ঝরেই গেল ‘ছোট্ট ফুল’ আছিয়া, কাঁদছে দেশ
Published: 14th, March 2025 GMT
সবুজ কাপড়ে মোড়ানো কফিন। আট বছরের ছোট্ট শিশু আছিয়া খাতুন সেই কফিনে ‘ঘুমে’। মমতামাখা হাতে সেই কফিন স্পর্শ করছিলেন মা আয়েশা আক্তার। ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে, আর কখনও ঘুম ভাঙবে না বুকের নিধি আছিয়ার। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমঘরের সামনে তখন পিনপতন নিঃশব্দ। মধ্যদুপুরে আছিয়া নামে ‘ছোট্ট ফুল’ অকালে ঝরে যাওয়ায় ফাল্গুনের শেষ বিকেলটায় সবার মনে যন্ত্রণার পীড়া। আছিয়ার কফিন যখন বের করে আনা হয়, তখন হঠাৎ ভেঙে যায় নীরবতা। মায়ের হৃদয়ভাঙা আর্তনাদে উপস্থিত সবার চোখের আঙিনায় নোনাজল। ‘আছিয়া আছিয়া’ বিলাপ যেন থামছিল না আয়েশার। মাগুরায় ধর্ষণের শিকার আছিয়া দেশ-বিদেশের কোটি মানুষের হৃদয় নাড়িয়ে গতকাল দুপুরে চলে গেল অনন্তলোকে।
সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল দুপুর ১টার দিকে শিশুটির মৃত্যু হয় বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সমবেদনার পাশাপাশি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে মশাল মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.
সিএমএইচ থেকে আছিয়ার কফিন নেওয়া হয় তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরে। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে তার মরদেহ যায় মাগুরায়। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে শহরের নোমানী ময়দানে জানাজা শেষে শ্রীপুরের সোনাইকুন্ডিতে আছিয়াকে দাফন করা হয়। এদিকে গতকাল রাতে শিশুটিকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তের বাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনতা।
মাগুরা শহরতলির নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে গেল ৬ মার্চ আছিয়া ধর্ষণের শিকার হয়। সেই খবরে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের আগুন। পালিত হয়ে আসছে ধারাবাহিক প্রতিবাদ কর্মসূচি। মাগুরার নিভৃত পল্লি শ্রীপুরের সোনাইকুন্ডির আছিয়া হয়ে ওঠে শিশু ও নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ‘মশাল’। ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মিছিল ও মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি চলছে। আছিয়ার মা গত ৮ মার্চ মাগুরা সদর থানায় চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। মামলার আসামিরা হলো– শিশুটির ভগ্নিপতি সজীব হোসেন (১৮) ও বোনের শ্বশুর হিটু শেখ (৪২), সজীবের অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাই (১৭) এবং তাদের মা জাবেদা বেগম (৪০)। তাদের চারজনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
‘এতটুকু আবদার’
সিএমএইচের হিমঘরের সামনে গিয়ে দেখা যায়, মেয়ের লাশ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন আছিয়ার মা আয়েশাসহ স্বজনরা। আয়েশাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও বারবার তিনি মূর্ছা যাচ্ছিলেন। বিলাপ করতে করতে আয়েশা বলতে থাকেন, ‘আমার নাবালক সোনামণিরে যেভাবে মারছে, আমার মণিকে যেভাবে গলায় ফাঁস দিয়ে মারছে– আমি তাগোর (অভিযুক্ত) ফাঁস দিয়ে বিচার চাই। এরম মৃত্যু চাই আমি, আমার মণিরে যেমন বেলেড দিয়ে কাটছে, গলায় ফাঁস দেছে, ঠিক সেরকম বিচার চাই আমি আপনাদের কাছে। এতটুকু আবদার। ওরে যেন ওইরকম ফাঁসি দিয়ে মারে। ও রকম যেন ওরে বেলেড দিয়ে কাটে। আমার মেয়েটারে যে কষ্ট দিছে না? আমি তারেও এরকম দেখতে চাই।’
সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে আয়েশা বলেন, ‘ওর আপার বাড়িতে যাওয়ার পর, ওর আপাকে ধরে মেরেছিল। তখন আছিয়া বলেছিল, সে বাড়িতে গিয়ে মাকে সব বলে দেবে। এর পরই সেই রাতে এরকম ঘটনা ঘটেছে। বড় মাইয়াটারে ইচ্ছামতো মেরে আলাদা ঘরে থুইয়া দিছিল। পরে রাত ১১টার দিকে আমার কাছে ফোন দিয়ে বলছে আমার মণি অসুস্থ। আমি গিয়ে দেখি সদর হাসপাতালে ভর্তি করাইছে। তারে রাইখে পলাইছে ওই মহিলা।’
আয়েশা বলেন, ‘মেয়েটার সঙ্গে শেষ কথা কিছু অইল না। এটা বড় কষ্ট থাকল। মেয়ে বোনের শ্বশুরের বাসায় যেতে চাইছিল না। জোর করে পাঠাইছিলাম। যদি না পাঠাইতাম তাহলে এই অবস্থা হতো না।’
হিমঘরের সামনে আছিয়ার মামা ইউসুফ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘অভাবের সংসার আমার বোনের। তাঁর স্বামী কৃষক ছিলেন। কয়েক মাস আগে গ্রামে একটা মারধরের ঘটনায় বোনজামাইর মাথায় লাঠির আঘাত পায়। এর পর থেকে তার মানসিক সমস্যা। বোনজামাইর দুরবস্থা ও সংসারের টানাপোড়েনের কারণে চার মাস আগে হিটু শেখের ছেলের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় আছিয়ার বোনের। কে জানত ওই পরিবার এত খারাপ! আগে জানলে কি ওই ঘরে আত্মীয়তা করতাম।’
হেলিকপ্টারে নেওয়া হলো গ্রামে
শিশুটির লাশ সেনাবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে মাগুরায় নেওয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে হেলিকপ্টারটি মাগুরা স্টেডিয়ামে অবতরণ করে। হেলিকপ্টারে শিশুটির মা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার মাগুরা যান। ফরিদা আখতার বলেন, ‘এটি রাষ্ট্র বা সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। কারণ, এই ধর্ষণের ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। শিশুটি আমাদেরই মেয়ে। কাজেই আমরা সেভাবেই দেখছি।’ এর আগে সিএমএইচে আছিয়ার মা আয়েশা ও স্বজনকে সান্ত্বনা দেন তিনি।
সন্ধ্যায় প্রায় একই সময়ে আলাদা একটি হেলিকপ্টারে মাগুরা যান জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠন হাসনাত আবদুল্লাহ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক প্রমুখ। এর আগে সিএমএইচে সারজিস আলম বলেন, ‘আমরা আমাদের বোনকে যেভাবে হারিয়েছি; এটি পুরো দেশের জন্য লজ্জার। যারা এই ঘটনায় দায়ী, অবিলম্বে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আগামীর বাংলাদেশে আর কোনো বোনকে আমরা এভাবে হারাতে চাই না। ধর্ষণ নামের নৃশংসতাকে চিরতরে বন্ধ করতে হবে।’
সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ এ ঘটনায় ফেসবুকেও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। একই স্ট্যাটাস শেয়ার করেছেন দু’জন। তারা লিখেছেন, ‘আমাদের বোন আর নেই। তার ধর্ষণের বিচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্ষকদের শাস্তির এক দৃষ্টান্ত স্থাপন হোক। বিচারহীনতা, বিচারে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং দীর্ঘসূত্রতা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে যে ধ্বংসাবশেষ জায়গায় নিয়ে গিয়েছে, শিশুটির ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মাধ্যমে সেই বিচার ব্যবস্থা আবার জেগে উঠুক। পুরো বাংলাদেশ বোনটির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, লজ্জিত।’
সেনাবাহিনীর সমবেদনা
আইএসপিআরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মাগুরায় নির্যাতনের শিকার শিশুটি আজ (বৃহস্পতিবার) দুপুর ১টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। সিএমএইচের সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োগ এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। শিশুটির গতকাল সকালে তিনবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে। দুবার স্থিতিশীল করা গেলেও তৃতীয়বার আর হৃদস্পন্দন ফিরে আসেনি।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ৮ মার্চ শিশুটিকে সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকার সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। শিশুটির বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছে সেনাবাহিনী। শিশুটির শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সেনাবাহিনী গভীর সমবেদনা জানাচ্ছে। যে কোনো প্রয়োজনে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
মাগুরা থেকে ফরিদপুর, এর পর ঢাকায়
পুলিশ ও আছিয়ার পরিবার সূত্রে জানা যায়, ৬ মার্চ বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হয় আছিয়া। পরদিন অচেতন অবস্থায় তাকে মাগুরা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ওই দিন দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে রাতেই পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর পর শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সংকটাপন্ন শিশুটিকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (পিআইসিইউ) থেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। পরদিন রোববার শিশুটিকে সিএমএইচে পেডিয়াট্রিক আইসিইউতে নেওয়া হয়।
মামলায় যা বলা হয়েছে
আছিয়া ধর্ষণের মামলার এজাহারে বলা হয়, চার মাস আগে মাগুরা পৌর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে শিশুটির বড় বোনের বিয়ে হয়। ওই বাড়িতে বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুর থাকত। বিয়ের পর থেকে বড় মেয়েকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিল তার শ্বশুর। বিষয়টি পরিবারের অন্য সদস্যরা জানতেন। এ নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ১ মার্চ বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যায় আট বছরের শিশুটি। ৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে খাবার খেয়ে বড় বোন ও তার স্বামীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমায় আছিয়া। রাত আড়াইটার দিকে বড় বোন ঘুম থেকে জেগে দেখেন, ছোট বোন পাশে নেই, মেঝেতে পড়ে আছে। তখন শিশুটি বড় বোনকে জানায়, তার স্পর্শকাতর অঙ্গে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। তখন বড় বোন মনে করেন, সে ঘুমের মধ্যে আবোলতাবোল বকছে। এর পর সকাল ৬টার দিকে শিশুটি আবার বোনকে জ্বালাপোড়ার কথা বলে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বোনকে জানায়, রাতে দুলাভাই (বোনের স্বামী) দরজা খুলে দিলে তার বাবা (শ্বশুর) তার মুখ চেপে ধরে তাঁর কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে। সে চিৎকার করতে গেলে তার গলা চেপে ধরা হয়। পরে তাকে আবার বোনের কক্ষের মেঝেতে ফেলে রেখে যায়।
এজাহারে আরও বলা হয়, ঘটনা জানার পর শিশুটির বড় বোন তাঁর মাকে মোবাইল ফোনে বিষয়টি জানাতে গেলে তার স্বামী মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে তাঁকে মারধর করে। এ কথা কাউকে বললে আছিয়াকে হত্যার হুমকি দিয়ে তাদের দুই বোনকে আলাদা দুটি কক্ষে আটকে রাখে। সকালে এক নারী প্রতিবেশী বাড়িতে এলে বোনের ভাশুর দরজা খুলে দেয়। তখন আছিয়ার মাথায় পানি দিয়ে সুস্থ করানোর চেষ্টা করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে বোনের শাশুড়ি অন্য প্রতিবেশীর সহায়তায় মাগুরা হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে মেয়েটিকে জিনে ধরেছে বলে চিকিৎসকদের জানান। তবে চিকিৎসক ও অন্যরা বিষয়টি টের পেলে শাশুড়ি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স এমএইচ বড় ব ন পর ব র আম র ম র ঘটন গতক ল ঘটন য় অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
আটদিনের লড়াইয়ে সঙ্গী ছিল পুরো দেশ, চোখের জলে বিদায়
আট দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই, শিশুটির এই লড়াইয়ের সঙ্গী ছিল পুরো দেশ। তার যন্ত্রণা দাগ কেটেছে গণমাধ্যমকর্মীদের হৃদয়েও। নিউজরুমে অগ্রাধিকার পেয়েছে শিশুটির স্বাস্থ্যের হালনাগাদ খবর। গুরুত্ব দিয়ে কভার করা হয়েছে শিশুটির চোখের পাতা নড়ার দৃশ্য পর্যন্ত। কোটি মানুষের দোয়া-প্রার্থনা আর চিকিৎসকদের নিরলস চেষ্টার পরও চলে যায় সে। তার সাথে যেন হেরে গেল আঠারো কোটি মানুষ। যেমন ছিল গত আটদিনের সেই বেদনাবিধুর যাত্রা...
৬ মার্চ: অচেতন অবস্থায় উদ্ধার, ধর্ষণের অভিযোগ, আটক
৬ মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। কিছুদিন আগে বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ওইদিন রাতেই শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকায়। সন্ধ্যায় অচেতন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাখা হয় শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ)। অবস্থার আরও অবনতি হলে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
একইদিন ধর্ষণের অভিযোগে শিশুটির দুলাভাই ও দুলাভাইয়ের বাবাকে আটক করে পুলিশ।
৭ মার্চ: মৃত্যৃর গুজব, অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ, বিক্ষোভ
এরইমধ্যে খবর চাউর হয়- শিশুটি মারা গেছে। তবে মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিরাজুল ইসলাম জানান, শিশুটি বেঁচে আছে। নিয়মিত শিশুটির চিকিৎসার খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) রাখা হয়েছে। এখনও সে অচেতন অবস্থায় আছে।
এ ঘটনায় আটক শিশুটির দুলাভাই সজিব শেখ (১৮) ও তার বাবা হিটু শেখকে (৪৭) জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। সজিবের কথায় বেশ অসংলগ্নতা পাওয়া গেছে বলে জানায়।
এদিকে ধর্ষণের অভিযোগ ছড়িয়ে পড়লে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন মুসল্লিরা। শুক্রবার জুমার নামাজের পর মাগুরা শহরের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ করেন তারা। এ সময় তারা সদর থানা ঘেরাও করে।
৮ মার্চ: মামলা, আসামি গ্রেপ্তার, চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড
শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে তিন দিন পর সদর থানায় চারজনের নামে মামলা দায়ের করে শিশুটির মা। মামলার ৪ আসামি আগেই হেফাজতে ছিলেন। মামলার পর তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তারা হলেন- শিশুটির ভগ্নিপতি সজিব (১৮), সজীবের ভাই রাতুল (১৭), তাদের বাবা হিটু মিয়া (৪২) ও মা জাবেদা বেগম (৪০)।
ওইদিন শিশুটির চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। চিকিৎসার জন্য পেডিয়াট্রিক, পেডিয়াট্রিক সার্জারি, অ্যানেসথেসিয়া ও গাইনি ডিপার্টমেন্ট মিলে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। চিকিৎকরা জানান, শিশুটির অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তার গলার আঘাত খুবই মারাত্মক। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন।
৯ মার্চ: কৃত্রিম যন্ত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস, সিএমএইচে স্থানান্তর, দেখতে যান স্বরাষ্ট্র ও সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা
তিন দিনেও জ্ঞান না ফেরায় লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। কৃত্রিম যন্ত্রের সাহায্যে চালিয়ে নেওয়া হয় শ্বাস-প্রশ্বাস। সংকটাপন্ন অবস্থায় শিশুটিকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)।
সকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী শিশুটিকে দেখতে সিএমএইচে যান। খোঁজখবর নিয়ে তার সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন তিনি। দোষীরা কোনোভাবেই ছাড় পাবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন উপদেষ্টা। ওইদিন দুপুরে ধর্ষণের শিকার শিশুটিকে হাসপাতালে দেখতে যান সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদও।
একইদিন ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের প্রকাশ্যে ফাঁসির দাবিতে আদালত চত্বরে বিক্ষোভ করেন মাগুরা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা ও সাধারণ জনতা।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। তবে আসামিদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থাকায় আদালতে হাজির করতে পারেনি তারা। এ কারণে রিমান্ড শুনানিও হয়নি। পুলিশ জানায়, আদালতের মূল ফটকে বিক্ষোভকারীরা অবরোধ করে রাখায় আসামিদের আদালতে হাজির করার ঝুঁকি নেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
১০ মার্চ: চার দিনেও জ্ঞান ফেরেনি, শিশুটির ছবি-ভিডিও অপসারণে হাইকোর্টের নির্দেশ
১০ মার্চ পর্যন্ত চার দিনেও জ্ঞান ফেরেনি। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় আট সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) কর্তৃপক্ষ। সিএমএইচের চিকিৎসকরা জানান, বুকে প্রচণ্ড চাপ দেওয়ায় শিশুটির ফুসফুসের বিভিন্ন জায়গায় বাতাস জমে গেছে। অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে তার মস্তিষ্কেও ক্ষতি হয়েছে।
হাইকোর্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম, অনলাইন পোর্টালসহ যেসব জায়গায় শিশুটির ছবি ও ভিডিও ছড়িয়েছে, তা অপসারণের নির্দেশ দেন। যেসব মাধ্যমে শিশুটির ছবি প্রকাশ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও তিন দিনের মধ্যে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বিটিআরসি, পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং ডিএমপি কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ১৩ মার্চের মধ্যে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন হাইকোর্ট।
১১ ও ১২ মার্চ: অবস্থা আরও অবনতির দিকে
আগেরদিন চোখের পাতা খোলার সংবাদ পাওয়া গেলেও পরের দুইদিন ফের অবনতির দিকে যেতে শুরু করে শিশুটির শারীরিক অবস্থা। জীবিত ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেন চিকিৎকরা। সারাদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ছাত্র-জনতা। দাবি জানান, ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির।
১৩ মার্চ: শেষ বিদায়, জানাজা ও দাফন
দীর্ঘ আটদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আট বছর বয়সী শিশুটি। হাসপাতালের শিশুরোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা চলছিল তার। বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারবার ও বৃহস্পতিবার আরও দু‘বার ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় শিশুটির।
পরে শিশুটির মরদেহ রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে হেলিকপ্টারে গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। মরদেহ মাগুরা পৌঁছানোর পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শহরের নোমানী ময়দানে প্রথম জানাজা হয়। এতে অংশ নেয় হাজারো মানুষ। পরে মরদেহ গ্রামে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তের বাড়িতে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। রাত পৌনে ৮টার দিকে বাড়িটিতে আগুন দেওয়া হয়। স্থানীয়রা জানায়, জানাজার নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই আসামিদের বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয় লোকজন। রাত সোয়া ৮টার সময় এই প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত ওই বাড়িতে আগুন জ্বলছিল। কাউকে সেখানে আগুন নেভাতে দেখা যায়নি।