বারবার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যেতে চাইছে। বন্ধ হওয়া হৃদয়টাকে প্রচণ্ড শক্তিকে ধাক্কা দিয়ে আবারও চালু হতে বলছে গোটা দেশ। পারছে না শিশুটি। আট বছরের ছোট্ট শরীরে বেঁচে থাকার কোনো শক্তি আর অবশিষ্ট নেই যে!
কেন বেঁচে থাকবে? কেউ কি তাকে বাঁচাত, যদি আবারও সে কেঁদে বলত, ‘মা, আমি ঘরে ফিরে যেতে চাই!’ নাকি আরও লাখো শিশুর মতো তাকেও আবার বলা হতো, ‘সব ভুলে যা মা, এসব কথা কাউকে বলতে নেই!’
শিশুটি আর কোনো অভিযোগ করবে না। ছোট্ট সাদা কাফনে মোড়ানো শিশুটিকে আজকে যখন তার মা শেষবারের মতো ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন, তখন হয়তো তাঁর বারবার একটি কথাই মনে পড়বে, ‘ইশ! ক্যান যে পাঠাইছিলাম!’ কিন্তু সময় কেবল সামনেই বয়ে চলে।
আজকে দেশজুড়ে অনেক নিন্দা, অনেক প্রতিবাদ। খুব ভালো। কিন্তু শুধু দোষীদের ফাঁসি চাইলেই কি শিশুরা নিরাপদ হবে? কে অপরাধী? শুধু কি তারাই যারা ধর্ষণ করে, নাকি পুরো সমাজ, যারা এখনো মনে করে কোনো নারীর ওপর কোনো পুরুষ বিকৃত যৌনাচার চালালে নারীর শ্লীলতা বা সম্ভ্রমহানি হয়?
মাগুরার শিশুটি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল নীরব অভিমানে। হয়তো তার শেষ প্রশ্ন ছিল, মা কেন তার কথা শুনলেন না? কেন তার নিরাপত্তার কথা ভাবলেন না? সে দোষ কি একা তার মায়ের, নাকি আমরা সবাই মিলে আমাদের মায়েদের শিখিয়েছি, ঘরের কিংবা বাইরের পুরুষ আমার সন্তানের গায়ে হাত দিলে, সে দোষ আমার সন্তানের। এতে নারী অপবিত্র হয়, বিকৃত পুরুষ নয়। তাই নারীর এ ‘লজ্জা’ লুকিয়ে ফেলাই শ্রেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে আরও অনেক শিশুর অশ্রু দেখার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
পরিবারকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে, মায়েদের এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সন্তানদের সঙ্গে যৌনতা নিয়ে কথা বলতে হবে। তারা যদি না–ই জানে, বিকৃত যৌনাচার কী, কীভাবে তারা এর শিকার হতে পারে, তাহলে তারা নিজেদের রক্ষা করবে কীভাবে?
সবচেয়ে জরুরি পরিবারের মধ্যে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে একটি শিশু নির্দ্বিধায় তার আপনজনকে নিজের সমস্যার কথা বলতে পারবে। তার মধ্যে এই ধারণা গড়ে দিতে হবে, বিকৃত যৌনাচারের দায় তার নয়; বরং দায় সেই অমানুষটির, যে শিশু কিংবা নারীর শরীরে আপত্তিকরভাবে হাত দেয়।
ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন এমন একটি ব্যাধি, যেটি শুধু আদালত কিংবা পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে জড়িত নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। আর তা পরিবর্তনের পথ হলো শিক্ষা এবং সচেতনতা। অনেকে বলতে পারেন শিশুদের কেন আমরা যৌনতা সম্পর্কে পড়াব? উত্তর সহজ, মাগুরার ঘটনায় ধর্ষক ভেবে দেখেনি শিশুর বয়স তো মাত্র ৮। তাই ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই এই শিশুদের অন্ধকারে রেখে করা সম্ভব নয়।আমাদের সন্তানেরা তাদের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোর কাছে এই বিকৃতির শিকার হয়। এরা কেউ মামা, কেউ চাচা, কেউ বড় ভাই, কেউ গৃহশিক্ষক। কিন্তু তাদের একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত তারা বিকৃত রুচির মানুষ। এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। চুপ করে থাকাটা কোনো সমাধান নয়।
যখন পরিবারের কেউ এ ধরনের আচরণ করে, পরিবারের সম্মানহানি করে সেই মানুষটিই। যে এই আচরণের শিকার, সে নয়। এই সহজ কথাটা আমাদের বাবা–মায়েদের বুঝতে হবে। বোঝাতে হবে আমাদের সন্তানদের। পোশাক বা বয়স নির্বিশেষে নারী ও শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। বিকৃতির হাত বাইরের চেয়ে ঘরের ভেতরে অনেক বেশি প্রকট। তাই প্রতিরোধ শুরু হতে হবে ঘরের ভেতর থেকে।
ধর্ষণের ও নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে সাজার হার এ দেশে বরাবরই লজ্জাজনক। এখানে একদিকে বিচার চাইতে এসে নারীরা যেমন নানা রকম হয়রানির শিকার হন, তেমনি আছে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রবণতা। আইন পরিবর্তন করে ২০২০ সালেই ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তাতেই কি ধর্ষণের সংখ্যা কমেছে?
আরও পড়ুনবাড়ির বাইরে, বাড়ির ভেতরে—নিরাপত্তা নিয়ে ভীত আমরা০৯ মার্চ ২০২৫এখানে সর্বোচ্চ শাস্তির ওপর গুরুত্ব দেওয়ার চেয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ন্যায়বিচার নিশ্চিত করায়। গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বিচারপ্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণের ওপর। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিচার চাইতে এসে পদে পদে হয়রানি বন্ধ করা। সেখানে বিচারক এবং আইনজীবী উভয়েরই দায় রয়েছে।
ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতন এমন একটি ব্যাধি, যেটি শুধু আদালত কিংবা পুলিশ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে জড়িত নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। আর তা পরিবর্তনের পথ হলো শিক্ষা এবং সচেতনতা। অনেকে বলতে পারেন শিশুদের কেন আমরা যৌনতা সম্পর্কে পড়াব? উত্তর সহজ, মাগুরার ঘটনায় ধর্ষক ভেবে দেখেনি শিশুর বয়স তো মাত্র ৮। তাই ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই এই শিশুদের অন্ধকারে রেখে করা সম্ভব নয়।
বাবা–মায়েদের বলব, আজই আপনার সন্তানের সঙ্গে কথা বলুন, সে হোক ছেলে বা মেয়ে। তার শরীরের কোন কোন অংশ অন্য কেউ স্পর্শ করতে পারে না, তা তাকে জানান। সে এমন কোনো অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছে কি না, যা তার ভালো লাগেনি, তা তার কাছে জানতে চান। যদি এমন কিছু হয়েই থাকে, তবে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলুন। বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আওয়াজ তুলুন। আপনার সন্তান চিরতরে হারিয়ে গেলে, পরিবারের ‘সম্মান’ আপনার কাছে অর্থহীন ঠেকবে।
মানজুর–আল-মতিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ওয়ারীর ‘নিখোঁজের’ ঘটনায় শিশু উদ্ধার
রাজধানীর ওয়ারী থেকে ‘নিখোঁজ’ হওয়ার দুই দিন পর শিশু উদ্ধার হয়েছে। মাকে উদ্ধারে কাজ করছে পুলিশ। এর আগে স্ত্রী-সন্তানের গত মঙ্গলবার নিখোঁজের কথা জানিয়ে ব্যবসায়ী হুমায়ুন কবির ওয়ারী থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দেন।
আজ রাত নয়টার দিকে হুমায়ুন কবির বলেন, কে বা কারা তার সন্তানকে বাসার সামনে নামিয়ে রেখে গেছেন। শিশুটি বলেছে, তারা একটি হোটেলে ছিল।
এর আগে হুমায়ুন কবির বলেন, গত মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে তাঁর স্ত্রী শিশুপুত্রকে নিয়ে ওয়ারীর ওয়ার স্ট্রিট এলাকার একটি স্কুলে যান। দুপুর ১২টার দিকে পরীক্ষা শেষে ছেলেকে নিয়ে তাঁর স্ত্রীর বাসায় ফেরার কথা ছিল; কিন্তু কেউ বাসায় ফেরেনি। পরে তিনি তাঁর স্ত্রীর মুঠোফোনে কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে তাঁর স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন।
হুমায়ুন কবির আরও বলেন, মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে তাঁর ছেলের নানির মুঠোফোনে কল আসে। বলা হয়, ‘আপনার নাতির সঙ্গে কথা বলেন।’ তখন তাঁর ছেলে তার নানিকে বলে, ‘আমরা নিরাপদে আছি।’ এ কথার পরই মুঠোফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি র্যাবের কাছেও অভিযোগ দেন তিনি। আজ বৃহস্পতিবার রাতে ওয়ারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফয়সাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ছেলে উদ্ধার হয়েছে। মাকেও শিগগিরই উদ্ধার করা হবে।
আরও পড়ুনওয়ারী থেকে ‘নিখোঁজ’ মা-ছেলে দুদিনেও উদ্ধার হননি৪ ঘণ্টা আগে