ঢাবিতে ১৫ জুলাই হামলা: ৭০ শিক্ষক ও ছাত্রলীগের ১২২ শিক্ষার্থী শনাক্ত
Published: 13th, March 2025 GMT
জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় তথ্যানুসন্ধান কমিটি ৭০ জন শিক্ষকের প্রমাণ পেয়েছে, যারা নানাভাবে হামলায় ইন্ধন জুগিয়েছেন-উস্কানি দিয়েছেন। হামলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলা খুঁজে পেয়েছে কমিটি। এছাড়া নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ১২২ শিক্ষার্থী হামলায় প্রত্যক্ষ জড়ান।
আজ বৃহস্পতিবার উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খানের হাতে এই প্রতিবেদন জমা দেন তথ্যানুসন্ধান কমিটির সদস্যরা। এরপর সাংবাদিকদের প্রাথমিক খুঁটিনাটি তুলে ধরেন কমিটির আহ্বায়ক বিভাগের আইন সহযোগী অধ্যাপক মাহফুজুল হক সুপণ। প্রতিবেদনে হামলার ঘটনায় মাত্র ২৫ শতাংশ তারা তুলে আনতে পেরেছেন বলে জানান তিনি।
মাহফুজুল হক সুপণ বলেন, পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২২ শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করেছি। বহিরাগত অনেকেও হামলায় জড়িয়েছে। বিশেষত মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
তিনি আরও বলেন, উপাচার্যের বাসভবনের সামনে মেয়েদেরকে বাস থেকে নামাচ্ছে এবং পেটাচ্ছে। এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। বিশেষত মেয়েগুলোকে ধরে ধরে পেটানো হচ্ছে। একজন মেয়ে হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে চাচ্ছিল, তার হাত ধরে রেখেছে, এটা তো শ্লীলতাহানীর পর্যায়ে পড়ে।
হামলাকে পূর্বপরিকল্পিত উল্লেখ করে মাহফুজুল হক বলেন, ১৫ জুলাইয়ের হামলা ছিল পুরোটাই পরিকল্পিত। সেখানে দুইটি গ্রুপ ছিল সাদা ক্যাপ পরিহিত; একটি গ্রুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলচত্বরে, আরেকটি গ্রুপ ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের সামনে। হামলায় সরকারি বাঙলা কলেজ, কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদেরও পাওয়া গেছে। আগে থেকে পরিকল্পনা না হলে এভাবে সম্ভব না।
কমিটির আহ্বায়ক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টার, ঢাকা মেডিকেল কলেজের জরুরী বিভাগের ফটকের এবং জরুরী বিভাগের ভেতরেও হামলা হয়েছে। ডাক্তারদের চিকিৎসা না দিতে বলা হয়েছে। সেসব ভিডিও আমরা পেয়েছি।
প্রতিবেদনে কমিটি জানায়, হামলার নিকৃষ্টতম দিক ছিল নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং হাসপাতালে গিয়েও হামলা করা হয় এবং ডাক্তারদের চিকিৎসাপ্রদানে বাধা প্রদান করা হয়। এটিকে তারা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
আহ্বায়ক আরও বলেন, যারা হামলায় বেশি নৃশংসতা দেখিয়েছে, তারা অনেকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। তার ৬ বছরে অনার্স শেষ করার কথা, অথচ ১১ বছরে ধরে অনার্স চলছে। কীভাবে? অনেক ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে, কিন্তু তারা হলে ছিল। কীভাবে ছিল? প্রশ্ন তোলেন তিনি।
মাহফুজুল হক বলেন, যারা হলপাড়ায় শিক্ষার্থীদের মেরেছে, তারাই মলচত্বরে পেটাচ্ছে, তারাই উপাচার্যের বাসভবনের সামনে পেটাচ্ছে। এরা ওই শিক্ষার্থী, যারা অনেকদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকছে।
সুপণ বলেন, সেদিন মেয়েদেরকে টার্গেট করে মারা হয়েছে। মেয়েদের ওপর হামলা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও (ছাত্রলীগের)। এসব হামলায় প্রশাসন অবগত থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এতে প্রশাসনের নেগলিজেন্সের (অবহেলা) প্রমাণ পেয়েছি আমরা।
কমিটির আহ্বায়ক আরও বলেন, উপাচার্যের বাসভবনের ফটকের সামনে মেয়েদের পেটানো হচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন কিছু জানেন না। ১৬ তারিখ বাইরে থেকে বাস এনে মুহসীন হলের মাঠে রাখা হয়েছে। আমরা প্রশাসনের কোনো ব্যবস্থা দেখেনি। মুজিব হলের পকেট গেট দিয়ে বহিরাগতদের প্রবেশ করানো হয়েছে, হলের কর্মচারীরা প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকদের ফোন দিয়েছে। তারা ফোন ধরেননি। এখানে শুধু অবহেলা হয়েছে ব্যাপারটা এমন নয়, হয়তো তারা এসব জানতো। জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
মাহফুজুল হক বলেন, উপাচার্যের বাসভবনের সামনে মেয়েদের পেটানো হচ্ছে। আমাদের কাছে অস্বাভাবিক লেগেছে, উপাচার্য বা প্রশাসনের কেউ উঁকিও দেননি। কোনো মন্তব্য করেননি। পরবর্তীতে কোনো ব্যবস্থাও নেননি।
প্রায় ৭০ জন শিক্ষক হামলা উস্কে দেওয়ার ভূমিকা রেখেছেন জানিয়ে কমিটি প্রধান বলেন, আমরা তদন্তে দেখেছি- যারা আন্দোলন করছে, তাদেরকে ‘পাকিস্তানের দালাল’, ‘শিবিরকর্মী’ বা ‘ছাত্রদল কর্মী’- বলে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন এসব শিক্ষকরা। ছাত্ররা এসব পোস্ট প্রিন্ট করে আমাদের কাছে জমা দিয়েছে। সেসব শিক্ষকরাও এমন কথা স্বীকার করেছেন এবং দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এই প্রতিবেদনে হামলা ও সহিংসতার কতটুকু কাভার করা হয়েছে জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আরও শনাক্ত করার সুযোগ আছে। তবে আমরা মনে করি, ২৫ ভাগ তুলে আনতে পেরেছি আমরা।
সিসিটিভি ফুটেজের বিষয়ে মাহফুজুল হক বলেন, আমরা ব্যক্তিগত ভিডিও সংগ্রহ করেছি। কিন্তু আমরা সিসিটিভির ফুটেজ পাইনি। প্রত্যেক হলের হার্ডড্রাইভ খুলে নিয়ে গেছে। ভিসি চত্বরের হার্ডড্রাইভে আমরা কিছু পাইনি। অনেক জায়গায় ক্যামেরা এমনভাবে লাগানো, কেবল গাছ দেখা যায়।
প্রতিবেদনের সঙ্গে দেওয়া সংবাদ সংক্ষেপে সত্যানুন্ধান কমিটি জানায়, হামলার শিকার শিক্ষার্থীরা যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণ জমা দিয়েছিল তার সঙ্গে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কন্টেন্ট, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান বিচার বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।
প্রতিবেদন গ্রহণ শেষে উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, প্রতিবেদনটি সিন্ডিকেটে তোলা হবে। এরপর তদন্ত কমিটি ও ট্রাইবুনাল গঠনসহ আইনি প্রক্রিয়াগুলো হবে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ হামলায় প্রায় তিনশত শিক্ষার্থী আহত হন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ল ই অভ য ত থ ন কম ট শ ক ষ র থ দ র ওপর ১৫ জ ল ই ব যবস থ র কল প র স মন ন কম ট কর ছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
চুরির অপবাদ দেওয়ায় শরীরে পেট্রল ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা, দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে
কুমিল্লার চান্দিনায় চুরির অপবাদ দেওয়ায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার এক চালক শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। গতকাল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে চান্দিনা উপজেলা সদরের সরকারি হাসপাতালসংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
মো. সবুজ নামের ওই চালককে চান্দিনা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে রাতেই কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আরিফুর রহমান জানান, আগুনে সুবজের শরীরের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাঁকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
সবুজ চান্দিনা উপজেলার বাড়েরা ইউনিয়নের গড়ামারা গ্রামের আমির হোসেনের ছেলে। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চান্দিনা উপজেলা সদরের বেলাশহর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চান্দিনা সদরের হাসপাতাল সড়কের ইউনুছ মিয়ার অটোরিকশা গ্যারেজ ভাড়া নিয়ে সবুজসহ তিনজন ওই গ্যারেজে তাঁদের অটোরিকশা রাখেন। পালাক্রমে তাঁরা তিনজন পাহারাও দেন। প্রায় চার মাস আগে এক রাতে পাহারার দায়িত্ব ছিলেন সবুজ। ওই দিন রাত আনুমানিক দুইটার দিকে গ্যারেজে তালা দিয়ে সবুজ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বাইরে যান। ওই সময় চোরচক্র দুটি অটোরিকশা নিয়ে পালিয়ে যায়। পরদিন ওই ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ দেখে মানিক নামের একজনকে আটক করে পুলিশে দেওয়া হয়। সেদিন রাতেই পুলিশ মানিককে ছেড়ে দেয়। পরে স্থানীয় কয়েকজন মাতবর সবুজকে চোর আখ্যা দিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। কিন্তু সবুজ জানান, তিনি ওই রায় মানেন না এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেওয়ার ক্ষমতাও তাঁর নেই।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় স্থানীয় কয়েকজন মাতবরের প্ররোচনায় সালাউদ্দিন নামের এক ব্যক্তি সবুজকে আটক করে তাঁর অটোরিকশা নিয়ে যান। এ সময় তাঁকে চোর আখ্যা দিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে চাপ দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সে প্রকাশ্যে শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান।
সুবজের স্ত্রী খুশি আক্তার বলেন, ‘মাতবররা চোর ধরে ছেড়ে দিছে আর আমার স্বামীরে চুরির অপবাদ দিয়ে জরিমানা করেছে। আমার স্বামী চোর আখ্যা দেওয়ার এই নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে নিজের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। গরিবের জন্য আইন নাই, বিচার নাই। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।’
গতকাল রাতে চান্দিনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাবেদ উল ইসলাম বলেন, ‘অটোরিকশা চুরির ঘটনায় সময় মানিক, সাইফুল ও নাজমুল নামের তিনজনের নাম উল্লেখ করে থানায় একটি মামলা হয়। ওই চুরির ঘটনায় সবুজকে দায়ী করে চাপ সৃষ্টি করলে সে অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের গায়ে পেট্রল ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে জেনেছি। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’