ইসলামী শরিয়তের আলোকে রোজাদার মানুষকে ১০টি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। যাদের প্রত্যেক শ্রেণীর বিধান অন্য শ্রেণী থেকে ভিন্ন। নিম্নে তুলে ধরা হলো :
সুস্থ ও স্বাভাবিক রোজাদার : যেসব রোজাদার সার্বিক বিবেচনায় সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে, তাদের ওপর রোজা পালন করা ফরজ। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে সুস্থ ও স্বাভাবিক তাদেরই বলা হবে যারা মুসলিম, সাবালক, সুস্থ জ্ঞানসম্পন্ন, মুকিম (নিজ আবাসে অবস্থানকারী), সামর্থ্যবান ও বাধামুক্ত। এই শ্রেণীর মানুষের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘রমজান মাস, যাতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে রোজা পালন করে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
আর রাসুলুল্লাহ (সা.
আরো পড়ুন:
রমজানে দান-সদকার গুরুত্ব ও যারা অগ্রাধিকার পাবে
কোরআন নাজিলের মাসে কোরআন চর্চা
নাবালক রোজাদার : নাবালক শিশুর ওপর রোজা ফরজ নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তির জন্য কলমের লিখন বন্ধ রাখা হয়েছে : ক. ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না জাগ্রত হবে, খ. নাবালেগ যতক্ষণ না সে বালেগ হবে, গ. পাগল যতক্ষণ না তার জ্ঞান ফিরে আসবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৩৯৮)
তবে শিশুরা কিছুটা বড় হলে সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-সহ পূর্বসূরী বুজুর্গরা তাদের রোজায় অভ্যস্ত করে তুলতেন। এমনকি তারা কান্নাকাটি করলে তাদের পশমের তৈরি খেলনা দিয়ে শান্ত রাখতেন। শিশুদের শরিয়তের বিধি-বিধানে অভ্যস্ত করে তোলা এবং তাদের উপযুক্ত দ্বীনি শিক্ষা দেওয়া মুসলিম মা-বাবার দায়িত্ব। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৯৬০)
পাগল রোজাদার : পাগল ও অচেতন ব্যক্তির ওপর রমজানের রোজা ফরজ নয়। তবে পাগল ব্যক্তি যদি রোজা রাখতে চায় এবং সে শরিয়তের বিধান অনুসারে রোজা পালন করে, তবে তাতে বাধা দেওয়া হবে না অথবা নিরুৎসাহিত করা হবে না। তবে এর দ্বারা তার ওপর ফরজ হওয়া রোজা আদায় হবে না।
স্মৃতিহীন ও বোধশূন্য বৃদ্ধ রোজাদার : এমন রোজাদারের জন্য রোজা রাখা বা ফিদিয়া দেওয়া কোনোটাই ওয়াজিব নয়। কেননা স্মৃতিহীন ও বোধশূন্য ব্যক্তি শিশুর মতো, সে শরিয়তের মুকাল্লাফ (যার জন্য বিধান পালন করা আবশ্যক) নয়।
এমন রোজাদার যার অক্ষমতা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই : এমন অক্ষম ব্যক্তি যার অক্ষমতা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যেমন অতিশয় বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি বা এমন রোগী যার রোগ আরোগ্য হওয়া আশা করা যায় না। এমন ব্যক্তির জন্য রোজা রাখা ফরজ নয়, তবে তাকে ফিদিয়া দিতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যাদের রোজা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর তারা ফিদিয়া তথা একজন মিসকিনকে খাবার প্রদান করবে। (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৪)
সাহাবিদের আমল দ্বারাও ফিদিয়ার বিধান প্রমাণিত হয়। সাবেত বুনানি (রহ.) বলেন, আনাস ইবনে মালেক রা. যখন বার্ধক্যের কারণে রোজা রাখতে সক্ষম ছিলেন না তখন তিনি রোজা না রেখে (ফিদিয়া) খাবার দান করতেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস : ৭৫৭০)
রোজার ফিদিয়া হচ্ছে, একজন মিসকিনকে দুই বেলা ভরপেট খাবার খাওয়ানো। তবে খাবারের পরিবর্তে প্রতি রোজার জন্য সদকাতুল ফিতর পরিমাণ দ্রব্য বা মূল্য দিলেও ফিদিয়া আদায় হয়ে যাবে। (কামুসুল ফিকহ : ৪/৪৫০)
ফিদিয়া আদায় করার পর সুস্থ হলে ভাঙা রোজাগুলো কাজা করতে হবে। আগের ফিদিয়া প্রদান যথেষ্ট হবে না। তবে ফিদিয়া আদায়ের কারণে তার সওয়াব আমলনামায় থেকে যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ৩/৪৬৫)
মুসাফির রোজাদার : যে ব্যক্তি নিজ আবাস ছেড়ে দূরে কোথাও অবস্থান করে, তার জন্য রোজা ভাঙ্গার অবকাশ আছে। তবে উত্তম হলো, কষ্ট কম হলে রোজা রাখা। আর কষ্ট বেশি হলে রোজা ভেঙ্গে না রাখাই উত্তম। কেউ সফরে রোজা না রাখলে নিজ আবাসে ফেরার পর এসব রোজা কাজা করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ বা মুসাফির, সে তার সিয়াম অন্য সময় আদায় করে নেবে। তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ তাই চান এবং তোমাদের জন্য যা কষ্টকর তা তিনি চান না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)
এমন রোগী যার রোগমুক্তির আশা করা যায় : যে রোগীর রোগমুক্তির আশা করা যায় তার তিন অবস্থা । তা হলো-
ক. তার অবস্থা যদি এমন হয় যে, রোজা রাখা জন্য কষ্টকর নয়, তার জন্য ক্ষতিকরও নয়, তাহলে এমন ব্যক্তির জন্য রোজা রাখা ফরজ। কেননা এমন অসুস্থতা শরয়ি ওজর নয়।
খ. যদি তার অবস্থা এমন হয় যে, তার জন্য রোজা রাখা অতি কষ্টকর, তবে ক্ষতি করবে না। এমন ব্যক্তি রোজা রাখবে না। এমন ব্যক্তির ব্যাপারে আল্লাহর ঘোষণা হলো, ‘আল্লাহ সাধ্যের বাইরে কাউকে দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৮৬)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর দেওয়া সুযোগ গ্রহণকে ভালোবাসেন যেমনিভাবে তার নাফরমানি করা অপছন্দ করেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৫৮৬৬)
গ. রোগীর অবস্থা যদি এমন হয় যে, রোজা রাখলে তার গুরুতর ক্ষতি হবে, তবে তার জন্য রোজা ভাঙ্গা আবশ্যক। কেননা আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু।’ (সুরা নিসা, আয়াত: ২৯)
ঋতুমতী নারী : ঋতুমতী নারীর জন্য রোজা রাখা নিষিদ্ধ। সে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকবে। ঋতুমতী নারী যে দিনগুলোতে রোজা রাখতে পারেনি, সে রমজানের পর সমসংখ্যক রোজা কাজা করবে। এমন নারীদের ক্ষেত্রে বুজুর্গ আলেমদের পরামর্শ হলো তারা প্রকাশ্য পানাহার থেকে বিরত থাকবে। যেন তার গোপনীয়তা এবং রমজান মাসের মর্যাদা উভয়টি রক্ষা পায়। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৪২৮; আল বাহরুর রায়িক : ২/২৯১)
স্তন্য দানকারী নারী : যে নারী সন্তানকে স্তন্য দান করছে সে যদি নিজের ও সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা করে তবে সে রোজা রাখা থেকে বিরত থাকবে। তবে পরবর্তীতে এই রোজা কাজা করে নেবে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা মুসাফিরদের নামাজ অর্ধেক করেছেন। আর গর্ভবতী, স্তন্যদানকারিনী ও মুসাফির থেকে রোজা শিথিল করেছেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২৪০৮)
বিশেষ প্রয়োজনে : কোনো ব্যক্তি যদি এমন বিশেষ প্রয়োজনের মুখোমুখি হয় যা পূরণ না হলে তার জীবন রক্ষা পাবে না এবং রোজা না ভেঙ্গে তাঁর প্রয়োজন পূরণ করাও সম্ভব নয়, তখন তার জন্য রোজা ভাঙ্গা জায়েজ। যেমন কোনো ব্যক্তি আকস্মিকভাবে হার্ট অ্যাটাক বা বিপজ্জনক রক্তচাপের শিকার হয় তবে তাঁকে ওষুধ সেবন করানো যাবে। একইভাবে যুদ্ধের ময়দানে শক্তি সামর্থ্য ধরে রাখার জন্য রোজা ভাঙ্গা জায়েজ। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে মক্কায় সফরে বের হলাম, তখন আমরা রোজাদার ছিলাম। এরপর আমরা একটি স্থানে অবতরণ করলাম। আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, তোমরা তোমাদের শত্রু পক্ষের নিকটবর্তী হয়ে গেছ। আর রোজা ভেঙ্গে ফেলে তোমাদের জন্য শক্তি সঞ্চয়ে সহায়ক হবে। তখন আমাদের অবকাশ দেওয়া হলো কেউ চাইলে রোজা রাখবে আর কেউ চাইলে তা ভেঙ্গে ফেলবে। তারপর আমরা আরেকটি স্থানে নামলাম তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, তোমরা খুব শীঘ্রই শত্রুপক্ষের মোকাবেলা করবে। আর রোজা ভেঙ্গে ফেলা শক্তি সঞ্চয়ের জন্য অধিক সহায়ক হবে। সুতরাং তোমরা সবাই সাওম ভেঙ্গে ফেল। আর এটা বাধ্যকারী নির্দেশ ছিল, তাই আমরা সবাই রোজা ভেঙ্গে ফেলেছিলাম।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১১২০)
আল্লাহ সবাইকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, সাঈদিয়া উম্মেহানী মহিলা মাদরাসা, ভাটারা, ঢাকা
শাহেদ//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স য় ম স ধন রমজ ন ত র জন য র জ আল ল হ ত দ ন কর অবস থ এমন র র ওপর রমজ ন
এছাড়াও পড়ুন:
সাক্ষাৎকারের ২৫ মিনিট আগে আসায় চাকরি হলো না প্রার্থীর
সময়ানুবর্তিতাকে ভালো গুণ হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে চাকরির সাক্ষাৎকারের ক্ষেত্রে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক সময় এই গুণ হিতে বিপরীত হতে পারে। এমন একটি ঘটনা সম্প্রতি পেশাদারদের যোগাযোগমাধ্যম লিংকডইনের একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়েছে, যা বিতর্ক উসকে দিয়েছে।
ওই পোস্টে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক বলেছেন, একজন চাকরিপ্রার্থী নির্দিষ্ট সময়ের আগে সাক্ষাৎকার দিতে আসায় তাঁকে বাদ দিয়েছেন।
ওই ব্যক্তির নাম ম্যাথু প্রিওয়েট। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টা রাজ্যে একটি পরিচ্ছন্নতা প্রতিষ্ঠানের মালিক। ঘটনাটি তিনি নিজেই লিংকডইনে শেয়ার করেছেন। তিনি বলেছেন, অফিসের প্রশাসক পদের জন্য একজন চাকরিপ্রার্থী সাক্ষাৎকারের জন্য নির্ধারিত সময়ের ২৫ মিনিট আগে উপস্থিত হয়েছেন। ওই প্রার্থীকে নিয়োগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এটি একটি প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
পোস্টটি আলোচিত হওয়া শুরু করলে এর কারণ ব্যাখ্যা করেন প্রিওয়েট। তিনি বলেন, যদিও চাকরির সাক্ষাৎকারে একটু আগে পৌঁছানো প্রশংসনীয় কাজ। তবে সময়ের অনেক আগে পৌঁছানো দুর্বল সময় ব্যবস্থাপনা বা সামাজিক সচেতনতার অভাবকে ইঙ্গিত দিতে পারে।
প্রিওয়েট ব্যাখ্যা করে বলেন, তাঁর অফিসটি ছোট। ওই প্রার্থী আগেভাগে আসায় তাঁকে অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে। কারণ, তিনি ব্যবসাসংক্রান্ত ফোনকল শুনে ফেলতে পারেন।
প্রিওয়েট জোর দিয়ে বলেন, সাক্ষাৎকারের শিষ্টাচার অনুযায়ী সাধারণত প্রার্থীরা ৫ থেকে ১৫ মিনিট আগে পৌঁছাতে পারেন। তবে এর বেশি হলে তাঁকে অবিবেচক মনে হতে পারে।
ওই ব্যবসায়ীর পোস্টটি দ্রুত ভাইরাল হয়। অনেকেই পক্ষে–বিপক্ষে মতামত দেন। কেউ কেউ তাঁর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেন। তবে অনেকে প্রার্থীর পক্ষও নিয়েছেন।
পোস্টের নিচে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘কাজটি ঠিক হয়নি। কী হাস্যকর মূল্যায়ন! তাঁকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। আমি তাঁকে এখনি চাকরি দেব।’
আরেকজন লিখেছেন, ‘যদি তাঁর একমাত্র পরিবহন বাস হয়ে থাকে, অথবা আসার সময়ের ওপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থেকে থাকে? তাহলে তিনি দেরি না করার জন্য যা করার ছিল, তাই করতেন।’