষাভাষী, হিন্দু ও মুসলমান—সবাই ভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে বড় হলেও এই দিনে তারা এক সাংস্কৃতিক সংলাপে মিলিত হয়।
বাঙালির নববর্ষ কেবল ‘ঐতিহ্য’ নয়। এটি ইতিহাসের টানাপোড়েন, শ্রেণি বিভাজনের প্রতিবাদ এবং আত্মপরিচয়ের এক রঙিন আলেখ্য।
আজকের দিনে পয়লা বৈশাখ অনেকের কাছে শুধুই সেলফি-সেশন, গান-নাচের সময়। কিন্তু এর পেছনে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো জানাটাই আসল উদ্যাপন।
ঐতিহ্যকে বুঝে তার সম্মান করা—এটাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
সুতরাং প্রশ্ন উঠেই যায়—আপনি কোনটি উদ্যাপন করছেন? ঐতিহ্য, না হাইপার রিয়েলিটি?
জয়নাল আবেদীন শিশির যুগ্ম সদস্যসচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)
[email protected]