স্ত্রীর পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত মঞ্জুর এলাহী
Published: 13th, March 2025 GMT
বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা, এপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী রাজধানীর বনানী কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তাঁর সহধর্মিণী নিলুফার মঞ্জুরের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। দাফন কাজে অংশ নেন আত্মীয়স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। এ সময় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি এ.
মঞ্জুর এলাহীর ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর তাঁর বাবাকে কবরে শায়িত করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘বাবা এই দেশকে বেশি ভালোবাসতেন। তাঁর শেষ কথাগুলোর মধ্যে একটি ছিল– সবার আগে দেশ, তারপর সবকিছু। তিনি কখনও কোনো পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়ার পক্ষে ছিলেন না। বাবা যদি কারও মনে কষ্ট দিয়ে থাকেন, তাহলে তাঁকে ক্ষমা করে দেবেন।’ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘বাবা নিজেকে কখনও ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতে চাইতেন না। মানুষের জন্য কাজ করতে চাইতেন; মানুষের সঙ্গে থাকতে চাইতেন।’ বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যেন তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করতে পারি।’
এর আগে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে তাঁর প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এর পর তাঁকে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে বেসরকারি ব্যাংক এবং এপেক্স গ্রুপের কর্মীরা শ্রদ্ধা ও বিদায় জানান। পরে জোহরের নামাজের পর দ্বিতীয় জানাজার জন্য তাঁকে ঢাকার গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদে (আজাদ মসজিদ) নেওয়া হয়।
এপেক্স ফুটওয়্যারের এক কর্মকর্তা জানান, মঞ্জুর এলাহীর মরদেহ সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় আনা হয় বুধবার রাত ১০টা ২০ মিনিটে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাঁকে তাঁর বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়।
বুধবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৭টায় সিঙ্গাপুরের গ্লেনিগলস হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মঞ্জুর এলাহী। তিনি বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। মঞ্জুর এলাহী ছিলেন দূরদর্শী শিল্পোদ্যোক্তা। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশে উৎপাদিত চামড়ার জুতা রপ্তানি শুরু হয়। এপেক্স ফুটওয়্যারের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি এপেক্সকে দেশের বৃহত্তম জুতা রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করেন।
এর পর এপেক্স ট্যানারি, পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্স ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের নেতৃত্ব দিয়ে দেশীয় শিল্পের অগ্রযাত্রাকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যান। তিনি এপেক্স এন্টারপ্রাইজ, গ্রে অ্যাডভার্টাইজিং বাংলাদেশ, ব্লু ওশান ফুটওয়্যার এবং কোয়ান্টাম কনজিউমার সলিউশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এপেক্স ফার্মা, এপেক্স ইনভেস্টমেন্ট, সানবিমস স্কুল, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এবং ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’-এর সভাপতিত্ব করেন।
ব্যবসার পাশাপাশি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেছিলেন মঞ্জুর এলাহী। তিনি ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দৃঢ়তার সঙ্গে সরকার পরিচালনায় অংশ নেন। তিনি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব পাবলিকলি লিস্টেড কোম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে তাঁর অবদান বিস্তৃত ছিল। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে তিনি জাতীয় অর্থনৈতিক নীতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ব্যবসায়িক জগতে সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছেন এই কিংবদন্তি শিল্পপতি। অ্যামচ্যাম কর্তৃক ‘বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দ্য ইয়ার ২০০০’, দ্য ডেইলি স্টার এবং ডিএইচএল কর্তৃক ‘বিজনেস পারসন অব দ্য ইয়ার ২০০২’ এবং ২০২৩ সালে ২১তম ডিএইচএল-ডেইলি স্টার বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ডে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ধোঁয়ার ঝুঁকিতে শিশুস্বাস্থ্য
বাইরে ও ঘরের ভেতর উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের বায়ুর মান আশঙ্কাজনক। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৪’-এ জানা যায়, ২০২৪ সালে দেশ হিসেবে বায়ুদূষণে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ এবং নগর হিসেবে ঢাকা ছিল বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ দূষিত। গত বছর বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি ছিল ৭৮ মাইক্রোগ্রাম। যদিও এটা ২০২৩ সালের তুলনায় অল্প কমেছে, তাও এ পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দিষ্ট মানদণ্ডের চেয়ে কমপক্ষে ১৫ গুণ।
যেখানে বিশুদ্ধ বাতাস শিশুর বেড়ে ওঠা ও বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের শিশুরা দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে তারা।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল-ইউনিসেফ ও হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউটের (এইচইআই) যৌথভাবে প্রকাশিত ‘স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন রোগে ২০২১ সালে ৫ বছরের কম বয়সী ১৯ হাজারের বেশি শিশুর মৃত্যু হয়।
বায়ুদূষণের কারণে বাতাসের মান হ্রাস পায়, যার ক্ষতিকর প্রভাব বেশি পড়ে শিশুদের ওপর। তারা হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয়। শিশুরা গর্ভাবস্থা থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বায়ুদূষণ তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ ঝুঁকি তৈরি করে।
জন্মের পর বেড়ে ওঠার প্রতিটি পর্যায়ে বায়ুদূষণে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয় শিশুস্বাস্থ্যে। তাদের শরীর ও মস্তিষ্ক ধারাবাহিক বিকাশের মধ্য দিয়ে যায়। তারা প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে দ্রুত শ্বাস নেয় এবং তা কখনও কখনও শরীরের তুলনায় বেশি। অনেক শিশু মুখ দিয়েও শ্বাস নেয়, বায়ুদূষিত হলে যা আরও বেশি ক্ষতির কারণ। দূষিত বায়ুতে ভারী ধাতুর উপস্থিতির কারণে এর ঘনত্ব (যেমন ধুলা ও ধোঁয়া) বেশি থাকে। এ ছাড়া নবজাতকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। ফলে তারা পরিবেশদূষণের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। দূষিত অতি ক্ষুদ্রকণা তাদের শ্বাসযন্ত্র দিয়ে প্রবেশ করে সহজেই রক্তের সঙ্গে মিশে যায়।
বাইরের দূষিত বাতাস ছাড়াও ঘরের মধ্যেও অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের দূষিত বাতাসে থাকতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম কয়েলের ধোঁয়া। ঘর মশামুক্ত রাখতে অনেকে সারারাত বদ্ধ কক্ষে কয়েল জ্বালিয়ে রাখেন, যা শিশুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। পাশাপাশি শিশুদের আশপাশে ধূমপান করলে সে ধোঁয়াও নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেওয়া শিশুদের ব্রঙ্কাইটিস, হাঁপানিসহ তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। পাশাপাশি তাদের ফুসফুসের সক্ষমতা ২০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। বায়ুদূষণ ও ধোঁয়ার সঙ্গে নিউমোনিয়ার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ নিউমোনিয়া।
মশার কয়েলে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা এবং ত্বকের জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মশার কয়েলের ধোঁয়া দীর্ঘ সময় বা উচ্চমাত্রায় গ্রহণ করলে এ সমস্যাগুলো আরও গুরুতর হতে পারে। দেশের দীর্ঘস্থায়ী বায়ুদূষণ সমস্যা এবং যানবাহনের ধোঁয়া নবজাতকদের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এর পাশাপাশি মশার কয়েলের ধোঁয়া আরেকটি বিপদ হিসেবে তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশে নবজাতকদের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। যে কোনো শিশু চিকিৎসকের চেম্বারে গেলে দেখা যায়, ১-১২ মাস বয়সী শিশুরা প্রায়ই বিভিন্ন নাসাপ্রদাহের সমস্যায় ভুগছে। এর প্রধান কারণ হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা দূষিত বাতাস গ্রহণ করছে, যা মশার কয়েলের ধোঁয়া এবং অন্যান্য উৎস থেকে নির্গত ক্ষতিকারক কণায় ভরপুর। বায়ুদূষণের ফলে শিশুদের মধ্যে কম জন্ম-ওজন, হাঁপানি, ফুসফুসের কার্যকারিতা হ্রাস, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ ও অ্যালার্জির ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। তাই এসব ব্যাপারে মা-বাবা ও অভিভাবকদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি শিশুর সুরক্ষায় প্রশাসনকেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
মোহাম্মদ জাকারিয়া: কমিউনিকেশন প্রফেশনাল