কৃষিপ্রধান অঞ্চল রংপুর। কৃষিসংস্কৃতির সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের যোগসূত্র রয়েছে। তার প্রভাব পড়েছে ইফতারেও। রংপুরের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানালেন, এখানকার প্রধান শস্য ছিল ধান, গম ইত্যাদি। তাই চালভাজা, চাল ও গমের গুঁড়া দিয়ে নানা পদ বানিয়ে ইফতার করা হতো। এরপর ইফতার–সংস্কৃতিতে যোগ হলো ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, মুড়ি ও মোটা জিলাপি। এখন ইফতারে আরও বৈচিত্র্য এসেছে। মানুষ ইফতারে মুরগি, গরু, খাসির মাংস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন মুখরোচক খাবার পছন্দ করেন।

বৃহত্তর রংপুরের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক মোস্তফা তোফায়েল হোসেন। ষাটের দশকের ইফতারের স্মৃতি তাঁর চোখে এখনো ভাসে। মোস্তফা তোফায়েল হোসেন বলেন, ওই সময় দিনের প্রথম ভাগে চাল ভেজে নিয়ে ভিজিয়ে রাখা হতো। সেই ফুলে ওঠা চালভাজির সঙ্গে কলা, গুড় ও লবণ মিশিয়ে ইফতার করা হতো। গ্রামগঞ্জের উকিল-মোক্তার, ব্যবসায়ী-পাইকার, শিক্ষক, দিনমজুর, গৃহস্থ—সবাই ভিজিয়ে রাখা চালভাজি দিয়ে ইফতার করতেন।

রংপুরের ইফতারে ছোলাবুট, জিলাপি বা বুন্দিয়া ইফতারি হিসেবে যুক্ত হয়েছে আরও পরে, বলা চলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর।

হামার দ্যাশ হারাগাছ গ্রন্থের লেখক ও সাবেক শিক্ষক আবুল কাশেমের মতে, আগে বাড়ি বাড়ি মাদুরি বা চট বিছিয়ে ইফতার করা হতো। গ্রামের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে পাঠানো হতো ইফতারি। অনেকে মসজিদে পাঠাতেন। সেই ইফতারি আবার বাড়ি বাড়ি পাঠানো হতো।

১৯৮০ সালের পর একটা পরিবর্তন আসে রংপুর অঞ্চলের ইফতার আয়োজনে। বিবিধ প্রকার শরবতের আয়োজনের সঙ্গে খাদ্যসামগ্রীতে যুক্ত হলো খিচুড়ি, জিলাপি, পোলাওসহ হরেক রকম আইটেম। খেজুর হয়ে উঠল আবশ্যিক উপাদান।

রেলের শহর নীলফামারীর সৈয়দপুর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যসমৃদ্ধ অঞ্চল। এ অঞ্চলে ইফতারের খাবারে বনেদিয়ানার ভাব রয়েছে আগে থেকেই। সৈয়দপুরের সাংবাদিক এম আর আলম জানায়, সৈয়দপুরে ইফতারে মাংসের কাবাবের প্রচলন বেশি; সঙ্গে ডেজার্ট হিসেবে ফিরনি থাকতে হবে। এ ছাড়া শরবত, লাচ্ছি, শাহি জিলাপি, রেশমি জিলাপি, মনছুরি মিঠাই পদ থাকে। সৈয়দপুরের ঐতিহ্য ‘বুটের ঘুগনি’ প্রতি বাড়িতে ও রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়।

রংপুরের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে বুট–বিরিয়ানি এখন একটি জনপ্রিয় খাবার। বুট–বিরিয়ানি গ্রামে বাড়িতে বাড়িতে করা হয়। রংপুর নগরের কেল্লাবন্দ এলাকা গৃহিণী তামিমা আখতারের দুই মেয়ের পছন্দ বুট–বিরিয়ানি। তামিমা বলেন, মেয়েরা মাঝেমধ্যে বুট–বিরিয়ানির বায়না ধরে।

খইয়ের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে তৈরি করা হয় একধরনের নাশতা, যার আঞ্চলিক নাম ‘জলপান’। এ জলপান রংপুরের আরেকটি প্রিয় পদ। তবে রংপুরের জলপানের সঙ্গে কুড়িগ্রামের জলপানের পার্থক্যও জানা গেল। কুড়িগ্রাম শহরের বাসিন্দা পারভীন বেগম জানান, তাঁরা চাল ভেজে পেঁয়াজ, মরিচ, লবণ, তেলমিশ্রিত নাশতাকে জলপান বলেন। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী ও গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা নদীর চরগুলোতে এখনো জলপান দিয়ে ইফতার করা হয়।

রংপুরে ইফতারির পাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্ত হয়েছে দইবড়া। নগরের সার্কিট হাউস এলাকার ব্যবসায়ী ফারুক আনোয়ার বলেন, বাড়িতে সবাই অন্যান্য ইফতারি পছন্দ করলেও তাঁর ফুফুর পছন্দ দইবড়া। তিনি প্রতিদিন রেস্তোরাঁ থেকে দইবড়া কিনে নিয়ে যান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রংপুর শহরের বৈশাখী রেস্তোরাঁ, ঠিকানা হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে দইবড়া ক্রেতার ভিড় বেশি। প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকায়।

রংপুরে বেশি ইফতারি বিক্রি হয় কাছারি বাজারে। বাহারি পদের পসরায় এক দোকানে ‘স্পেশাল’ রেশমি জিলাপি, শামি কাবাব, মহুয়া হালিম; অন্য দোকানের স্পেশাল শাহি হালুয়া, শাহি জিলাপি। চিকেন ফ্রাই, চিকেন চপ, চিকেন বারবিকিউ, চিকেন মাসালার মতো আইটেমগুলো বিক্রি হচ্ছে সমানতালে।

বেসরকারি চাকরিজীবী আশরাফুল আলম বলেন, মহুয়া বেকারির হালিম তিনি প্রতিদিন নেন। শহরের মৌবন বেকারির পরিচালক রফিকুল হাসান জানান, ইফতারে তাঁদের শাহি হালুয়ার বেশ কদর।

তবে গ্রামগঞ্জের মসজিদগুলোয় ইফতারে সৌহার্দ্য দেখা যায় বলে মত দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো.

ইউসুফ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মসজিদ কমিটি থেকে বেশির ভাগ স্থানে ইফতারের আয়োজন করা হয়। প্লেটে প্লেটে সাজানো হয় ইফতারি। মুসল্লিরা সারিবদ্ধভাবে বসে ইফতার করেন। ধনী-গরিবের বৈষম্য থাকে না। পরিবার থেকে সমাজে রোজা ও ইফতার ভ্রাতৃত্বের বার্তা নিয়ে আসে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স য়দপ র ইফত র র র ইফত র ত র কর পছন দ

এছাড়াও পড়ুন:

শরীয়তপুরের জাজিরায় আবারও সংঘর্ষ, মুহুর্মুহু ককটেল বিস্ফোরণ

শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় শতাধিক ককটেল (হাতবোমা) বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

গতকাল রোববার দুপুরে জয়নগর ইউনিয়নের ছাব্বিশপারা এলাকায় এ সংঘর্ষ হয়। এতে এক তরুণের হাতের কব্জিতে গুরুতর ক্ষত হয় এবং আরও একজন আহত হন।

জাজিরা থানা ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জয়নগর ইউনিয়নের ছাব্বিশপারা এলাকায় তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিঠুন ঢালী ও জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য হালিম তালুকদারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এই দুই নেতা আত্মগোপনে গেলে স্থানীয় পর্যায়ে তাদের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জসিম তালুকদার ও নুর আলম সরদার।

রোববার দুপুরে দুই পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্র ও ককটেল নিয়ে সংঘর্ষের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় নুর আলম সরদারের অনুসারীরা প্রতিপক্ষের ওপর ককটেল বোমা নিক্ষেপ করে। এরপর উভয় পক্ষ ঘণ্টা-ব্যাপী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ককটেল বিস্ফোরণ ও মারামারি। পরে পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

সংঘর্ষের কিছু দৃশ্য স্থানীয় এক ব্যক্তির সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ হয়, যা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ৪ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডের সেই ভিডিওতে দেখা যায়, এক পক্ষের সমর্থকরা বালতিতে করে ককটেল নিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে নিক্ষেপ করছেন। তাদের হাতে ছিল টেঁটা, রামদা, ছেনদা, বল্লম, ডাল-সুরকি ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র।

সম্প্রতি জাজিরার বিলাশপুরে সংঘর্ষের ঘটনায় খইয়ের মতো ককটেল বিস্ফোরণ দেশজুড়ে আলোচিত হয়। গত ৫ এপ্রিল সেখানে দুই শতাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যা এখনও আলোচনায় রয়েছে। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলো ছাব্বিশপারা এলাকায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দুলাল আখন্দ বলেন, গতকাল দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বেশ কিছু হাতবোমা বিস্ফোরিত হয় বলে জানতে পেরেছি। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এ ঘটনায় একটি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ