আটদিনের লড়াইয়ে সঙ্গী ছিল পুরো দেশ, চোখের জলে বিদায়
Published: 13th, March 2025 GMT
আট দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই, শিশুটির এই লড়াইয়ের সঙ্গী ছিল পুরো দেশ। তার যন্ত্রণা দাগ কেটেছে গণমাধ্যমকর্মীদের হৃদয়েও। নিউজরুমে অগ্রাধিকার পেয়েছে শিশুটির স্বাস্থ্যের হালনাগাদ খবর। গুরুত্ব দিয়ে কভার করা হয়েছে শিশুটির চোখের পাতা নড়ার দৃশ্য পর্যন্ত। কোটি মানুষের দোয়া-প্রার্থনা আর চিকিৎসকদের নিরলস চেষ্টার পরও চলে যায় সে। তার সাথে যেন হেরে গেল আঠারো কোটি মানুষ। যেমন ছিল গত আটদিনের সেই বেদনাবিধুর যাত্রা.
৬ মার্চ: অচেতন অবস্থায় উদ্ধার, ধর্ষণের অভিযোগ, আটক
৬ মার্চ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। কিছুদিন আগে বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে ওইদিন রাতেই শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে মাগুরা ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকায়। সন্ধ্যায় অচেতন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাখা হয় শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ)। অবস্থার আরও অবনতি হলে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
একইদিন ধর্ষণের অভিযোগে শিশুটির দুলাভাই ও দুলাভাইয়ের বাবাকে আটক করে পুলিশ।
৭ মার্চ: মৃত্যৃর গুজব, অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদ, বিক্ষোভ
এরইমধ্যে খবর চাউর হয়- শিশুটি মারা গেছে। তবে মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিরাজুল ইসলাম জানান, শিশুটি বেঁচে আছে। নিয়মিত শিশুটির চিকিৎসার খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশুদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) রাখা হয়েছে। এখনও সে অচেতন অবস্থায় আছে।
এ ঘটনায় আটক শিশুটির দুলাভাই সজিব শেখ (১৮) ও তার বাবা হিটু শেখকে (৪৭) জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। সজিবের কথায় বেশ অসংলগ্নতা পাওয়া গেছে বলে জানায়।
এদিকে ধর্ষণের অভিযোগ ছড়িয়ে পড়লে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন মুসল্লিরা। শুক্রবার জুমার নামাজের পর মাগুরা শহরের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ করেন তারা। এ সময় তারা সদর থানা ঘেরাও করে।
৮ মার্চ: মামলা, আসামি গ্রেপ্তার, চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড
শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে তিন দিন পর সদর থানায় চারজনের নামে মামলা দায়ের করে শিশুটির মা। মামলার ৪ আসামি আগেই হেফাজতে ছিলেন। মামলার পর তাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তারা হলেন- শিশুটির ভগ্নিপতি সজিব (১৮), সজীবের ভাই রাতুল (১৭), তাদের বাবা হিটু মিয়া (৪২) ও মা জাবেদা বেগম (৪০)।
ওইদিন শিশুটির চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। চিকিৎসার জন্য পেডিয়াট্রিক, পেডিয়াট্রিক সার্জারি, অ্যানেসথেসিয়া ও গাইনি ডিপার্টমেন্ট মিলে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। চিকিৎকরা জানান, শিশুটির অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। তার গলার আঘাত খুবই মারাত্মক। শুক্রবার রাত ৯টার দিকে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকরা আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন।
৯ মার্চ: কৃত্রিম যন্ত্রে শ্বাস-প্রশ্বাস, সিএমএইচে স্থানান্তর, দেখতে যান স্বরাষ্ট্র ও সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা
তিন দিনেও জ্ঞান না ফেরায় লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়। কৃত্রিম যন্ত্রের সাহায্যে চালিয়ে নেওয়া হয় শ্বাস-প্রশ্বাস। সংকটাপন্ন অবস্থায় শিশুটিকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)।
সকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী শিশুটিকে দেখতে সিএমএইচে যান। খোঁজখবর নিয়ে তার সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন তিনি। দোষীরা কোনোভাবেই ছাড় পাবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন উপদেষ্টা। ওইদিন দুপুরে ধর্ষণের শিকার শিশুটিকে হাসপাতালে দেখতে যান সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদও।
একইদিন ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের প্রকাশ্যে ফাঁসির দাবিতে আদালত চত্বরে বিক্ষোভ করেন মাগুরা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা ও সাধারণ জনতা।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। তবে আসামিদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থাকায় আদালতে হাজির করতে পারেনি তারা। এ কারণে রিমান্ড শুনানিও হয়নি। পুলিশ জানায়, আদালতের মূল ফটকে বিক্ষোভকারীরা অবরোধ করে রাখায় আসামিদের আদালতে হাজির করার ঝুঁকি নেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
১০ মার্চ: চার দিনেও জ্ঞান ফেরেনি, শিশুটির ছবি-ভিডিও অপসারণে হাইকোর্টের নির্দেশ
১০ মার্চ পর্যন্ত চার দিনেও জ্ঞান ফেরেনি। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় আট সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) কর্তৃপক্ষ। সিএমএইচের চিকিৎসকরা জানান, বুকে প্রচণ্ড চাপ দেওয়ায় শিশুটির ফুসফুসের বিভিন্ন জায়গায় বাতাস জমে গেছে। অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে তার মস্তিষ্কেও ক্ষতি হয়েছে।
হাইকোর্ট ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গণমাধ্যম, অনলাইন পোর্টালসহ যেসব জায়গায় শিশুটির ছবি ও ভিডিও ছড়িয়েছে, তা অপসারণের নির্দেশ দেন। যেসব মাধ্যমে শিশুটির ছবি প্রকাশ হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেও তিন দিনের মধ্যে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বিটিআরসি, পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং ডিএমপি কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ১৩ মার্চের মধ্যে এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন হাইকোর্ট।
১১ ও ১২ মার্চ: অবস্থা আরও অবনতির দিকে
আগেরদিন চোখের পাতা খোলার সংবাদ পাওয়া গেলেও পরের দুইদিন ফের অবনতির দিকে যেতে শুরু করে শিশুটির শারীরিক অবস্থা। জীবিত ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেন চিকিৎকরা। সারাদেশে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ছাত্র-জনতা। দাবি জানান, ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির।
১৩ মার্চ: শেষ বিদায়, জানাজা ও দাফন
দীর্ঘ আটদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় আট বছর বয়সী শিশুটি। হাসপাতালের শিশুরোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (পিআইসিইউ) চিকিৎসা চলছিল তার। বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারবার ও বৃহস্পতিবার আরও দু‘বার ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় শিশুটির।
পরে শিশুটির মরদেহ রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে হেলিকপ্টারে গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়। মরদেহ মাগুরা পৌঁছানোর পর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় শহরের নোমানী ময়দানে প্রথম জানাজা হয়। এতে অংশ নেয় হাজারো মানুষ। পরে মরদেহ গ্রামে নেওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তের বাড়িতে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। রাত পৌনে ৮টার দিকে বাড়িটিতে আগুন দেওয়া হয়। স্থানীয়রা জানায়, জানাজার নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই আসামিদের বাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয় লোকজন। রাত সোয়া ৮টার সময় এই প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত ওই বাড়িতে আগুন জ্বলছিল। কাউকে সেখানে আগুন নেভাতে দেখা যায়নি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন অবস থ য় স এমএইচ উপদ ষ ট
এছাড়াও পড়ুন:
সেই শিশুটির অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন, আজ আরও দুবার ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’
মাগুরায় ধর্ষণের শিকার আটবছর বয়সী শিশুটির জীবন সংকটাপন্ন। আজ বৃহস্পতিবার আরও দুবার ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ (আকস্মিকভাবে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া) হয়েছে। দ্বিতীয় বারে প্রায় ৩০ মিনিট সিপিআর দেওয়ার পর রিভার্স করেছে। তবে ব্রেন ফাংশন করছে না। রক্ত চাপ ও অক্সিজেন লেভেল অনেক কম। আজ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
এর আগে বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারবার ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ (আকস্মিকভাবে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া) হয় শিশুটির।
তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এক ফেসবুক পোস্টে এ তথ্য জানিয়েছে। শিশুটির সুস্থতার জন্য সেনাবাহিনী দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছে।
গতকাল সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) শিশু বিভাগের শিশুরোগের চিকিৎসাসংক্রান্ত নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (পিআইসিইউ) শিশুটির চিকিৎসা চলছে। প্রতিদিন স্ট্যান্ডার্ড আইসিইউ প্রটোকল অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং সে অনুযায়ী তাকে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।
সেনাবাহিনীর ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, শিশুটি আজ (বুধবার) চারবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শিকার হয়েছে। সিপিআর (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) দিয়ে তার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল করা হয়েছে। তার রক্তে লবণের ভারসাম্যহীনতার কারণে ডায়ালাইসিস করা হচ্ছে। অন্যান্য জটিলতার পাশাপাশি শিশুটির রক্তচাপ ৬০/৪০ মিমি পারদ কিংবা তার চেয়ে নিম্নমুখী।
আট বছরের শিশুটি গত বুধবার (৫ মার্চ) বোনের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে গভীর রাতে ধর্ষণের শিকার হয়। শিশুটিকে প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও তার অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। পরে বৃহস্পতিবার রাতে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে শুক্রবার রাতে শিশুটিকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। অবস্থার আরও অবনতি হলে শনিবার বিকেলে শিশুটিকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তার চিকিৎসা চলছে।