তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। পশ্চিমের আকাশ থেকে রক্তিম আভা ছিটকে পড়েছে প্রকৃতিতে, গাছপালায়, ধানের খেতে। ধীরে আলো কমে আসছে। ধানখেতের ওপর অনেকটা নিচ দিয়ে সাদা বকের ঝাঁক রাত কাটাতে নিরাপদ ঠিকানার দিকে উড়ে চলছে। আর কিছু সময় পরই মাগরিবের আজান পড়বে। একটা শান্ত, কোলাহলহীন নিরিবিলি পরিবেশ চারদিকে। হঠাৎ সড়ক দিয়ে এক-দুটি গাড়ি ছুটে চলছে, শব্দ বলতে এটুকুই।
এ রকম একটি সময়ে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একাটুনা ইউনিয়নের উত্তরমুলাইম মল্লিকসরাই ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠে চলছে ইফতারের আয়োজন। সারা দিনের রোজা শেষে একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পথচারী ও গ্রামের মানুষ মাটির আসনে ইফতারের জন্য সারিবদ্ধভাবে বসে প্রস্তুত হয়ে আছেন। প্রায় ২০ বছর ধরে এই স্থানটিতে এভাবেই ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো ব্যক্তি এই ইফতারির ব্যবস্থা করেন।
গত বুধবার চাঁদনীঘাট-একাটুনা সড়ক ধরে কাউয়াদীঘি হাওর থেকে মৌলভীবাজার শহরে ফেরার পথে হঠাৎ করেই চোখে পড়ে একদল লোক উত্তরমুলাইম মল্লিকসরাই ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠে সারি ধরে বসে আছেন। তাঁদের সবার সামনে ইফতারের প্যাকেট, পানির বোতল। তখন সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। সূর্য গোল হয়ে ঝুলে পড়েছে পশ্চিমের আকাশে। যেকোনো মুহূর্তে অন্ধকার নেমে আসবে। সবাই চুপচাপ বসে অপেক্ষা করছেন আজানের জন্য; আজান পড়লেই শুরু হবে ইফতার। স্থানীয় লোকজন জানালেন, রোজার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত এভাবেই ওই স্থানটিতে ইফতারের সময় এ দৃশ্য দেখা যায়। প্রায় এক শ মানুষ একসঙ্গে বসে ইফতার করেন। সেদিন (গত বুধবার) ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ একজন ইফতারি দিয়েছিলেন, তাই সবার সামনে ইফতারি প্যাকেট আকারে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে কিছু বেলা থাকতে উত্তরমুলাইম মল্লিকসরাই ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠে গিয়ে দেখা যায়, ইফতারের প্রস্তুতি তখন শুরু হয়ে গেছে। কয়েকটি হাঁড়ি ও বৌলে আখনি, পেঁয়াজু ও ছোলা রাখা আছে। এ দিন ব্যক্তিগত আয়োজন ছিল না। উত্তরমুলাইম মল্লিকসরাই ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার সহযোগী প্রতিষ্ঠান উত্তরমুলাইম মল্লিকসরাই এতিমখানার উদ্যোগে ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে। আগে থেকেই পাকা মাঠে কাপড়ের লম্বা চাদর বিছিয়ে রাখা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা ইফতারের প্লেট সেই চাদরের ওপর সাজিয়ে রাখছেন। ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে সমবেত হতে থাকেন মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পথচারী ও গ্রামের লোকজন। পুরো প্রক্রিয়াটি বসে পর্যবেক্ষণ করছিলেন উত্তরমুলাইম মল্লিকসরাই এতিমখানা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো.
উত্তরমুলাইম মল্লিকসরাই এতিমখানা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. বাচ্চু মিয়াসহ উপস্থিত লোকজন জানালেন, ১৯৭৩ সালে উত্তরমুলাইম ও মল্লিকসরাই এই দুই গ্রামের মানুষের উদ্যোগে উত্তরমুলাইম মল্লিকসরাই ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মাদ্রাসার সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওই দুই গ্রামবাসীর উদ্যোগে ২০০৬ সালে গড়ে তোলা হয়েছে উত্তরমুলাইম মল্লিকসরাই এতিমখানা। এই এতিমখানা চালুর পর থেকেই প্রতি রমজান মাসে নিয়মিত ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে। এই ইফতারে মাদ্রাসা, এতিমখানার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ছাড়াও পথচারী, গ্রামের অনেক শামিল হয়ে থাকেন। সবাই মিলে শান্ত পরিবেশে ইফতার চলে। প্রতিদিন ৭০-৮০ থেকে প্রায় ১০০ জন মানুষ এখানে ইফতার করেন।
প্রতিদিনের ইফতারে আখনি, ছোলা ও পেঁয়াজু প্রায় নিয়মিত উপাদান। এর বাইরে ব্যক্তিগতভাবে যিনি ইফতারের আয়োজন করেন, তাঁদের কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের ফলসহ অন্য উপাদান দিয়ে থাকেন। উত্তরমুলাইম ও মল্লিকসরাই এই দুটি গ্রাম প্রবাসীবহুল। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই দুটি গ্রামের অনেক মানুষ বসবাস করেন। বেশির ভাগ প্রবাসীরাই ইফতারের ব্যবস্থা করেন। প্রবাসীরা তাঁদের দেশে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে, অথবা নিজেরা সরাসরি আগেভাগে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একদিনে যাতে একাধিকজন ইফতার না দেন, তাই আগেই জানিয়ে বুকিং দিতে হয়। মাঝে মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইফতারের উদ্যোক্তা না থাকলে এতিমখানার আয়োজনে ইফতারের ব্যবস্থা হয়ে থাকে।
এতিমখানার বাবুর্চি আছেন, তিনিই ইফতারের রান্নাবান্না করেন। রোজার এই একটা মাস ঝড়-বাদল ব্যতীত খোলা আকাশের নিচে সবাই মিলে ইফতারে শামিল হয়ে থাকেন, মাটির আসনে বসে শান্ত পরিবেশে ইফতার করেন। সারিবদ্ধভাবে মাটির আসনে বসে এই ইফতারে কারও সঙ্গে কারও কোনো ভেদাভেদ থাকে না। প্রায় ২০ বছর ধরে একইধারায় ইফতারের এই আয়োজন চলে আসছে। এ ছাড়া অনেকে ইফতার ছাড়াও রাতের সেহরির আয়োজন করে থাকেন।
উত্তরমুলাইম মল্লিকসরাই ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল আবদুল হালিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে সবাই মিলে ইফতার করি। এর মধ্যে শিক্ষার্থী আছে, পথচারী আছেন। এলাকারও অনেকে আসেন। এখানে রোজার মাসে দারুল কিরাত প্রশিক্ষণ হয়ে থাকে। এ সময় (রোজার মাসে) স্থায়ী শিক্ষার্থী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রশিক্ষণ নিতে শিক্ষার্থীরা আসে। এলাকার অনেকে লন্ডন, আমেরিকায় থাকেন। কে কোনদিন ইফতারি দিবেন, আগে বুকিং দেন। অনেকে সাহ্রির খাবার দেন। প্রতিবছরই এখানে এরকম ইফতারি হয়ে থাকে।’
ততক্ষণে বেলা ফুরিয়ে গেছে। সূর্যের আলো নিভে যেতে শুরু করেছে। পাশের সবুজ ধানের মাঠ ছুঁয়ে উড়ে যাচ্ছে সাদা বকের ঝাঁক। কোলাহলমুক্ত সময়টি আরও শান্ত হয়ে উঠেছে। ইফতারের প্রস্তুতিও শেষ হয়ে গেছে। সবাই যার যার আসনে বসে আছেন। শুধু অপেক্ষা তখন আজানের।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ই ইফত র র ইফত র র প ইফত র ক র অন ক পথচ র র আসন
এছাড়াও পড়ুন:
৫ বছরের জন্য উৎসে কর কমানোর দাবি বিজিএপিএমইএর
পাঁচ বছরের জন্য পণ্য রপ্তানিতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫ শতাংশ করার দাবি জানিয়েছে তৈরি পোশাকশিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্য সরবরাহকারী কারখানামালিকদের সংগঠন বিজিএপিএমইএ। এ ছাড়া স্থানীয় বাজার থেকে কেনা কাঁচামালের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার, স্থায়ী বা অস্থায়ী আন্তঃ বন্ড স্থানান্তরের ব্যবস্থা, একসঙ্গে দুই বছরের জন্য আমদানিপ্রাপ্যতা প্রদানসহ কয়েকটি দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বাস্তবায়নের জন্য এই দাবিগুলো জানায় বিজিএপিএমইএ। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রাক্–বাজেট আলোচনায় দাবিগুলো তুলে ধরেন বিজিএপিএমইএর সভাপতি মো. শাহরিয়ার।
বিজিএপিএমইএ বলছে, তৈরি পোশাক খাতের বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জাম এবং পোশাকসহ অন্য খাতের মোড়কপণ্য উৎপাদনে দেশ এখন স্বাবলম্বী। বর্তমানে কার্টন, পলিব্যাগ, হ্যাঙ্গার, বোতাম, লেবেল, জিপার, হ্যাংট্যাগ ও গাম টেপসহ পোশাক খাতের ৩০ থেকে ৩৫ ধরনের সরঞ্জাম এবং অন্যান্য খাতের মোড়ক তৈরি করে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। বিজিএপিএমইএর সদস্যসংখ্যা প্রায় দেড় হাজার।
মো. শাহরিয়ার কাঁচামালের আমদানি প্রাপ্যতা একসঙ্গে দুই বছর দেওয়ার দাবি জানান। তিনি বলেন, দুই বছরের জন্য আমদানি প্রাপ্যতা দেওয়া হলে সেবাদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের সময়, শ্রম ও অর্থ সাশ্রয় হবে। বন্ডের আওতায় বিনা শুল্কে আমদানির সুযোগ থাকায় রাজস্বের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না। এ ছাড়া তিনি কন্টিনিউয়াস বন্ডের সুবিধা চান। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতের মতো এ উপখাতের প্রতিষ্ঠানগুলোয় কন্টিনিউয়াস বন্ডের সুযোগ না থাকায় উৎপাদন কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। এতে রপ্তানি কমে যায়।
কোম্পানির সঞ্চয়ী ও স্থায়ী আমানতের মুনাফার ওপর উৎসে কর ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করার দাবি জানান বিজিএপিএমইএর সভাপতি। তিনি বলেন, টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলার–সংকটসহ বিভিন্ন কারণে তফসিলি ব্যাংকগুলোতে তারল্যসংকট রয়েছে। তারল্যসংকট দূরীকরণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঞ্চয়ী বিনিয়োগ ভালো ভূমিকা রাখে। তাই আমানতের মুনাফার ওপর উৎসে কর কমালে দেশের রপ্তানি বাড়বে।
পাঁচ বছরের জন্য উৎসে কর দশমিক ৫ শতাংশ করার দাবি জানানোর পেছনে মো. শাহরিয়ারের যুক্তি হলো, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে কোনো পণ্যে আর্থিক প্রণোদনা দিতে পারবে না। এরই মধ্যে প্রণোদনা কমাতে শুরু করেছে সরকার। প্রণোদনা হ্রাস বা বন্ধ হলে কিছু পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। সে জন্য উৎসে কর কমানো হলে রপ্তানি উৎসাহিত হবে।