আমার বন্ধু অরূপ, জীবন নিয়ে তার ভাবনা অনেকটা ভাবলেশহীন। কিন্তু আজ সকালে তাকে দেখলাম চিন্তিত। কারণ কী? ‘তুমি তো জানো, আমার মা ডায়াবেটিসের কারণে কিডনি খারাপ হয়ে মারা গেছেন পাঁচ বছর হলো। আজ বাসার গ্লুকোমিটারে চেক করে দেখি, ১৩ মিলিমোল, মন খারাপ হয়ে আছে, চিন্তা লাগছে তাই।’ অরূপের বয়স ৫৫। যে কেউ তার দিকে তাকানোর আগে তার ভুঁড়ির দিকে তাকাবে। বললাম, ব্লাড প্রেশারের কী অবস্থা?

কথার মাঝখানে এল এক রোগী, যাঁকে আমি চাচা বলে ডাকি। ৭৯ বছর তাঁর। ৩০ বছর ধরে ডায়াবেটিস, কিন্তু তাঁর সব রিপোর্ট নরমাল। তাঁর গড় ডায়াবেটিস ৭%–এর নিচে থাকে, রক্তচাপ নরমাল থাকে। খুব নিয়ম মেনে চলেন।

বন্ধুকে বললাম, এত চিন্তার কিছু নেই। তাঁকে দেখ, নিয়ম মানছেন। ভালো আছেন। সকালের নাশতা খেলাম একসঙ্গে দুজনে। খাবার ছিল রুটি, সবজি, ডিম আর চিনি দিয়ে কফি। নাশতায় যে রুটি খেলাম, চিনি দিয়ে চা খেলাম, সবজি—এসব খাবার ভেঙে গ্লুকোজ হয়, আর এসব গ্লুকোজ কোষে ঢুকতে লাগে ইনসুলিন। অনেকটা চাবি দিয়ে দরজা খোলার মতো। যদি শরীরে ইনসুলিন না থাকে অথবা পরিমাণে কমে যায়, কারও কারও এমনও হয়, ইনসুলিন শরীরে আছে, এমনকি অনেক সময় বেশিও থাকে, তারপরও দেখা যায় সে ইনসুলিন রক্তে গ্লুকোজ কমাতে পারছে না। থেকেও নেই। ইনসুলিন আধিক্য থাকা সত্ত্বেও যখন গ্লুকোজ বেশি থাকে, তখন বলা হয় ইনসুলিন রেসিসটেন্স।

যদি গ্লুকোজ কোষের ভেতরে ঢুকতে না পারে, তাহলে আমাদের এই খাবার কোনো কাজে আসে না, বরং রক্তে গ্লুকোজ বেশি আছে, কিন্তু ইনসুলিনের অভাবে, অথবা ইনসুলিন কাজ না করার কারণে কোষে গ্লুকোজের ঘাটতি দেখা দেয়, আমাদের শরীর খারাপ হয়ে যায়, ওজন কমে যায়। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম, মহাসাগরে ভেসে থাকা একটি ডিঙি নৌকা কিন্তু খাবার পানি নেই। চারদিকে লবণাক্ত পানি। ইনসুলিন শরীরে একেবারেই যদি না থাকে, খুব অল্প সময়ের ভেতরে রোগীরা বিভিন্ন জটিলতায় মারা যান। যেমন ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিস। যাঁদের আমরা টাইপ–১ ডায়াবেটিক বলে থাকি।

বেঁচে থাকার জন্য তাঁদের ইনসুলিন অপরিহার্য। সুস্থভাবে জীবন যাপন করার জন্য পরিমিত ইনসুলিন দরকার। ইনসুলিনের পরিমাণ কমে গেলে, অথবা ইনসুলিন যদি কাজ না করতে পারে, তাহলে রক্তে গ্লুকোজ বেশি থাকে তখন বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়। টাইপ–২ ডায়াবেটিসের রোগীদের শরীরে প্রাথমিক অবস্থায় ইনসুলিনের আধিক্য থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায়। একজন মানুষ যদি খাবার বেশি খেয়ে থাকে, ব্যায়াম না করে থাকে, ওজন বেড়ে যায়, পেটে ও লিভারে চর্বি জমে, তখন শরীরের বাইরে কিছু পরিবর্তন হয়, যেমন ঘাড় কালো হয়ে যায়। রক্তচাপ বেড়ে যায়।

এ সময় অরূপ জিজ্ঞেস করল, আজকাল কি সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়, HOMA-IR, Insulin-এর মাত্রা এগুলো করব নাকি? দেখো, টাইপ–২ ডায়াবেটিস মানেই ইনসুলিন আধিক্য বা ইনসুলিন রেসিসটেন্স, যারা হাঁটে না, খাবার খায় বেশি, ওজন বেশি, তারা সবাই ইনসুলিন রেসিসটেন্স। তাদের বেশি থাকবে, এটাই গবেষণায় প্রমাণিত। এ জন্য পয়সা খরচ করে ইনসুলিন লেভেল সব রোগীর পরীক্ষা করার দরকার নেই। বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা করে থাকি। বরং ওজিটিটি করলে বোঝা যাবে, ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খেয়ে কার কত গ্লুকোজ বাড়ে? যার ইনসুলিন লেভেল যত শরীরে কমে যাবে, অথবা বেশি ইনসুলিন খাকা সত্ত্বেও কম কাজ করবে, তার গ্লুকোজের মাত্রা তত বেশি। কখনো কখনো C-peptide দেখা হয় টাইপ–১ ডায়াবেটিসের রোগীদের থেকে টাইপ–২ ডায়াবেটিস আলাদা করার জন্য।

রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা খালি পেটে ৭ মিলিমোল ও ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে ১১.

১ মিলিমোল ও তার বেশি থাকলেই ডায়াবেটিস। আর খালি পেটে ৬.১–এর বেশি গ্লুকোজ এবং খাওয়ার পরে ৭.৮ মিলিমোল এর কম থাকলে প্রি–ডায়াবেটিস। অর্থাৎ খালি পেটে ৬.১ থেকে ৭ মিলিমোল-এর মধ্যে, আর ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার পরে ৭.৮ থেকে ১১.১ মিলিমোল-এর মধ্যে থাকা প্রি–ডায়াবেটিকের রোগীরা ব্যায়াম, খাবার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পুরোপুরি ডায়াবেটিস হওয়া থেকে বাঁচতে পারেন।

ডায়াবেটিস একধরনের নীরব ঘাতক। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকলে ধীরে ধীরে আমাদের চোখ, হার্ট, কিডনি নষ্ট করে দেয়। রক্তনালিগুলোয় চর্বি জমে হার্টের রোগ হয়, এর সঙ্গে সঙ্গে পায়ে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, পায়ে ঘা হয়, চিকিৎসা দেরি হলে পা কেটে ফেলতে হয়। চোখের ভেতরে রক্তক্ষরণের কারণে অন্ধত্ব দেখা দেয়। কিডনির কাজ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে যায়, একটা সময়ে কিডনি বদলাতে হয়। রক্তচাপ বেড়ে যায়। চুল, নখ, চামড়া, হাড়, পারিবারিক জীবন থেকে শুরু করে সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সময় যত যায়, ডায়াবেটিসের বয়স বাড়ে, শরীরের ক্ষতিও বাড়তে থাকে।

যে রোগীর ৫০ বছরে প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, আর যার ২০ বছরে প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, দেখা গিয়েছে, কম বয়সের তিনি ৫০ বছরে আসার আগেই চোখ, হার্ট, কিডনি খারাপ হয়ে গেছে। এ জন্য কম বয়সের রোগীদের অনেক বেশি সজাগ থাকতে হয়। ওষুধ অথবা ইনসুলিন নিতে হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে। সকাল, দুপুর ও রাতে যাঁদের খালি পেটে ৫ থেকে ৬ মিলিমোল এবং সকাল, দুপুর ও রাতে খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর ৮ থেকে ১০ মিলিমোলের মধ্যে রাখতে পারে এবং তিন মাসের গড় ডায়াবেটিস ৭%–এর নিচে রাখতে পারে, তাদের ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা খুব একটা দেখা দেয় না।

খালি পেটে (৭) অথবা খাওয়ার পরে (১০) গ্লুকোজ বেশি থাকলে ধীরে ধীরে সমস্যা দেখা দেয়। হাত–পা জ্বালাপোড়া থেকে অনুভূতি কমে যায়। গ্লুকোজের মাত্রা যত বেশি, ক্ষতির পরিমাণও তত বেশি।

এ জন্য গ্লুকোজের মাত্রা বেশি থাকলে আমরা ইনসুলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করি। মুখে খাওয়ার ওষুধ শরীরের জমানো ইনসুলিন বের করে, কিন্তু ইনসুলিন তৈরি করে না। এ কারণে মুখে খাওয়ার ওষুধ খেতে খেতে এক সময় বিটা সেলে জমানো ইনসুলিন ঘাটতি দেখা দেয়, ইনসুলিন আর বের করতে পারে না, রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায়। তাই বাইরে থেকে ইনসুলিন নেওয়াটা একমাত্র সমাধান।

যার খালি পেটে গ্লুকোজ সব সময় ১১ বা ১২ মিলিমোল থাকে, অথবা এর বেশি থাকে, গবেষণায় প্রমাণিত সত্য যে আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে তাঁর বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেবে। সঙ্গে যদি রক্তচাপ থাকে, মা–বাবারও ডায়াবেটিস থাকে, ধূমপান করে থাকেন, নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস না থাকে, রক্তে চর্বি বেশি থাকে তাহলে বিভিন্ন জটিলতা সময়ের আগেই দেখা দেয়। আর খালি পেটে ৯ বা ১০ মিলিমোল থাকলে তাদেরও একই জটিলতা দেখা দেবে, হয়তো ৪ বা ৫ বছর দেরি হবে, কিন্তু হবেই। অনেক রোগী ভেবে থাকেন সকালে ভালো আছে, তার মানে সারা দিনও রিপোর্ট ভালো, কিন্তু দেখা গেছে দুপুরে খাওয়ার পর তাঁর গ্লুকোজ অনেক বেশি ১৬, ১৭ অথবা ১৮-এর ওপরে। তিনি কখনো চেকও করেননি, জানেন না। এই জন্য প্রত্যেক রোগীর নিজেদের গ্লুকোমিটার থাকা দরকার। ভালো থাকতে হলে ২৪ ঘণ্টাই গ্লুকোজ নরমাল রাখতে হবে। নিয়মিত চেক করতে হবে।

কথার মাঝখানে একজন রোগী বলল, কিটোডায়েটের কথা শোনা যায়, এ নিয়ে কী ভাবনা আপনার? দেখুন কিটোডায়েট অনেকটা মেইন বই না পড়ে নোট বই পড়ার মতো। সাময়িক কাজ করে, ওজনও কমে। কিন্তু ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য এটা না। খাবারে যদি গ্লুকোজ কম থাকে, তাহলে শরীরে জমানো প্রোটিন/ মাংস, চর্বি থেকে গ্লুকোজ নতুন করে তৈরি করে, কিন্তু যদি ইনসুলিন শরীরে না থাকে অথবা পরিমাণে কমে গেলে, চর্বি ভেঙে কিটো অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর এ রোগীরাই ডায়াবেটিক কিটোএসিডোসিসে মারা যান। নিকট অতীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু লোকের ব্যবসায়িক প্ররোচনায় টাইপ–১ রোগীরা ইনসুলিন বন্ধ করে দেয়, তাদের আইসিইউ নিয়েও বাঁচাতে পারিনি। আবার টাইপ–২ রোগীরা বেশি দিন যারা কিটোডায়েট মেনেছে, তাদের হার্টের, লিভারের জটিলতা বেড়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত। প্রোটিন বেশি খাওয়ার কারণে ইউরিক অ্যাসিড, কোলোন ক্যানসার ও কিডনির জটিলতা বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রত্যেক রোগীর জন্য গাইড বুক ছাপিয়েছে, যেখানে ডায়াবেটিস সম্পর্কে একটা সহজ ভাষায় তথ্য, ব্যায়াম, খাবারের নিয়ম, সময়, ওজন অনুযায়ী খাবারের চার্ট সব দেওয়া আছে। সুস্থ থাকার জন্য নিজেদের ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানতে হবে। শুধু ওষুধ খেলেই হবে না, গ্লুকোজের পরিমাণ সকাল, দুপুর ও রাতে তিনবেলাতেই ভালো আছে কি না, প্রেশার নিয়ন্ত্রণে কি না, রক্তে কোলেস্টেরল লেভেলের নিচে আছে কি না, ওজন কেমন রাখতে হবে, তিন মাসের গড় ৭%–এর নিচে কি না, ইউরিনের সঙ্গে প্রোটিন যাচ্ছে কি না, কিডনি, চোখ এসবের কী অবস্থা—সবকিছু সম্পর্কে আপনার চিকিৎসক থেকে জেনে নেবেন। আর নিজে বুঝলেই ভালো থাকবেন। পরিবারকে ভালো রাখতে পারবেন।

অধ্যাপক ডা. মো. ফিরোজ আমিন

বিভাগীয় প্রধান, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ডায়াবেটোলজি বিভাগ

বারডেম জেনারেল হাসপাতাল।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইনস ল ন র র পর ম ণ খ র প হয় র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

এই ৭ বদভ্যাস ধীরে ধীরে আপনাকে অলস বানাচ্ছে

ইশপের সেই গল্প তো আমাদের প্রায় সবারই জানা। খরগোশ আর কচ্ছপ একদিন দৌড় প্রতিযোগিতায় নামল। খরগোশ এক নিমেষেই অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল কচ্ছপ অনেক পেছনে। তখন খরগোশ ভাবল, একটু বিশ্রাম নিই। এই বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল খরগোশ। ওদিকে ধীরে ধীরে কচ্ছপ পৌঁছে গেল শেষ দাগে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা অনেকেই খরগোশের মতো আয়েশ করতে গিয়ে অনেক কিছু থেকে পিছিয়ে পড়ি। অলসতা এক দিনে তৈরি হয় না, বরং দিন দিন কিছু নির্দিষ্ট অভ্যাসের মাধ্যমে অলসতা আমাদের পেয়ে বসে। একসময় জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। যা আমাদের শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয় করার পাশাপাশি মানসিক শক্তিও কমিয়ে দেয়। চলুন দেখে নিই বিষয়গুলো।

ঘুম থেকে দেরিতে ওঠা

ঘুম থেকে দেরি করে উঠলে অলসতার সঙ্গেই আসলে দিনের শুরুটা হয়। এতে দেহঘড়িরও ছন্দপতন হয়। এ ছাড়া দেরিতে ঘুম থেকে উঠলে কাজ করার সময় কমে যায়, দিনভর বিষণ্ন লাগে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একবার স্ক্রল করতে শুরু করলে অবচেতনেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়

সম্পর্কিত নিবন্ধ