ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তেকে ম্যানিলায় গ্রেপ্তার করে দ্য হেগে পাঠানোর পর নেওয়া হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) আটককেন্দ্রে। গত বুধবার রাতে কেন্দ্রটির বাইরে সমবেত হয়েছিলেন তাঁর সমর্থকেরা। তাঁদের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা; স্লোগান দিচ্ছিলেন তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে। এ সময় একটি গাড়ি আটককেন্দ্রের লোহার ফটক হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল দ্রুতগতিতে। ধারণা করা হচ্ছে, গাড়িটিতে দুতার্তে ছিলেন।

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে উড়োজাহাজ থেকে নামার কিছু আগেও ৭৯ বছর বয়সী দুতার্তে তাঁর রক্তক্ষয়ী ‘মাদকযুদ্ধ’ নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন। আইসিসি বলছেন, এ যুদ্ধে দুতার্তের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগ করার ‘গ্রহণযোগ্য ভিত্তি’ রয়েছে।

ফিলিপাইনে পৌর মেয়র থাকাকালে ও পরে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দুতার্তের ‘মাদকযুদ্ধে’ স্বল্পকালীন মাদক কারবারি, মাদকসেবী এবং আরও অনেকে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন।

সরকারিভাবে নিহত ব্যক্তিদের এ সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। যদিও মানবাধিকারকর্মীদের ধারণা, প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা হাজার হাজার।

দুতার্তে বলেছেন, দেশের সড়কগুলো থেকে অপরাধ নির্মূল করতে তিনি মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে ওই অভিযান চালিয়েছিলেন।

তবে মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ, এ অভিযানের ঢালাও অপব্যবহার করেছে পুলিশ, নিশানা বানিয়েছে শহরের দরিদ্র তরুণদের।

ফিলিপাইনে পৌর মেয়র থাকাকালে ও পরে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দুতার্তের ‘মাদকযুদ্ধে’ স্বল্পকালীন মাদক কারবারি, মাদকসেবী এবং আরও অনেকে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। সরকারিভাবে নিহতদের এ সংখ্যা ছয় হাজারের মতো। যদিও মানবাধিকারকর্মীদের ধারণা, প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা হাজার হাজার।

দুতার্তে এশিয়ার প্রথম কোনো সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান, যিনি আইসিসির বিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন। এ ছাড়া তিনিই প্রথম কোনো সন্দেহভাজন সাবেক রাষ্ট্রনেতা, যাকে গত তিন বছরের মধ্যে দ্য হেগে পাঠানো হলো।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্তে সেখানে হাজির করা হলো দুতার্তেকে।

কীভাবে কারা প্রকোষ্ঠে গেলেন দুতার্তে

রদ্রিগো দুতার্তেকে গত সোমবার গ্রেপ্তার করে দ্য হেগের কাছে সমর্পণ করা নজিরবিহীন কিছু ঘটনার ফসল।

দুতার্তের সমর্থকদের অভিযোগ, ফিলিপাইনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোস আইসিসিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন, যিনি প্রকাশ্যে ক্ষমতাধর দুতার্তে পরিবারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন।

আমি আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছি। আমি বলেছি, আমি তোমাদের সুরক্ষা দেব এবং তোমরা যা করবে, তার সব দায়দায়িত্ব আমার।রদ্রিগো দুতার্তে, ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট

যখন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ আদালতগুলো কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির বিচার করতে অসমর্থ হয় বা বিচার করতে আগ্রহী হয় না, তখন তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সর্বশেষ স্থল হলো আইসিসি। কিন্তু দুতার্তের এ ঘটনা আইসিসির এখতিয়ার কার্যকর করার ক্ষেত্রে এই আদালত রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার ওপর কতটা নির্ভরশীল, তা-ই স্মরণ করিয়ে দেয়। কার্যকর অর্থেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া এমন অপরাধীদের গ্রেপ্তারের কোনো ক্ষমতা এই আদালতের নেই, যা প্রায়ই প্রত্যাখ্যান করা হয়ে থাকে।

দুতার্তের ক্ষেত্রে এমনকি ২০২২ সাল পর্যন্ত তাঁকে কখনো আইসিসিতে বিচারের সম্মুখীন করার সুযোগ পাওয়া ছিল দৃশ্যত অচিন্তনীয়। ওই সময় দুতার্তের মেয়ে ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট সারা দুতার্তে প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে জিততে মার্কোসের সঙ্গে শক্তিশালী জোট গড়ে তোলেন।

দুতার্তে পরিবারের সঙ্গে মার্কোসের সম্পর্ক এতটাই ভালো ছিল যে কয়েক মাস আগপর্যন্ত তিনি আইসিসিকে সহযোগিতা করার ধারণা নাকচ করে দেন। কিন্তু দুতার্তের বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করে তাঁকে এখন দ্য হেগের কাছে তুলে দেওয়া হলো। এতে এটিই বোঝা গেল, রাজনীতির হাওয়া যখন পাল্টে যায়, তখন একসময় যাঁকে ভাবা হচ্ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকবেন, তিনিই এসে গেলেন দ্য হেগের নাগালে।

যখন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ আদালতগুলো কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির বিচার করতে অসমর্থ হয় বা বিচার করতে আগ্রহী হয় না, তখন তাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সর্বশেষ স্থল হলো আইসিসি। কিন্তু দুতার্তের এ ঘটনা আইসিসির এখতিয়ার কার্যকর করার ক্ষেত্রে এই আদালত রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার ওপর কতটা নির্ভরশীল, তা-ই স্মরণ করিয়ে দেয়। কার্যকর অর্থেই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া এমন অপরাধীদের গ্রেপ্তারের কোনো ক্ষমতা এই আদালতের নেই, যা প্রায়ই প্রত্যাখ্যান করা হয়ে থাকে।

ম্যানিলায় গ্রেপ্তার হওয়া থেকে শুরু করে দ্য হেগে উড়োজাহাজে অবতরণ—দুতার্তকে প্রত্যর্পণের পুরো প্রক্রিয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেছেন তাঁর মেয়ে কিটি ও সহযোগীর মাধ্যমে দুতার্তে নিজেই। দুতার্তেকে বহনকারী উড়োজাহাজকে ফ্লাইট রাডারে সার্বক্ষণিক নজরে রাখা হচ্ছিল।

ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় ফিলিপাইনের সাবেক এই প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছি। আমি বলেছি, আমি তোমাদের সুরক্ষা দেব এবং তোমরা যা করবে, তার সব দায়দায়িত্ব আমার।’ ম্যানিলা থেকে দ্য হেগ—২৪ ঘণ্টার যাত্রায় আরও কিছু পোস্ট শেয়ার করেছেন দুতার্তে। এটি সেগুলোরই একটি।

আরও পড়ুনফিলিপাইনে মাদকবিরোধী যুদ্ধের সব দায় নিলেন দুতার্তে১৩ মার্চ ২০২৫

আইসিসির জন্য খুবই প্রয়োজনীয় এ বিজয়?

দুতার্তেকে গ্রেপ্তার করার ঘটনা এখন এ কঠোর বার্তাই দিচ্ছে যে ব্যক্তিবিশেষ যত ক্ষমতাশালী হোন না কেন, নিজ কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁকে জবাবদিহি করানো যেতেই পারে। এর মধ্য দিয়ে রোধ করা যেতে পারে ভবিষ্যতে ক্ষমতার অপব্যবহারও।

জাতীয় সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে আইসিসির ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক উসকে দিয়েছে দুতার্তেকে গ্রেপ্তার করার এ ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের মতো আইসিসির সদস্য নয়, এমন দেশগুলো প্রায়ই এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে থাকে।

আরও পড়ুনফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতার্তেকে আইসিসিতে পাঠানো হয়েছে১২ মার্চ ২০২৫

তহবিলের জোগান পেতে ও নিজেকে কর্মক্ষম হিসেবে তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক এই আদালত তার ১২৮ সদস্যদেশের ওপর নির্ভরশীল।

তাই গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে দুতার্তের হেগে প্রত্যর্পণ ও আইসিসির আটককেন্দ্রে প্রথম রাত থাকার ঘটনা এ আদালতকে অতিপ্রয়োজনীয় বিজয়ই এনে দিয়েছে—এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গুরুত্বপূর্ণ দুই রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর দুতার্তেকে দ্য হেগে নিয়ে আসা, এটিই প্রমাণ করে, ভয়ানক নিষ্ঠুরতায় জড়িত ব্যক্তিকে বিচারের মুখোমুখি করার সক্ষমতা আইসিসির রয়েছে। যদিও ইতিপূর্বে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জারি করা তার পরোয়ানা কার্যকর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

দুতার্তের বিচার আইসিসির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাও বটে। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করাকে কেন্দ্র করে আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম খানের বিরুদ্ধে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতার্তেকে গ্রেপ্তার করা এই আদালতকে শক্ত জবাব দেওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে।

আরও পড়ুনঅপরাধ দমনে ‘ডেথ স্কোয়াড’ রাখার কথা স্বীকার করলেন দুতার্তে২৯ অক্টোবর ২০২৪আরও পড়ুনআইসিসির পরোয়ানায় গ্রেপ্তার হলেও দুতার্তের বিচার করা কি সম্ভব হবে১২ মার্চ ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফ ল প ইন র স ব ক গ র প ত র কর ব চ র করত ব চ র কর আইস স র ক র যকর সহয গ ত পর য় ন র কর র অপর ধ প রথম ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

কথা বলবেন পুতিন-ট্রাম্প

ইউক্রেন যুদ্ধে সাময়িক বিরতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে পুরোপুরি সম্মত নন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যুদ্ধবিরতির বিষয়ে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তাই শিগগিরই দুই পরাশক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে আলাপচারিতা শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। শুক্রবার বিবিসি এ তথ্য জানিয়েছে।

বৃহস্পতিবার যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে মস্কো গিয়েছেন ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিফ উইটকফ। পুতিনের সঙ্গে উইটকফের বৈঠক হয়েছে। বৈঠকের পর পুতিন কোনো মন্তব্য করেননি। তবে এর আগে তিনি বেলারুশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ইউক্রেনের জন্য ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি ‘ভালো হবে’ এবং ‘আমরা এর পক্ষে।’ তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে কিছু ‘সূক্ষ্মতা’ আছে।

শুক্রবার পুতিনের সঙ্গে উইটকফের বৈঠক প্রসঙ্গে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, বৈঠকে ‘রাশিয়াকে অতিরিক্ত তথ্য দেওয়া হয়েছিল’ এবং ভ্লাদিমির পুতিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য নিজস্ব ‘তথ্য ও অতিরিক্ত সংকেত’ দিয়েছিলেন।

তিনি জানান, দুই নেতার মধ্যে টেলিফোনে আলোচনার পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু উইটকফ ফিরে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বিষয়টি অবহিত করার পরেই কেবল সময় নির্ধারণে একমত হবেন পুতিন ও ট্রাম্প।

ঢাকা/শাহেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ