ফসলের জাকাত ‘উশর’ গরিবের পাওনা হক। এটি আদায় করা ফরজ ইবাদত। ‘উশর’ ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক আদায় করতে হয়, বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) এমন যে যিনি সৃজন করেছেন বাগান সুউচ্চ (মাচানে লতানো) ও অনুচ্চ (মাচানবিহীন) এবং খেজুরগাছ ও খেত; তার স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন আর জলপাই ও ডালিম, সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য। তোমরা খাও তার ফল যখন ফল পরিপক্ব হয়; আর তার হক (উশর) প্রদান করো তা উত্তোলনের দিনে; আর (উশর প্রদান না করে) সীমা লঙ্ঘন করো না, নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৪১)

রাসুলুল্লাহ (সা.

) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের জাকাত আছে, শরীরের জাকাত রোজা।’ (ইবনে মাজাহ: ১৭৪৫) ভূমিতে উৎপাদিত শস্য তথা ফল-ফসলেরও জাকাত রয়েছে। উশর মানে হলো এক-দশমাংশ। প্রাকৃতিক পানি দ্বারা উৎপাদিত শস্যের জাকাতের পরিমাণ হলো ‘উশর’ অর্থাৎ ১০ শতাংশ। সেচের পানি দ্বারা উৎপাদিত শস্যের জাকাতের পরিমাণ ‘নিসফ উশর’ অর্থাৎ ৫ শতাংশ। কোনো ভূমি যদি একই সঙ্গে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উভয় পানি দ্বারা চাষ করা হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে ফসলের জাকাত ‘উশর’ ও ‘নিসফ উশর’-এর মাঝামাঝি হিসেবে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ দিতে হবে; অথবা ১০ শতাংশ ও ৫ শতাংশের মধ্যবর্তী যেকোনো পরিমাণ আদায় করলে হবে। সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বৃষ্টির পানি, প্রবাহিত ঝরনার (নদীর) পানি ও মাটির স্বাভাবিক আর্দ্রতা দ্বারা যে ফল-ফসল উৎপাদিত হয়, তার ১০ ভাগের ১ ভাগ (১০ শতাংশ) এবং সেচের মাধ্যমে যে ফল-ফসল উৎপাদন করা হয়, তার ২০ ভাগের ১ ভাগ (৫%) জাকাত প্রদান করতে হবে।’ (বুখারি, তিরমিজি)

প্রাকৃতিক উপায়ে আহরিত মধু ও সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদিত লবণের ‘উশর’ (১০%) এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করা মধু ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উৎপাদন করা লবণে ‘নিসফ উশর’ (৫%) প্রদান করতে হয়। সংরক্ষণযোগ্য ফল-ফসল নিসাব পরিমাণ (২০ মণ) বা এর বেশি হলে তবেই উশর সরকার আদায় করবে। এর কম হলে বা সংরক্ষণযোগ্য না হলে মালিক নিজেই প্রদান করবেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘প্রত্যেক জিনিসের জাকাত আছে, শরীরের জাকাত রোজা।’ (ইবনে মাজাহ: ১৭৪৫)। ভূমিতে উৎপাদিত শস্য তথা ফল-ফসলেরও জাকাত রয়েছে

যেসব উৎপাদনের উশর প্রদান করতে হয়: ১. ফল-ফলারি: খেজুর, আঙুর, কিশমিশ, নারকেল, সুপারি, কলা, পেঁপে, আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, আমড়া, আমলকী, তেঁতুল, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি ফল-ফলারি এবং ২. শাকসবজি: লাউ, কুমড়া, ঝিঙে, করলা, বেগুন, শসা, ক্ষীরা, পুঁইশাক, শিম, বরবটি, আলু, কচু ইত্যাদি এবং ৩. মসলা-প্রসাধন: পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ, ধনে, জাফরান, মেহেদি, জাইতুন, জিরা, শর্ষে-রাই, সয়াবিন ইত্যাদি। এবং (৪) খাদ্যশস্য: ধান, গম, যব, ভুট্টা, ডাল, মসুর, ছোলা, কলাই, চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম, আখরোট ইত্যাদি এবং (৫) ফসল: শণ, পাট, তুলা, রেশম, আখ, মধু, লবণ ইত্যাদি।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে সব মুসলিম নাগরিকের জমিই উশরী ছিল। খলিফা হজরত ওমর (রা.) শুধু যুদ্ধ বিজিত ভূমিতে ‘খারাজ’ বা কর আরোপ করেন। এতে মুসলিম ফকিহরা একমত হয়েছেন, মুসলিম মালিকানাধীন কোনো ভূমিতে খারাজ বা ভূমিকর আরোপ করা যাবে না; শুধু বিজিত দেশের অমুসলিম নাগরিকদের ভূমিতে খারাজ আরোপ করা হবে। ইমাম আবু ইউসুফ (রা.) বলেছেন, ‘যেসব ভূমির মালিকগণ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন, সেসব ভূমি উশরী।’ (আল মাবসুত)

মুসলিম বিজয়ের সময় মালিকহীন, পরিত্যক্ত বা পতিত ভূমি যা পরবর্তীকালে মুসলিমগণ মালিকানা লাভ করেন বা ব্যবহার করেন; সেসব ভূমিও উশরী হিসেবে গণ্য। মুসলিম শাসক কর্তৃক মুসলিম নাগরিককে চাষাবাদের জন্য প্রদত্ত ভূমি এবং মুসলিম কর্তৃক আবাদকৃত সব ভূমিতে উশর প্রযোজ্য। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের সব ফসলি ভূমি উশরী। তাই এই সব ভূমির উৎপাদনের উশর প্রদান করা জরুরি। ‘উশর’ সেসব খাতে ব্যয় করা যায়, জাকাত যেসব খাতে ব্যয় করা যায়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected] 

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর ম ণ সব ভ ম ফসল র

এছাড়াও পড়ুন:

ফসলের জাকাত ‘উশর’ গুরুত্বপূর্ণ ফরজ

ফসলের জাকাত ‘উশর’ গরিবের পাওনা হক। এটি আদায় করা ফরজ ইবাদত। ‘উশর’ ফসল তোলার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক আদায় করতে হয়, বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) এমন যে যিনি সৃজন করেছেন বাগান সুউচ্চ (মাচানে লতানো) ও অনুচ্চ (মাচানবিহীন) এবং খেজুরগাছ ও খেত; তার স্বাদ ভিন্ন ভিন্ন আর জলপাই ও ডালিম, সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য। তোমরা খাও তার ফল যখন ফল পরিপক্ব হয়; আর তার হক (উশর) প্রদান করো তা উত্তোলনের দিনে; আর (উশর প্রদান না করে) সীমা লঙ্ঘন করো না, নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৪১)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের জাকাত আছে, শরীরের জাকাত রোজা।’ (ইবনে মাজাহ: ১৭৪৫) ভূমিতে উৎপাদিত শস্য তথা ফল-ফসলেরও জাকাত রয়েছে। উশর মানে হলো এক-দশমাংশ। প্রাকৃতিক পানি দ্বারা উৎপাদিত শস্যের জাকাতের পরিমাণ হলো ‘উশর’ অর্থাৎ ১০ শতাংশ। সেচের পানি দ্বারা উৎপাদিত শস্যের জাকাতের পরিমাণ ‘নিসফ উশর’ অর্থাৎ ৫ শতাংশ। কোনো ভূমি যদি একই সঙ্গে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উভয় পানি দ্বারা চাষ করা হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে ফসলের জাকাত ‘উশর’ ও ‘নিসফ উশর’-এর মাঝামাঝি হিসেবে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ দিতে হবে; অথবা ১০ শতাংশ ও ৫ শতাংশের মধ্যবর্তী যেকোনো পরিমাণ আদায় করলে হবে। সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘বৃষ্টির পানি, প্রবাহিত ঝরনার (নদীর) পানি ও মাটির স্বাভাবিক আর্দ্রতা দ্বারা যে ফল-ফসল উৎপাদিত হয়, তার ১০ ভাগের ১ ভাগ (১০ শতাংশ) এবং সেচের মাধ্যমে যে ফল-ফসল উৎপাদন করা হয়, তার ২০ ভাগের ১ ভাগ (৫%) জাকাত প্রদান করতে হবে।’ (বুখারি, তিরমিজি)

প্রাকৃতিক উপায়ে আহরিত মধু ও সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদিত লবণের ‘উশর’ (১০%) এবং আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করা মধু ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উৎপাদন করা লবণে ‘নিসফ উশর’ (৫%) প্রদান করতে হয়। সংরক্ষণযোগ্য ফল-ফসল নিসাব পরিমাণ (২০ মণ) বা এর বেশি হলে তবেই উশর সরকার আদায় করবে। এর কম হলে বা সংরক্ষণযোগ্য না হলে মালিক নিজেই প্রদান করবেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘প্রত্যেক জিনিসের জাকাত আছে, শরীরের জাকাত রোজা।’ (ইবনে মাজাহ: ১৭৪৫)। ভূমিতে উৎপাদিত শস্য তথা ফল-ফসলেরও জাকাত রয়েছে

যেসব উৎপাদনের উশর প্রদান করতে হয়: ১. ফল-ফলারি: খেজুর, আঙুর, কিশমিশ, নারকেল, সুপারি, কলা, পেঁপে, আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, আমড়া, আমলকী, তেঁতুল, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি ফল-ফলারি এবং ২. শাকসবজি: লাউ, কুমড়া, ঝিঙে, করলা, বেগুন, শসা, ক্ষীরা, পুঁইশাক, শিম, বরবটি, আলু, কচু ইত্যাদি এবং ৩. মসলা-প্রসাধন: পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ, ধনে, জাফরান, মেহেদি, জাইতুন, জিরা, শর্ষে-রাই, সয়াবিন ইত্যাদি। এবং (৪) খাদ্যশস্য: ধান, গম, যব, ভুট্টা, ডাল, মসুর, ছোলা, কলাই, চিনাবাদাম, কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম, আখরোট ইত্যাদি এবং (৫) ফসল: শণ, পাট, তুলা, রেশম, আখ, মধু, লবণ ইত্যাদি।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে সব মুসলিম নাগরিকের জমিই উশরী ছিল। খলিফা হজরত ওমর (রা.) শুধু যুদ্ধ বিজিত ভূমিতে ‘খারাজ’ বা কর আরোপ করেন। এতে মুসলিম ফকিহরা একমত হয়েছেন, মুসলিম মালিকানাধীন কোনো ভূমিতে খারাজ বা ভূমিকর আরোপ করা যাবে না; শুধু বিজিত দেশের অমুসলিম নাগরিকদের ভূমিতে খারাজ আরোপ করা হবে। ইমাম আবু ইউসুফ (রা.) বলেছেন, ‘যেসব ভূমির মালিকগণ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন, সেসব ভূমি উশরী।’ (আল মাবসুত)

মুসলিম বিজয়ের সময় মালিকহীন, পরিত্যক্ত বা পতিত ভূমি যা পরবর্তীকালে মুসলিমগণ মালিকানা লাভ করেন বা ব্যবহার করেন; সেসব ভূমিও উশরী হিসেবে গণ্য। মুসলিম শাসক কর্তৃক মুসলিম নাগরিককে চাষাবাদের জন্য প্রদত্ত ভূমি এবং মুসলিম কর্তৃক আবাদকৃত সব ভূমিতে উশর প্রযোজ্য। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের সব ফসলি ভূমি উশরী। তাই এই সব ভূমির উৎপাদনের উশর প্রদান করা জরুরি। ‘উশর’ সেসব খাতে ব্যয় করা যায়, জাকাত যেসব খাতে ব্যয় করা যায়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected] 

সম্পর্কিত নিবন্ধ