বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের নির্ধারিত সময়সীমা পিছিয়ে দেওয়ার ভাবনা থেকে সরে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্ধারিত লক্ষ্য অনুযায়ী আগামী বছরই উত্তরণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

তিনি জানান, উত্তরণের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো আসবে, তা মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এতে বাংলাদেশের মর্যাদা আরও বাড়বে।
উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার দিন নির্ধারিত ছিল ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর। বিষয়টি আরও পিছিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার। গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টার নতুন বিশেষ সহকারী (অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে) আনিসুজ্জামান চৌধুরী এক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে উত্তরণের আবেদন করা হয়েছিল। এ বিষয়ে কাজ করতে হবে। ২০১০ সাল থেকে বৈদেশিক নির্ভরতা বেড়ে গেছে। কমে গেছে অভ্যন্তরীণ আয়ের উৎস। ৭ শতাংশের নিচে নেমে গেছে কর-জিডিপির হার। যদি আরও ঋণ নিতে হয়, চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে।
তিনি আরও জানান, অর্থনীতির অবস্থা ভঙ্গুর। প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়ার নেতৃত্বে কমিটি করা হয়েছে। পুনর্বিবেচনার পর উত্তরণ পিছিয়ে দিতে জাতিসংঘে আবেদন করা হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়বে রপ্তানি খাত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পায় বাংলাদেশ। নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় এই শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত।
বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধ শিল্প। আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দেয় না বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো।
 ২০৩৩ সালের আগে কোনো দেশ এলডিসি থেকে বের হয়ে গেলে এই সুবিধা পাবে না।

উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে বাংলাদেশ। পরে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ নেওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে। জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বাড়বে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশ থেকে শিক্ষার্থী বৃত্তি কমবে।
তবে উত্তরণ হলে দেশের মর্যাদা বাড়ে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হয়। বিদেশি বিনিয়োগকারী আস্থা রাখেন। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে অনেক ঋণ নেওয়া যায়। সমৃদ্ধি বিবেচনা করা হয় দেশটি কোন শ্রেণিতে আছে, এর ওপর।
অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রতিবেদন তৈরি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ প্রতিবেদনে ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের পক্ষে সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও উত্তরণের পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক। যেসব সূচকের ওপর ভিত্তি করে উত্তরণ হয়, তা বেশ সুসংহত। কিন্তু অর্থনীতির কিছু সূচক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে, সেগুলো উত্তরণ সূচকের সঙ্গে কম সম্পৃক্ত।

মডেল মসজিদ প্রকল্পে দুর্নীতি
প্রেস সচিব বলেন, ৫৬০টি মডেল মসজিদ তৈরি করা হয়েছিল। এতে প্রায় ১০০ কোটি ডলার খরচ হয়েছে। দুর্নীতি হয়েছে। অভিযোগ তদন্ত করতে ধর্ম মন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করেছে।
প্রেস সচিব বলেন, ‘এই মসজিদের অনেক অনিয়মের কথা উঠে এসেছে। দেখা গেছে, আট কিলোমিটার দূরে একটা রিসোর্ট করছেন, সেখানে মডেল মসজিদ করেছেন মন্ত্রী। একটা মসজিদের ব্যয় ১৭ কোটি টাকা। দুর্নীতি না হলে অর্ধেক খরচে করা যেত। আরেকটি বিষয় শোনা যেত যে সৌদি আরবের অর্থায়নে এসব মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। আসলে পুরোটা জনগণের টাকা।’

বিএসএমএমইউর নাম বিএমইউ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’ (বিএমইউ) করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর খসড়া অধ্যাদেশের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
বৈঠকে খুলনার শেখ হাসিনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেটের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ দুটির নাম হচ্ছে খুলনা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এক দিনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যুব দিবস
প্রতিবছর ১ নভেম্বর জাতীয় যুব দিবস উদযাপন করা হয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তে প্রতিবছর ১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস উদযাপন করা হয়। উভয় দিবসে গৃহীত কার্যক্রম প্রায় সমধর্মী। ব্যয় সাশ্রয়ের লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদ একসঙ্গে দিবস দুটি ১২ আগস্ট উদযাপন অনুমোদন করেছে।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ইউনেস্কোর মাধ্যমে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে নৌকা, জামদানি শাড়ি এবং টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করার উদ্যোগ নেবে।
শূন্য পদে নিয়োগে প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানান প্রেস সচিব। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে সরকারি দপ্তরে দ্রুত জনবল নিয়োগের কথা বলেছেন। এ বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব আগামী উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে জানাবেন কী সংখ্যক নিয়োগ হতে পারে।


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: মন ত র মসজ দ এলড স সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সবাই ভয়ে পালিয়েছে, ভারতের নন্দনগরে এক মুসলিম পরিবারের টিকে থাকার লড়াই

নন্দাকিনী নদীর তীরে রোজ সকাল আটটায় নিজের ড্রাই ক্লিনিংয়ের দোকানের বাদামি শাটার খুলে কাজ শুরু করেন আহমেদ হাসান। উত্তর ভারতের হিমালয় অঞ্চলের উত্তরাখন্ড রাজ্যের নন্দনগরে বংশপরম্পরায় বসবাস করে আসছেন তিনি।
সকালে দোকান খুলে নিত্যদিনের কাজ শুরু করেন হাসান। শুকনো পদ্ধতিতে পরিষ্কার (ড্রাই ক্লিনড) করা কাপড় নিজের দোকানের গোলাপি দেয়ালের প্লাস্টিক কভারে সুচারুভাবে ঝুলিয়ে রাখেন। এরপর ৪৯ বছর বয়সী এই ব্যক্তি গ্রাহকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মধ্যাহ্নভোজের আগে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন গ্রাহক হাসানের কাছে আসতেন। শেরওয়ানি, স্যুট, কোট, প্যান্ট এবং শীতকালীন পোশাক তাঁর কাছে পরিষ্কার করতে দিতেন। কোনো কোনো গ্রাহক তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতেন। চা খেতে খেতে রাজনীতি নিয়ে আলাপ ও মজা করতেন, হাসি–আনন্দ ও সুখ-দুঃখ বিনিময় করতেন। গ্রাহকদের বেশির ভাগ ছিলেন হিন্দু, অল্প কিছু ছিলেন মুসলিম।
কিন্তু ১২ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত পাঁচজনেরও কম হিন্দু গ্রাহক হাসানের দোকানে এসেছেন। তিনি জানান, কোনো মুসলিম গ্রাহকের আশায় থাকা বৃথা। এ সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে।

নন্দনগরে এখন হাসানই একমাত্র মুসলিম পুরুষ। অথচ এই শহরে কয়েক মাস আগেও ১৫টি মুসলিম পরিবার ছিল, যারা বংশপরম্পরায় এখানে বসবাস করে আসছিল। হাসানের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এখানেই। প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সুসম্পর্ক ছিল। পূজা-পার্বণে হিন্দুরা তাঁদের নিমন্ত্রণ করতেন। আর ঈদের সময় হিন্দু প্রতিবেশীদের তাঁরা দাওয়াত দিতেন। প্রতিবেশী হিন্দু মারা গেলে শবদাহের জন্য তিনি কাঠ সংগ্রহ করতেন, হিন্দু বন্ধুদের মরদেহ কাঁধে বহন করে শ্মশানে নিয়ে গেছেন।

কিন্তু গত সেপ্টেম্বরে এই এলাকায় মুসলিমবিরোধী সহিংসতা শুরুর পর এ সবকিছু রাতারাতি বদলে গেছে। এক হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এ সহিংসতা শুরু হয়েছিল। তবে নন্দনগরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে মন–মানসিকতায় আরও আগে থেকেই বড় পরিবর্তন সূচনা হয়েছিল, যা করোনাকাল থেকে খেয়াল করে আসছিলেন হাসান।

গত সেপ্টেম্বরে মুসলিমদের বিরুদ্ধে শারীরিক হামলার আগে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ঘৃণামূলক স্লোগান দেওয়া হতো। মুসলিমবিরোধী কিছু বিক্ষোভও হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় হিন্দু মেয়েকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তাঁদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রাণভয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা রাতের আঁধারে নন্দনগর ছেড়ে পালিয়ে যান।

হাসানও পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসেন। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ছোট্ট শহর আবার মুসলিমদের বসবাসের উপযোগী করার ব্যাপারে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, এটাই তাঁদের জন্মভূমি। কিন্তু হাসানের পরিবারকে সেখানে এখনো ভয়ে ভয়েই থাকতে হচ্ছে।

হিন্দু প্রতিবেশীরা এখন হাসানের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন না। আগে তিনি সন্ধ্যায় নিয়মিত নন্দাকিনী নদীর তীরে হাঁটতে গেলেও এখন যান না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের কারও সঙ্গে দেখা করতে দেন না। তাঁর আশঙ্কা, আবারও সহিংসতা দেখা দিতে পারে।

হাসান বলেন, ‘আমি সোজা দোকানে যাই, দোকান থেকে বাসায় আসি। সারাটি জীবন এই শহরে কাটালেও নিজেকে আমার এখন ভূত বলে মনে হয়। আমি যেন সম্পূর্ণ অদৃশ্য। এমনকি কেউ আমার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলছেন না।’

‘মুসলিমদের জুতা দিয়ে পেটাও’

রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে গাড়িতে করে নন্দনগর যেতে সময় লাগে প্রায় ১০ ঘণ্টা। ভারত-চীন সীমান্তের কাছাকাছি স্থানের এই শহরটি নন্দাকিনীর কয়েকটি উপনদীর সংগমস্থলে অবস্থিত। গঙ্গার ছয়টি উপনদীর একটি হলো নন্দাকিনী, যাকে হিন্দুরা পবিত্র বলে বিশ্বাস করেন। শহরটি জনসংখ্যা প্রায় দুই হাজার।

হাসানের দাদা পার্শ্ববর্তী উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বিজনৌর জেলার নাজিবাবাদ শহর থেকে ১৯৭৫ সালে নন্দনগরে এসেছিলেন। তাঁদের পরিবার সেখানেই বসতি গড়ে। পরের বছর হাসানের জন্ম হয়।

এক মুসলমান নরসুন্দরের যৌন হয়রানির অভিযোগের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ মিছিলে হাসান ও নন্দনগরের অন্য মুসলমানরাও অংশ নিয়েছিলেন

সম্পর্কিত নিবন্ধ