দখল, দূষণ ও অপরিকল্পিত সেতুতে মরছে যশোরের নদ-নদী
Published: 14th, March 2025 GMT
যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা। এখানে ভৈরব নদের ওপর রয়েছে দড়াটানা সেতু। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে সামনে তাকালে দেখা যায়, কচুরিপানায় ভরা যেন সরু খাল বয়ে গেছে। দৃষ্টিসীমার মধ্যে পড়ে আরও দুটি সেতু। সেতুর দুই দিকে প্লাবনভূমি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে অসংখ্য স্থাপনা। এসব স্থাপনার বর্জ্য পড়ে স্রোত ও প্রাণহীন ভৈরব নদে। নদের পানি কুচকুচে কালো আর দুর্গন্ধময়।
হিন্দু দেবতা শিব রুদ্রমূর্তি ধারণ করলে তাঁকে ভৈরব বলে ডাকা হয়। তবে ভৈরবের এখন আর রুদ্রমূর্তি নেই। দখল–দূষণ আর অপরিকল্পিত সেতুর কারণে মৃতপ্রায় ভৈরব কোনোরকমে বয়ে চলেছে।
যশোরের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে কপোতাক্ষ, ভৈরব, হরিহর, কোদলা, ইছামতী, হাকর, বেতনা বা বেত্রবতী অথবা বেত্রাবতী, মুক্তেশ্বরী, কাজলা, চিত্রা, শ্রী, টেকা, হরি, ভদ্রা ও আতাই নদ–নদী। ভয়াবহ দখল, দূষণ ও অপরিকল্পিত নির্মিত সেতুতে এখন নদ-নদীগুলো অস্তিত্বসংকটে।
মৃতপ্রায় এসব নদ-নদীকে বাঁচাতে নানা সময়ে খননসহ নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কিন্তু সেসব খুব একটা কাজে আসেনি, উল্টো পরিকল্পনায় সমন্বয়হীনতায় নদ-নদীর ওপর তৈরি করা হয়েছে ছোট-বড় অসংখ্য সেতু। আরও সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব সেতুর অপরিকল্পিত দৈর্ঘ্য সংকুচিত করেছে নদ-নদীকে।
অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে উদ্যোগ নেই
দখলের কারণে কয়েকটি নদী ভরাট হয়েছে, নাব্যতা হারিয়েছে। পাশাপাশি নদ-নদী ব্যাপকভাবে দূষণের শিকার। দূষণে নদীর পানি ও নদীনির্ভর প্রাণবৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। দখল ও দূষণে কয়েকটি নদী মৃতপ্রায়। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই ওয়েবসাইটে যশোর জেলার নদ-নদীর অবৈধ দখলদারদের আংশিক তালিকাটি প্রকাশ করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এই তালিকায় জেলার ৬৭৩ জন দখলদারের নাম ছিল। ২০২২ সালে সংস্থাটির ওয়েবসাইট থেকে স্থাপনার তালিকা সরিয়ে নেওয়া হয়। নদী রক্ষায় তালিকা অনুযায়ী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো কার্যকর উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে তালিকায় যশোর সদর উপজেলায় ভৈরব দখল করে নির্মাণ করা রয়েছে দলীয় কার্যালয়, বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র (ক্লিনিক), মার্কেট, পুকুর, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিজিবি ক্যাম্প ও বাসাবাড়ি। যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা সেতু থেকে কাঠের পুল পর্যন্ত ভৈরব নদের ৮০০ মিটারের দুই তীরে অন্তত ২০টি বহুতল ভবনসহ ৫০ জনের বেশি প্রভাবশালী দখলদার রয়েছেন। নদের প্লাবনভূমিতে এসব স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। নদের এই অংশের সীমানা নির্ধারণ এবং অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করেনি জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। অথচ নদের ওই অংশ বাদ রেখে অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করে পশ্চিমাংশের ৮৪টি স্থাপনা ও পূর্বাংশের সাড়ে ৩ কিলোমিটারে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়। পরে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। পানি আইনে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। নদের তীরে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনার মেডিকেল বর্জ্য ও ভবনের শৌচাগারের মানববর্জ্য সরাসরি পাইপলাইনের মাধ্যমে ভৈরব নদে ফেলা হচ্ছে। এতে নদের পানি কালো কুচকুচে হয়ে পড়েছে। পানিও দুর্গন্ধযুক্ত।
বাঘারপাড়া উপজেলায় চিত্রা নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে দলীয় কার্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, পুকুর, বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি। আংশিক তালিকায় এই নদীর ওপর ৪১টি অবৈধ দখলদার রয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু পরে নদীর অবৈধ দখলদারদের যে পূর্ণাঙ্গ তালিকা জেলা প্রশাসকের দপ্তরে পাঠানো হয়, তাতে ১২৬ জন দখলদারের নাম উল্লেখ করা হয়।
আংশিক তালিকায় মনিরামপুর উপজেলার হরিহর, মুক্তেশ্বরী, শ্রী ও হরি নদ–নদী দখল করেছেন ১৬২ জন; ঝিকরগাছা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদের দুই পাশ দখল করে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন ৩০ জন; চৌগাছা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদ দখল করেছেন ৮০ জন এবং শার্শা উপজেলার বেতনা নদী ও হাকর নদ দখল করেছেন ২২৪ জন। আর অভয়নগর উপজেলায় ভৈরব নদ দখলের তালিকায় ৪৯ জনের নাম রয়েছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) হিসাব অনুযায়ী, যশোরের অভয়নগর উপজেলায় ভৈরব নদের তীরে অবৈধ স্থাপনা ছিল ৮৫টি। এর মধ্যে যশোর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং বিআইডব্লিউটিএর সহযোগিতায় ২০২৪ সালের মে মাসে দুই ধাপে ৫০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছিল। অবশিষ্ট ৩৬টি স্থাপনা পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর পর থেকে উচ্ছেদ অভিযান কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ থাকায় নদের জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বাড়ছে। থেমে নেই দূষণ। দুটি ট্যানারি ও বিভিন্ন কারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য ভৈরব নদের পানি দূষিত করছে।
খননে প্রবাহ ফেরেনি ভৈরবে
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মুরটি গ্রামে পদ্মার শাখা জলঙ্গিতে ভৈরবের জন্ম। এরপর ভৈরব মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা, ঝিনাইদহ জেলার কোর্টচাঁদপুর, যশোর জেলার তাহেরপুর, আফ্রা ও অভয়নগর এবং খুলনা জেলার ফুলতলা, দিঘলিয়া ও দৌলতপুর হয়ে খুলনা নগরীর কাস্টম ঘাট এলাকায় ভৈরব রূপসা নদীতে গিয়ে মিশেছে। চৌগাছার তাহেরপুর কপোতাক্ষের উৎসমুখ থেকে খুলনার রূপসা-ভৈরবের মিলনস্থল পর্যন্ত ভৈরবের মোট দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে রূপসা-ভৈরবের সঙ্গমস্থল থেকে যশোরের বসুন্দিয়া পর্যন্ত ভৈরবের ৪১ কিলোমিটার প্রবহমান। আর বসুন্দিয়া থেকে সদর উপজেলার রূপদিয়া পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার ক্ষীণধারা প্রবহমান। সেখান থেকে চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুরের কপোতাক্ষের উৎসমুখ পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার প্রবাহহীন। ২৭৯ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে সদর উপজেলার বসুন্দিয়া পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার নদ পুনঃখনন হয়েছে। এ ছাড়া বসুন্দিয়া থেকে আফ্রা ঘাট পর্যন্ত চার কিলোমিটার নদ ড্রেজিং করা হয়েছে, কিন্তু প্রবাহ ফেরেনি ভৈরবের।
খনন চলছে কপোতাক্ষের
কপোতাক্ষে প্রাণ ফেরাতে ২০১১ সালে নদ খননের প্রকল্প হাতে নেয় পাউবো। ২৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)’ শেষ হয় ২০১৭ সালে। যদিও খুব একটা সুফল পাওয়া যায়নি তখন।
২০২০ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে খননকাজ শুরু করে পাউবো। এতে ব্যয় হচ্ছে ৫৩১ কোটি টাকা। দুই প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৮১৭ কোটি টাকা। নতুন প্রকল্পের কাজ ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। এখন পর্যন্ত ৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে ৬৭ কিলোমিটার খনন করা হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র ম ণ কর র উপজ ল র দখলদ র র নদ র প ন প রকল প নদ নদ ক উপজ ল য় কর ছ ন য় ভ রব ত য় নদ ভ রব র বর জ য র অপর
এছাড়াও পড়ুন:
যশোরে পানিতে ডুবে তিন শিশুর মৃত্যু
যশোরের অভয়নগর ও মনিরামপুরে পানিতে ডুবে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বুধবার তিনটি পৃথক স্থানে এসব ঘটনা ঘটে।
অভয়নগর উপজেলার প্রেমবাগ ইউনিয়নের মাগুরা গ্রামে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আরিয়ান নামের দেড় বছর বয়সী এক শিশু পুকুরে ডুবে মারা যায়। পরে দুপুর পৌনে ২টার দিকে নওয়াপাড়া পৌরসভার বুইকরা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেনের মেয়ে রুকসানা (১১) নামের আরেক শিশুর পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়।
জানা গেছে, প্রেমবাগ ইউনিয়নের মাগুরা গ্রামের শামীম হোসেন ও রুবিনা বেগমের ছেলে আরিয়ান। বুধবার সকালে আরিয়ানকে রেখে তার মা রুবিনা বড় মেয়ে হুমায়রাকে নিয়ে স্কুলে যান। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পরিবারের লোকজন আরিয়ানকে দেখতে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে কোথাও না পেয়ে বাড়ির পাশের পুকুরে খুঁজতে গেলে তাকে পানিতে ভাসতে দেখা যায়। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
নওয়াপাড়া পৌরসভার বুইকরা গ্রামের জাহাঙ্গীর হোসেনের মেয়ে রুকসানা (১১) দুপুরে বাড়ির পাশে পুকুরে গোসল করতে যায়। পরে তাকে খুঁজে না পেয়ে পুকুরে খুঁজতে থাকেন পরিবারের লোকজন। স্থানীয়রা পরে তাকে পুকুর থেকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে এলে তার মৃত্যু হয়। রুকসানার পরিবারের অভিযোগ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের দায়িত্বে অবহেলায় রুকসানার মৃত্যু হয়েছে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা হাসপাতাল অবরুদ্ধ করে রাখে। পরে অভয়নগরের ইউএনও পুলিশসহ এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন।
এ বিষয়ে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা আলিমুর রাজিব বলেন, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
অভয়নগর থানার ওসি আব্দুল আলিম বলেন, দুই শিশু মারা যাওয়ার বিষয়ে থানায় দুটি পৃথক অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।
মনিরামপুরে টিউবওয়েলের পাশে খেলার সময় পানিভর্তি বালতির মধ্যে পড়ে ১৮ মাস বয়সী আরশি খাতুনের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার দুপুরে উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের ধলিগাতী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। আরশি ওই গ্রামের ডাচ্-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের কর্মচারী ইকবাল হোসেনের মেয়ে।
এলাকাবাসী জানান, বুধবার দুপুরে বাড়ির টিউবওয়েলের পাশে আরশিকে মাটিতে রেখে মা সুমাইয়া খাতুন গৃহস্থালির কাজ করছিলেন। আরশি খেলা করতে করতে এক পর্যায়ে সবার অজান্তে টিউবওয়েলের পাশে পানিভর্তি বালতির মধ্যে পড়ে যায়। পরে বালতির ভেতর থেকে তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরশির মৃত্যু হয়। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে আরশির বাবা-মা শোকে পাথর। এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
মনিরামপুর থানার ওসি নূর মোহাম্মদ গাজী জানান, এ ব্যাপারে কেউ থানায় অভিযোগ করেনি।