মিলিকে আমার ভালো লাগে। আমি লেখাটার নাম দিতে চেয়েছিলাম ‘আমি মিলি ও রিজু আপা’ কিংবা ‘আমরা ও অক্সিজেন’। এখন বদলে নামটাকে করলাম ‘ঈশ্বরের গিনিপিগ’।
রিজিয়া বেগমকে আমরা রিজু আপা বলে ডাকতাম। চমৎকার মিষ্টি একজন। মাঝে মাঝে ফোনে অনেক কথা হতো। রিজু আপার বড় গুণ তিনি কখনও কাউকে উপদেশ দেন না, কথার ভেতরে কথা বলেন না, কেবল শোনেন। এবং শ্রোতা হিসেবে তিনি তুলনাহীন। একজনকে ভালো বন্ধু হতে গেলে তাঁর প্রধান গুণ– বড় শান্ত হয়ে, মন দিয়ে যে বলছে তার কথা শোনা। কীভাবে আমার সঙ্গে ভাব হয়েছিল? একবার তিনি লন্ডনের এক খবরের কাগজে আমার একটি লেখা পড়েছিলেন এবং এরপর আমাকে ফোন করেছিলেন। ফোন নম্বর সংগ্রহ করেছিলেন কাগজের অফিস থেকে। সেই যে কথা হলো এরপর কথা বলার মতো কিছু জমা হলেই রিজু আপাকে ফোন করতাম। তার সবিশেষ অনুরোধে একদিন তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তাঁর স্বামী মুনীর হোসেন তখন অবসর নিয়েছেন এবং রিজু আপাও। মিলিও এসেছিল। দারুণ আড্ডা তখন। হঠাৎ আমার চোখ পড়েছিল দেয়ালে। একটা অপূর্ব মেয়ের ছবি। যেন কোনো বিদেশি শিল্পীর আঁকা ছবি।
–ছবিটি কার রিজু আপা? নিশ্চয় কোনো বিদেশি মেয়ের?
মিলি তাকিয়েছিল আমার মুখের দিকে। ওর সেই দৃষ্টি বলছিল– এমন একটা প্রশ্ন না করলেই ভালো ছিল। ধনুকের ছিলা আর মুখের কথা একবার বেরোলে ফেরায় কে?
ও জেবা! আমার মেয়ে।
রিজু আপা বেশ একটু পরে উত্তর দিয়েছিলেন।
–কোথায় ও? এমন চমৎকার অল্পবয়স্ক একটি মেয়ে এখানেই কোথায় থাকবে এমনি ভেবেছিলাম। রিজু আপা বলেছিলেন– ও মারা গেছে। দশ বছর আগে। ক্যান্সারে।
ভীষণ খারাপ লেগেছিল এমন একটি উত্তরে। সরি ছাড়া আর কিই-বা বলতে পারি তখন।
ঠিক আছে। এ প্রশ্নের উত্তর আমাকে অনেকবার দিতে হয়েছে।
এমন অপূর্ব একটি মেয়ে ওদের ফেলে সাততাড়াতাড়ি চলে গেছে এমন ভাবতেও কষ্ট।
এরপর আরও কিছু সময় থেকে আমি আর মিলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে যার বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলাম। মিলি বলেছিল– মেয়েটি একটি বিদেশি ছেলেকে বিয়ে করেছিল। তবে সে বিয়ে সুখের হয়নি। ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। একা থাকত নিজের বাড়িতে। বাড়িতে ফিরে আসেনি। অভিমানে। কারণ, বাবা-মা এ বিয়ে মেনে নেয়নি। তখন আমি ভাবছিলাম রিজু আপার সহাস্য উজ্জ্বল মুখ। আমার সেই প্রশ্ন করার আগের ও পরের মুখ। মনে মনে ভাবছিলাম আমাদের ঈশ্বর কখনও বড় নিষ্ঠুর। মিলি বলেছিল– ভাবা যায়, এমন একটা অপূর্ব প্রাণবন্ত মেয়ে এভাবে চলে যাবে!
রিজু আপার আর কি কোনো ছেলেপুলে নেই?
একটি ছেলে আছে। বলেছিল মিলি। বলেছিল আপার ছেলের নানা ধরনের গুণের কথা।
ও। খুশি হয়েছিলাম। একজন আছে। হৃদয় জুড়ানো একজন।
কথা হয় মাঝে মাঝেই। বেশির ভাগ লেখালেখি আর গল্প নিয়ে। রিজু আপা একজন অমনিভর। পড়তে ভালোবাসেন। যত মোটা বই ততই তার আনন্দ। পৃথিবীর অনেকের বই পড়েছেন। এ দেশে আসার পরে পড়াশোনাও করেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করেছেন। তাঁর সাহিত্যের জ্ঞান অগাধ। আর যেখানে সাহিত্য, সেখানেই আমি। কাজেই লন্ডনে রিজু আপার সঙ্গে কথা বলা আমার একটি ভালো লাগা কাজ হয়ে গেল।
এভাবেই চলছিল। মাঝে মাঝে মিলির বাড়ির গেট টুগেদার। এর-ওর সঙ্গে দেখা হওয়া। সেখানেই শুনলাম– রিজু আপার ছেলে রাতুলের ক্যান্সার হয়েছে। বোধকরি শেষ স্টেজ। আমি বেদনার্ত বিমূঢ়। রাতুলের একটি ছেলে এবং লক্ষ্মী এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। মেয়েটি গেল ক্যান্সারে এবার এই কর্কট রোগ ছেলেকে ধরেছে? সারাক্ষণ যে সংসারে হরিয়ালি গান করে। আহা সেখানে এমন খবর। কী ভয়ানক ঘটনা। রিজু আপা যে সময় হয়তো মেয়ের মৃত্যু খবর নিয়ে খানিকটা সহজ হয়েছেন। ঈশ্বর আবার কী করলেন। আবার আর একটি এমন ভয়াবহ খবর। আমি তখন রিজু আপাকে ফোন করতে সাহস পাইনি। মিলির কাছে সব খবর পেতাম। রিজু আপার ছেলে লেখালেখি করে। কতগুলো বই লিখেছে। আরও নানা কথা।
মেয়ের মৃত্যুর দশ বছর চলে গেছে। হৃদয়ের ভেতরে দগদগে ক্ষততে একটু হয়তো প্রলেপ পড়েছে। এখন আবার এই খবরের রক্তক্ষরণ। মিলি ও আমি অনেক সময় ফোনের ওপারে নিঃশব্দ ছিলাম। একটা ক্ষততে প্রলেপ পড়তে না পড়তে আর একটি। একদিন কিছু খাবার নিয়ে, মানে রোগীরা যেমন খায়, রিজু আপার বাসায় গিয়েছিলাম। ছেলে তখন সেখানে। ভালো লেগেছিল আমার খাবারের প্যাকেট থেকে একটি বিস্কটু নিয়ে খেয়েছিল সেই ছেলে রাতুল। তারপর একদিন কা কা রবে যখন একটা কাক ডাকছে, ছেলেটা চলে গেল। কিছুদিন পরে গিয়েছিলাম রিজু আপাকে দেখতে। খুবই স্বাভাবিক হবার চেষ্টা। এর পরেও ধরা পড়ে। বেদনা গোপন করার প্রবল প্রয়াস। সেই ঘটনা বড়ই মর্মান্তিক। তবু জানা যায় হৃদয়ের ক্ষরণের কথা।
এরপর পাঁচ বছর চলে গেল। মিলি খবর দিল– রিজু আপার স্বামী মানে মুনীর হোসেনের প্রস্টেট ক্যান্সার হয়েছে। তাহলে কর্কট রোগ যাবে না। কেবল অপেক্ষায় থাকবে কাকে গ্রাস করা যায়। এ খবরে কী বলব। জানি, আমরা সকলেই ঈশ্বরের হাতের পুতুল। খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে। তার পরেও। তাহলে রিজু আপাকে আল্লাহ কি কেবল কষ্ট সহ্য করার গিনিপিগ বানিয়েছে। কিন্তু কেন। অপরাধ কী তার। আর একদিন দুপুরে যখন বাড়ির কাছের বড় অর্জুন গাছটায় একপাল কাক এসে চিৎকার করছিল, মুনীর ভাই বিদায় নিলেন। কানে কানে রিজু আপাকে বললেন– টাকাপয়সার কষ্ট হবে না। সব তোমার।
একদিন রিজু আপাকে দেখলাম। সাদা চোখ। কোনো বিলাপ বা বিকার নেই। মনে হলো প্রাণভরে কাঁদছেন না কেন। রিজু আপার মুখ তখন একটু কঠিন। কিন্তু আমাদের দেখে ধুলোয় পড়ে আকুল হয়ে কাঁদেন না বা আমাদের জড়িয়ে ধরে। এ এমন এক ধরনের মুখ, ঠিক বোঝা যায় না– কী হয় সেখানে। এ হলো পশ্চিমের বেদনা গোপন করার দুর্নিবার প্রয়াস।
ফিরতি পথে দুজনে এসে বসলাম একটা গাছের নিচে। বলি– বলো তো মিলি, আল্লাহ তাকে নিয়ে এমন খেলছেন কেন? মিলি বলল, কে জানে। তারপর এক এক করে হিসাব দিল দেশে মিলির কতজন চলে গেছে। আমিও দিলাম। আমার কতজন চলে গেছে। বললাম– মা, বাবা, দুই বোন, এক ভাই। দুই দুলাভাই। এ ছাড়া আমার শ্বশুরবাড়ির অনেকে। মিলিও বলল ওর কে কে গেছে। বলল– তার পরেও আমরা পড়ে আছি। পড়ে থাকি। আমরা আসলে ঈশ্বরের গিনিপিগ।
আমার একটি ‘মেডো’ আছে। ঘাস ফুলগাছে ছাওয়া খোলা জমি। তাকিয়ে দেখি আমার যে গাছগুলোয় নতুন পাতা, গরমের রেশ। পাতা সব সবুজ হয়ে উঠছে। বললাম– জানো তো মিলি– এই মেডো ছিল তাই হয়তো আজও বেঁচে আছি। মিলি বলে– আমার বাড়ির কাছের পার্কটায় আমার অনেক ঋণ। প্রকৃতি আসলে মস্ত বড় হিলার। নিরাময়ী পাতারা আর ফুলেরা। কী হবে গাছেরা যদি সব চলে যায়?
এরপর আমি যখন একা হয়ে যাই এই মেডোতে বসে ভাবি নানা কথা। আমি একা আমি আর মেডো। কী জানি কোন কোন কবিতা মনে পড়ছিল তখন। অনেক কথা ভাবছিলাম আমার পঞ্চাশ বছরের সঙ্গী চলে গেল যখন।
মিলি সেদিন এসে আমাকে নিয়ে গেল মেডোতে। ছলছল চোখ। বলি– কী হলো ও মিলি। বলে ও– রিজু আপাকে দেখে ফিরে আসছি।
কোথায় উনি?
একটা হাসপাতালে। কাউকে তেমন চিনতে পারেন না। আমাকে বলছিলেন নানা কথা। সবই আবোল-তাবোল। বয়সটা তাঁর নব্বইয়ের কাছাকাছি। তাঁর সঙ্গী চলে যাবার পর চলে গেছে অনেক বছর। এখন তিনি নব্বইতে পা রেখেছেন। –কী সব আবোল-তাবোল বলেন, সব কিছু বোঝা যায় না। মিলি বলে।
কেমন আবোল-তাবোল? বলছিলেন এমন সব কথা, যা তিনি কখনও বলেননি– পোড়াবে না, কবর দেবে। ছেলে, মেয়ে আর মুনীরের মাখখানে। আমি ওদের মধ্যে থাকতে চাই। আমার জেবা আর আমার রাতুলের মাখখানে। আর আমাদের মাথার কাছে থাকবেন মুনীর। বেশ হবে। তারপর এই সবই কেবল। অন্য কোনো কথা নয়। ভাবা যায়?
না ভাবা যায় না। অভেজা চোখ আর কঠিন মুখের একজন। হৃদয়ের কথা না বলার সে দুর্নিবার চেষ্টা। পশ্চিমের নিয়মরীতি।
রিজু আপা যাবেন। আমরাও একদিন। মেডোটা ছিল বলেই কি এতদিন আমি বেঁচে আছি? কে বলবে।
রিজু আপা বাড়িতে ফিরে এসেছেন। হাসপাতাল তাঁকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। তাঁর এখন আমাদের চেনার কথা নয়। তিনি কাউকে ঠিকমতো চিনতে পারেন না। দুইজন কেয়ারটেকার তাঁকে দেখে। তিনি শুয়ে থাকেন দিনরাত। এক এক করে সবাই চলে গেছে। তিনি অপেক্ষায়। তিনি না আমরা? বই পড়া ছিল তাঁর সবচাইতে আনন্দ। এখন আর তা পড়েন না। ধুকপুক হৃদয় কেবল জানান দেয় তিনি বেঁচে। ঈশ্বরের কী ইচ্ছে– কে বলবে। কর্কট তাঁকে ছোঁয়নি। তাতেই কি সব রক্ষা পেয়েছে! হয়তো অনেক আগেই চলে যেতে পারতেন না ফেরার দেশে। যাননি। হায়াত তাঁকে ধরে রেখেছে। ঈশ্বরের গিনিপিগ আমরা সকলেই।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এমন এক আম দ র কর ছ ল বল ছ ল র একট একদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন অভিনেত্রী গুলশান আরা, দাফন হবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়
নাটক ও সিনেমার পরিচিত মুখ অভিনেত্রী গুলশান আরা আহমেদ মারা গেছেন। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে মৃত্যু হয়েছে তার।
তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছন পরিচালক এম রাহিম। তিনি জানান, শ্রদ্ধেয় শুলশান আরা আহমেদ আজ আজ সকালে ইন্তেকাল করেছেন। জংলি আপনার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। আপনি আজীবন আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে থাকবেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্ট দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পরিচালক কাজল আরেফিন অমি। পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমাদের গুলশান আরা আহমেদ আপা আপা আজ সকাল ৬:৪০-এ ইন্তেকাল করেছেন।’
অমি আরও লিখেছেন, ‘ব্যাচেলর পয়েন্টে উনি কাবিলার আম্মা, নোয়াখালীর চেয়ারম্যান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আপনাকে আমরা মিস করবো আপা। আল্লাহ পাক ওনাকে জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে, জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুক। আমিন।’
জানা গেছে, হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন অভিনেত্রী। দ্রুতই লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। গুলশান আরা আহমেদের ফেসবুক আইডি থেকে মাঝরাতে লেখা হয়, ‘আমার আম্মু গুলশান আরা আহমেদ আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে আছেন, হার্ট অ্যাটাক এবং হার্ট ফেইলিউরের জন্য। আপনার সবাই আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।’
পরে শোনা যায় মৃত্যুর খবর, অর্থাৎ লাইফ সাপোর্ট থেকে আর ফেরানো যায়নি তাকে। ভোরে তাঁর মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিনেত্রীকে দাফন করা হবে। অভিনেত্রীর বোনের ছেলে অভিনেতা আর এ রাহুল জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন অভিনেত্রী। তার লাশ দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
গুলশান আরা ২০০২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একজন তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে টিভি নাটকে যাত্রা শুরু করেন। তবে নিজেকে একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। সেই ইচ্ছা থেকেই গুলশান আরা প্রথম অভিনয় করেন প্রয়াত এনায়েত করিম পরিচালিত ‘কদম আলী মাস্তান’ চলচ্চিত্রে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দর্শকদের উপহার দিয়েছেন ‘চরিত্র’, ‘ডনগিরি’, ‘ভালোবাসা আজকাল’, ‘পোড়ামন’ এর মতো জনপ্রিয় সব ছবি।