মাগুরার সেই শিশুটি কি অভিশাপ দিয়েছিল
Published: 13th, March 2025 GMT
‘মাগুরার সেই শিশুটি’—নিজের নামকে আড়াল করে এখন এটিই শিশুটির পরিচয়। এই তিনটি শব্দবন্ধ দিয়েই অসংখ্য নামের ভিড়েও শিশুটিকে আলাদা করে চিনতে পারা যায়। যেন এই নাম ফুটে থাকা মাধুরীলতার মতো ফুটে আছে সবার চোখের সামনে। এই নামে তাকে চিনে যাচ্ছে গোটা দেশ। হয়তো এই তিনটি শব্দবন্ধ পেরিয়ে গেছে দেশের সীমানাও। শিশুটির বয়স আট। বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে শিশুটিকে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছেন তার মা। এই শিশুটি এখন আর নেই, সে এখন পেরিয়ে যাচ্ছে পুরো পৃথিবীর আলো। আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১টায় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) কর্তৃপক্ষ শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আজ সকালে দুই দফায় শিশুটির ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ (আকস্মিকভাবে হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া) হয়। সিপিআর দেওয়ার পর তাঁর হৃৎস্পন্দন ফিরে এসেছিল। কিন্তু দুপুর ১২টায় তাঁর আবার ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হয়। এই দফায় সিপিআর দেওয়ার পরও তার হৃৎস্পন্দন ফেরেনি। বেলা ১টায় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
ফুলের তো কেবল ফুটে ওঠার নিয়তি থাকে না, তাকে ঝরেও পড়তে হয়। এই দায়িত্বও ফুলের। আর তাই সবকিছু, চিকিৎসার সব আয়োজন তুচ্ছ জ্ঞান করে ‘মাগুরার সেই শিশুটি’, যে কিনা ফুটে থাকা মাধুরীলতা; ঝরে গেল আজ।
শিশু ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলায় শিশুটির বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে শিশুটির মা অভিযোগ করেন, মেয়ের স্বামীর সহায়তায় তাঁর বাবা (শ্বশুর) শিশুটিকে ধর্ষণ করেন। বিষয়টি মেয়ের শাশুড়ি ও ভাশুর জানতেন। তাঁরা ঘটনা ধামাচাপা দিতে শিশুটিকে হত্যাচেষ্টা চালান। এই মামলায় শিশুটির ভগ্নিপতি, বোনের শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুরকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
কত দিন হয় এই শিশুটিকে আমরা চিনি? মাত্র এক সপ্তাহের জানা। তবু, কেন এমন হয়?—এই এক সপ্তাহে রোজ যত তাকে জেনেছি, চিনেছি, ততই যেন মনে হয়েছে আগে থেকে তাকে চিনতাম। তার বন্ধ চোখ। জমে থাকা জল লেগে আছে চোখের পাতায়। ওই জলের দিকে একদৃষ্টে তাকালে, তা আনমনে নিয়ে যায় নিজের ঘরের দিকে। ওই ঘরে এই শিশুটির মতো আমার একটি কন্যাশিশু আছে। পৃথিবীর সব শিশুর মুখ-ই তো ফুটে থাকা ফুলের আদল। সব শিশুর মুখ যদি ফুলের আদল হয়, তাহলে মাগুরার শিশুটি তো আমার কন্যাই। এ কারণেই এত উদ্বিগ্ন লাগে নিজেকে! কন্যা যখন তার মায়ের সঙ্গে কোথাও যায় তখনো আমার উদ্বিগ্ন লাগে। বলেছি আমি—কিচ্ছু চাই না আমার। না সুখ, না শান্তি। যেখানেই নিয়ে যাও, তুমি শুধু কন্যাকে সাবধানে আমার কাছে ফিরিয়ে এনো। এই শুধু চাওয়া।
আরও পড়ুনমাগুরার সেই শিশুটিকে বাঁচানো গেল না২ ঘণ্টা আগেমাগুরার সেই শিশুটির মায়েরও নিশ্চয়ই এমন চাওয়া-ই ছিল। গত রোববার ওই মা বলছিলেন, আগের দিন (মঙ্গলবার) তাঁর মেয়ে ফোনে কান্নাকাটি করে বোনের বাসা থেকে নিজের বাসায় চলে আসতে চেয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, আর দুইটা দিন থাকতে। তারপর নিয়ে আসবেন। এখন তাঁর একটাই আফসোস। বলেছেন, ‘ইশ্! ক্যান যে পাঠাইছিলাম! মেয়ের কষ্ট আর সহ্য করতে পারছি না। আপনাকে ছবি তুইলা দেখাতে পারলে বুঝতে পারতেন কী কষ্ট পাচ্ছে! আল্লাহর কাছে মেয়ের দাবি ছাইড়া দিছি।’
এই মা আরও বলেন, ‘মেয়ে বোনের বাসায় যেতে চাইছিল না। জোর করে পাঠাইছিলাম। যদি না পাঠাইতাম তাহলে এই অবস্থা হতো না।’
এই মা কি জানতেন, বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া মানে মেয়ের আয়ুর শেষ অবধি পথ চলে যাওয়া! জানতেন না। জানলে মেয়েকে যেতে দিতেন না আরেক মেয়ের বাড়ি। কিন্তু তিনি জানতেন, শ্বশুর-জামাতা দুজনের চরিত্রই খারাপ। তবে চিনতে পারেননি। এই আফসোস নিয়ে আজীবন পুড়ে খাক হয়ে যাবেন এখন এই মা।
মামলার এজাহারে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাদী উল্লেখ করেছেন, গত বুধবার (৫ মার্চ) রাত ১০টার দিকে খাবার খেয়ে বড় বোন ও তাঁর স্বামীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমায় শিশুটি। দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে বড় বোন ঘুম থেকে জেগে দেখেন, ছোট বোন পাশে নেই, মেঝেতে পড়ে আছে। তখন শিশুটি বড় বোনকে জানায়, তার যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। কিন্তু বড় বোন মনে করে, শিশুটি ঘুমের মধ্যে আবোলতাবোল বকছে। এরপর সকাল ছয়টার দিকে শিশুটি আবার বোনকে যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়ার কথা বলে। কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বোনকে জানায়, রাতে দুলাভাই (বোনের স্বামী) দরজা খুলে দিলে তাঁর বাবা (শ্বশুর) তার মুখ চেপে ধরে তাঁর কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করেন। সে চিৎকার করতে গেলে তার গলা চেপে ধরা হয়। পরে তাকে আবার বোনের কক্ষের মেঝেতে ফেলে রেখে যায়।
গত বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে মাগুরার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যান তার বোনের শাশুড়ি। পরে শিশুটির মা হাসপাতালে যান। সেদিন দুপুরেই উন্নত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার রাতে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর গত শুক্রবার রাতে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। সংকটাপন্ন অবস্থায় শিশুটিকে গত শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (পিআইসিইউ) থেকে সিএমএইচে স্থানান্তর করা হয়। তাকে ঢাকার সিএমএইচের পিআইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছিল।
ওই যে শুরুতে বলেছিলাম—‘মাগুরার সেই শিশুটি’ এই নাম যেন ফুটে থাকা মাধুরীলতার মতো ফুটে আছে সবার চোখের সামনে। এ কারণে এ ঘটনার পর ওই দিন থেকেই সকাল থেকে প্রায় দিনভর মাগুরা শহরসহ সারা দেশে শিশু ধর্ষণে জড়িত ব্যক্তিদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। দেশে নারীদের প্রতি যৌন নির্যাতন ও উত্ত্যক্ত করার ঘটনা আকস্মিকভাবে বেড়ে গেছে। এর প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র আন্দোলন হয়েছে, হচ্ছে। এই আন্দোলন ও মাগুরার ওই শিশুর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার আইন পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। গত রোববার আইন মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে তদন্তের সময় ৩০ থেকে কমিয়ে ১৫ দিন করা হচ্ছে। আর ধর্ষণের মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার করতে হবে। অংশীজনদের সঙ্গে কিছু পরামর্শ করে বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।
কিন্তু এই বিচার দেখে যেতে পারল না ‘মাগুরার সেই শিশুটি’। এর আগেই শরীর ও হৃদয়ের ক্ষত নিয়ে আজীবনের জন্য চলে গেল ছোট্ট এই মেয়েটি।
আরও পড়ুনমাগুরার সেই শিশুর মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোক, আসামিদের দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নির্দেশ১ ঘণ্টা আগেসিএমএইচে শিশুটির চিকিৎসায় গঠিত বোর্ডের একজন চিকিৎসক সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটির যৌনাঙ্গে ক্ষত রয়েছে। গলায় বড় ক্ষত। ওড়নাজাতীয় কিছু দিয়ে শিশুকে ফাঁস দেওয়া হয়েছিল এবং বুকে প্রচণ্ড জোরে চাপ দেওয়া হয়েছিল। মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে গেছে। বুকের ওপর চাপ দেওয়ার কারণে ফুসফুসের যেসব জায়গায় বাতাস থাকার কথা না, সেসব জায়গায় বাতাস ঢুকে গেছে। বুকে অস্ত্রোপচার করে অতিরিক্ত বাতাস বের করার জন্য টিউব বসানো হয়েছে। অক্সিজেন স্বল্পতাজনিত কারণে মস্তিষ্কে ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে খিঁচুনি হচ্ছিল।
এত এত যন্ত্রণার সময় ছোট্ট মেয়েটি নিজেকে বাঁচাতে ঠিক কী করেছিল?—আমরা জানি না। নিরুপায় হয়ে সে কি মনে মনে অভিশাপ দিয়েছিল। ছোট্ট মানুষ। তার অভিশাপের ভাষা কতটা কঠিন হতে পারে। বড়জোর হয়তো বলেছ—নিপীড়ক, তোমার যেন কোনো দিন খিদে না পায়; তোমার চোখে যেন জল না আসে কোনো দিন অথবা বোবা হয়ে তুমি আজীবন বয়ে নিয়ে যাও বিকলাঙ্গ জীবন। বিচার তো চাই। আবার বাবা হিসেবে চাই—সত্যি হোক নিষ্পাপ শিশুর এমন অভিশাপ।
আরও পড়ুনমাগুরার সেই শিশুটির মা বললেন, ‘ইশ্! ক্যান যে পাঠাইছিলাম’০৯ মার্চ ২০২৫.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
শরীয়তপুরের জাজিরায় আবারও সংঘর্ষ, মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় শতাধিক ককটেল (হাতবোমা) বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
গতকাল রোববার দুপুরে জয়নগর ইউনিয়নের ছাব্বিশপারা এলাকায় এ সংঘর্ষ হয়। এতে এক তরুণের হাতের কব্জিতে গুরুতর ক্ষত হয় এবং আরও একজন আহত হন।
জাজিরা থানা ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জয়নগর ইউনিয়নের ছাব্বিশপারা এলাকায় তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিঠুন ঢালী ও জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হালিম তালুকদারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই দুই নেতা আত্মগোপনে গেলে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জসিম তালুকদার ও নুর আলম সরদার।
রোববার দুপুরে দুই পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্র ও ককটেল নিয়ে সংঘর্ষের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় নুর আলম সরদারের অনুসারীরা প্রতিপক্ষের ওপর ককটেল বোমা নিক্ষেপ করে। এরপর উভয় পক্ষ ঘণ্টা-ব্যাপী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ককটেল বিস্ফোরণ ও মারামারি। পরে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
সংঘর্ষের কিছু দৃশ্য স্থানীয় এক ব্যক্তির সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ হয়, যা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ৪ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে দেখা যায়, এক পক্ষের সমর্থকরা বালতিতে করে ককটেল নিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করছেন। তাদের হাতে ছিল টেঁটা, রামদা, ছেনদা, বল্লম, ডাল-সুরকি ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র।
সম্প্রতি জাজিরার বিলাশপুরে সংঘর্ষের ঘটনায় খইয়ের মতো ককটেল বিস্ফোরণ দেশজুড়ে আলোচিত হয়। গত ৫ এপ্রিল সেখানে দুই শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যা এখনও আলোচনায় রয়েছে। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলো ছাব্বিশপারা এলাকায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল আখন্দ বলেন, গতকাল দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বেশ কিছু হাতবোমা বিস্ফোরিত হয় বলে জানতে পেরেছি। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এ ঘটনায় একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।