রাজনীতিটাই যেন করে জাতীয় নাগরিক পার্টি
Published: 13th, March 2025 GMT
নাহিদ ইসলাম উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য: দল–মতনির্বিশেষে মানুষ রাজনীতির মাঠে সাফল্যের জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন তাঁকে। আমরা বেশ আগে থেকেই জানতাম এবং দেখলাম, তিনি দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন ‘ছাত্রদের দল’ জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি)। তাঁর সঙ্গে নেতৃত্বের পর্যায়ে যুক্ত হয়েছেন আরও অনেক তরুণ, যাঁরা আমাদের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে ছিলেন সামনের সারিতে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার সময় আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগীরা ছাড়া আর সব রাজনৈতিক দল শুভকামনা জানাতে গিয়েছিল তাদের। বলা বাহুল্য, রাজনীতির মাঠে সাফল্য পাওয়ার জন্য শুভকামনাই যথেষ্ট নয়। তাঁরা নেমেছেন এক কঠোর লড়াইয়ে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেউ নিজস্ব স্বার্থের অঙ্কের বাইরে তাঁদের ছাড় দেবেন না বিন্দুমাত্রও।
বেশ কঠিন একটা পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া দলটি কতটা সফল হতে পারবে? নবগঠিত দলটির নেতা-কর্মীদের মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে সফল হওয়ার জন্য রাজনীতিই করতে হবে তাঁদের। কেন ‘রাজনীতিই’ করার কথা বলছি, সেই প্রসঙ্গে আসব কলামের শেষ অংশে।
আরও পড়ুনসেকেন্ড রিপাবলিক, একটা বাক্যবিলাস ছাড়া আর কিছু নয়১০ মার্চ ২০২৫যে সময়টায় ভারতে আম আদমি পার্টির মতো একটা দল তৈরি হয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে দিল্লির মতো জায়গায় নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গিয়েছিল, সেই সময়ে বাংলাদেশেও এই আলাপ কেউ কেউ তোলার চেষ্টা করেছেন, এই ধাঁচের জনকল্যাণমুখী একটা দল কেন বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে না।
আমি বিশ্বাস করি, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাকালীন আসলে নতুন কোনো রাজনৈতিক দল তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি ছিল না। একটা রাষ্ট্রে যখন রাজনীতিই থাকে না, যখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে ভয়ংকরতম বল প্রয়োগ করে একটা মাফিয়া রেজিম ক্ষমতা দখল করে রাখে, তখন রাজনৈতিক দল তৈরি হওয়া এবং সেটার বেড়ে ওঠার কোনো কারণ নেই। সেই প্রেক্ষাপটে অসাধারণ সব মানুষ একত্র হয়ে দুর্দান্ত সব কর্মসূচি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হলেও জনগণ তাঁদের আস্থায় রাখতে পারতেন না।
কারণ, ভোটের মধ্য দিয়ে কোনো দলকে নির্বাচিত করার ক্ষমতাই ছিল না তাদের হাতে। সেই প্রেক্ষাপটে এমন একটি দলের প্রয়োজন ছিল, যেটি বিরাট জনশক্তির জোরে তীব্র গণ-আন্দোলন তৈরি করার মাধ্যমে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারবে। সেই পরিস্থিতির অবসান হলো এবং প্রায় দুই দশক পর গণতান্ত্রিকভাবে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি হওয়া এবং তার বেড়ে ওঠার অনুকূল পরিবেশ এখন বিরাজ করছে বাংলাদেশে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির সাফল্যের আলোচনায় অনেকেই সামনে আনছেন এই দলের নেতৃত্বকে, যাঁরা শেখ হাসিনার মতো এক ভয়ংকর স্বৈরশাসকের পতন ঘটানো গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে ছিলেন। দেওয়া হচ্ছে এই যুক্তি, যেহেতু এত
বড় একটি কাজ তাঁরা করতে পেরেছেন, একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করে সাফল্য পাওয়া তাঁদের কাছে তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ কাজ।
একটা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটানোর দক্ষতা আর একটা রাজনৈতিক দল তৈরি করার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের তৃণমূল পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়ার দক্ষতা ভিন্ন। প্রথম দক্ষতাটি কারও থাকলে তাদের দ্বিতীয় দক্ষতা থাকতে পারবে না, এমনটা নয়। কিন্তু প্রথম দক্ষতাটি কোনোভাবেই দ্বিতীয় দক্ষতাটি থাকার নিশ্চয়তা দেয় না।
গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারে তিনজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন এবং সরকারের বাইরে থাকা সমন্বয়কদেরও সরকারের ওপরে প্রভাব খাটানোর আলোচনা আছে, তাই জাতীয় নাগরিক পার্টির সামনে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তারা যে সরকারের সমর্থনে তৈরি হওয়া কোনো দল (প্রচলিত ভাষায় ‘কিংস পার্টি’) নয়, সেটা প্রমাণ করতে পারা।
জাতীয় নাগরিক পার্টি নিশ্চয়ই জানে, রাজনীতিতে বাস্তবতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পারসেপশন। দলে যোগ দেওয়ার জন্য পদত্যাগ করার আগপর্যন্ত যত দিন নাহিদ ইসলাম সরকারের অংশ ছিলেন, তত দিন তাঁর মনে গঠিত হতে যাওয়া দলটি ছিল না, সেটা হতে পারে না। একই কথা প্রযোজ্য বাকি দুই ছাত্র উপদেষ্টার ক্ষেত্রে, যাঁদের ভবিষ্যতে কখনো পদত্যাগ করে জাতীয় নাগরিক পার্টিতে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা বেশ প্রবল।
এই ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে গিয়ে সরকার থেকে পদত্যাগ করার যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, সেটা যথেষ্ট নয়। ধরে নেওয়া যাক, সরকারের তিনজন উপদেষ্টা ঘোষণা করলেন, তাঁরা বিএনপিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন; কিন্তু সরকারে থেকে তাঁরা সেখানে যাবেন না। বিএনপিতে যোগ দেওয়ার আগে অবশ্যই তাঁরা সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন। এমন একটা পরিস্থিতি কি গ্রহণযোগ্য হবে?
শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর গণতান্ত্রিক উত্তরণের একটি পথরেখা মোটামুটি দৃশ্যমান। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ ধরনের পথরেখা বারবার দেওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে নানা ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলছে। নানা চটকদার আলাপের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা আছে একটি প্রভাবশালী পক্ষের দিক থেকে। তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে এনসিপির বক্তব্যের অনেক ক্ষেত্রে মিলকে নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার বলে অনেকেই মনে করেন না।আমাদের দেশে ‘কিংস পার্টি’ গঠন করার সাম্প্রতিক উদাহরণটি এক–এগারোর সময়কার। ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীর প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টি (পিডিপি) সে সময়কার বেসামরিক মুখোশপরা সেনাশাসকদের তত্ত্বাবধানে তৈরি হওয়া দল ছিল। কোরেশীর বেশ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার থাকলেও সেই মুহূর্তে তিনি ছিলেন জনপরিসরে প্রায় অপরিচিত। তাঁর দলটি ব্যর্থ হয়েছিল।
সেই তুলনায় এনসিপি দলটি যাঁদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে, কিছুদিন আগেই জনগণ দেখেছিল তাঁরা জীবন বাজি রেখে শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তাঁদের প্রতি জনগণের যে আবেগ, তাঁরা সেটা সাংগঠনিক শক্তি এবং ভোটের অঙ্কে রূপান্তরিত করতে পারবেন কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।
এনসিপির সবচেয়ে বড় সংকট হবে সম্ভবত নিজেদের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ। শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলনের ক্ষেত্রে যেহেতু ডানপন্থী থেকে শুরু করে বামপন্থী পর্যন্ত সব ধরনের মানুষ অংশ নিয়েছে, দলটি চেয়েছে তাদের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলতে। এর জন্য একটা কার্যকর রাজনৈতিক পথ তাঁরা বেছে নিয়েছেন—মধ্যপন্থা।
আদর্শগত অবস্থানকে এড়িয়ে জনকল্যাণকে প্রধান করে তোলার মধ্য দিয়ে রাজনীতি তাদের এই বিরোধকে এড়াতে সাহায্য করার কথা। কিন্তু আমরা দলটি গঠন হওয়ার প্রাক্কালেই দেখেছি, আদর্শগত বিরোধ মাথা চাড়া দিয়েছে। নিজেদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ বিরোধ প্রকাশ্য হয়েছে। দলটিতে ‘এক্স-শিবির’ কোন ধরনের পদে থাকবেন, সেটা নিয়ে তীব্র টানাপোড়েনের মধ্যেই দুজন আলোচিত সাবেক শিবির নেতা (আলী আহসান জুনায়েদ ও রাফে সালমান রিফাত), যাঁরা উভয়েই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির সভাপতি, দলেই আর যোগ দেননি।
বাংলাদেশের বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে যেভাবে আদর্শগত বিরোধ নানা ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই পরিকল্পিতভাবে উসকে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে দলটি এই লড়াই থেকে কতটা দূরে থাকতে পারবে, সেটা খুব বড় একটা প্রশ্ন।
আরও পড়ুননতুন দলের সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে যে প্রশ্ন০৫ মার্চ ২০২৫এনসিপি আক্ষরিক অর্থেই তরুণদের দল। দেশে গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা তরুণদের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছেন বিদেশে থাকা অনেক তরুণ, যাঁরা খুবই চমৎকার সব পেশা ছেড়ে দেশে চলে এসেছেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন অনাবাসী অনেক বাংলাদেশি, যাঁরা বিদেশে থেকেই অ্যাকটিভিজম করছেন, তহবিল সংগ্রহ করছেন। তরুণদের প্রাণশক্তি দলটির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে এই দলকে খুব ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
কিন্তু ওদিকে আবার ‘ছাত্রদের দল’ ট্যাগটি এই দলের একটা দুর্বলতা হিসেবেও হাজির হতে পারে। অনভিজ্ঞ, অপরিণত মানুষদের দল এটি—এমন ধারণা এই দলের প্রতি নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশের মতো অতি জটিল রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপটের একটা দেশে শুধু জ্ঞান, বুদ্ধি, মেধাই যথেষ্ট নয়, দীর্ঘ অভিজ্ঞতাও রাজনীতির ক্ষেত্রে সফল হওয়ার একটি বড় পূর্বশর্ত।
তীব্র গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার পতন এবং ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিএনপি এখন এমন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মাঠে আছে, যাকে ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জ করার মতো কার্যত কেউ নেই। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে এটা মোটামুটি নিশ্চিত—বিএনপিই ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যাচ্ছে। রাজনীতিতে শূন্যস্থান থাকে না। রাজনীতির মাঠে বিএনপির প্রায় একচ্ছত্র অবস্থা থাকবে না, তাকে ভোটের রাজনীতিতেই চ্যালেঞ্জ করতে পারবে, এমন একটি দল আসবেই। এই মুহূর্তের সাংগঠনিক শক্তির বিচারে বিকল্প হিসেবে সামনে থাকছে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামপন্থী পরিচয়বাদী রাজনীতি। আমি বিশ্বাস করি, এর কোনোটিই এই রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য জুতসই হবে না। জনগণের জন্য চমৎকার বিষয় হবে, একটি মধ্যপন্থী দলের শক্তিশালী হয়ে ওঠা, যেটি সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ মনোযোগসহ সব জনগণের কল্যাণ নিশ্চিতে কাজ করবে। এই ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক পার্টিকেও তার লক্ষ্য, আদর্শ ও কর্মসূচি জনগণের সামনে সহজবোধ্য ভাষায় দ্রুতই হাজির করতে হবে।
শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর গণতান্ত্রিক উত্তরণের একটি পথরেখা মোটামুটি দৃশ্যমান। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ ধরনের পথরেখা বারবার দেওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে নানা ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলছে। নানা চটকদার আলাপের মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা আছে একটি প্রভাবশালী পক্ষের দিক থেকে। তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে এনসিপির বক্তব্যের অনেক ক্ষেত্রে মিলকে নেহাত কাকতালীয় ব্যাপার বলে অনেকেই মনে করেন না।
রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্রের অংশ হওয়ার আকসার উদাহরণ থাকা এই দেশে আশা করি এনসিপি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে কোনো ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হবে না। দলটি যেন রাজনীতিই করে। এটাই দীর্ঘ মেয়াদে দলটির নিজের এবং রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর।
● জাহেদ উর রহমান রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত র ন র জন ত র জন ত ই র জন ত ত পর স থ ত সরক র র এনস প র উপদ ষ ট জনগণ র র স মন কল য ণ স ফল য র জন য হওয় র ইসল ম ন একট র একট আদর শ ক ষমত ধরন র ব এনপ র পতন
এছাড়াও পড়ুন:
তরুণরাই মোড় পরিবর্তনের দিশারি
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ইতিহাসের নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। জনগণের সামনে আবারও এসেছে গণতান্ত্রিক, স্বাধীন ও বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার সুযোগ। দেড় হাজার শহীদের রক্ত এবং অসংখ্য ছাত্র-জনতার অঙ্গহানির বিনিময়ে যে নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা চব্বিশে রচিত হলো, তা ৫ আগস্টের কয়েক দিন আগেও ছিল প্রায় অসম্ভব কল্পনা।
সিন্দাবাদের ভূতের মতো আমাদের ঘাড়ে চেপে বসা ফ্যাসিস্ট শাসন অপরাজেয় ও দুর্লঙ্ঘ একথা ভেবে বসেছিলেন অনেকেই। বিশেষ করে ৭ জানুয়ারির ডামি নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে আশাহত হয়ে পড়ছিলেন অনেকেই। ভেবেছিলেন, এই ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের ভবিতব্য। কিন্তু ইতিহাসের ললাটে গোপনে লিখিত হয়ে গিয়েছিল আরেক গন্তব্য। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলন জেগে উঠেছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে।
অবশ্য বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র জাগরণ, ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থান নতুন কিছু নয়। বরং এটাই যেন নিয়ম। যখনই দেশ কোনো গভীর সংকটে নিপতিত হয়, সব আশা নিঃশেষিত হয়ে যায়, তখন ছাত্ররা সামনে চলে আসে। তাদের ডাকে আপামর জনতা পথে নামে।
এটা হয়তো আমাদের কৃষি অধ্যুষিত সমাজের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। একটা বিশেষ মনোগঠন। যে মনোগঠনের কেন্দ্রে আছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্পর্কে এক আশাপ্রদ রূপকল্প। কৃষক সমাজে বহু বছর ধরে এই রূপকল্প প্রচলিত যে ভবিষ্যতে তাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া সন্তানটি পরিবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করবে। পরিবারটিকে নতুন এক ভবিষ্যতের দিকে পরিচালনা করবে। এই রূপকল্প আজও জাগরূক। শুধু গ্রামীণ সমাজে নয়, গ্রাম থেকে আসা শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজেও পরিবারগুলো বিশ্বাস করে, ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে পরিবারের দায়িত্ব নেবে এবং ভাগ্য ফেরাবে।
পরিবারগুলোর এই খণ্ড খণ্ড স্বপ্ন হয়তো ইতিহাসের বিশেষ দিনক্ষণে যৌথ স্বপ্নে পরিণত হয়। জনগণের একটি বড় অংশ সমস্বরে জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণের দায়িত্ব ছাত্রদের হাতে তুলে দেয় অথবা ছাত্ররা সেই দায়িত্ব তুলে নিলে জনসাধারণের পক্ষ থেকে এক বাক্যে তাতে সমর্থন জানিয়ে দেওয়া হয়।
আমরা ১৯৫২ সালে, ১৯৬৯ সালে, ১৯৯০ সালে এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি। যখনই জাতি কোনো গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে এবং সেই সংকট থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছে ছাত্ররা, তখনই সাধারণ জনগণ জেগে উঠেছে। প্রশ্নহীনভাবে পথে নেমে সংকট থেকে জাতিকে উদ্ধার করেছে।
তবে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান আগের গণঅভ্যুত্থান ও আন্দোলনগুলোর চেয়ে অনেক বিস্তৃত ও গভীর ছিল। হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। ছাত্ররা প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছিল যে তারা সত্যিই পরিবর্তন চায়। সেই প্রাণের বিনিময়ে মানুষ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছিল। জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে ফ্যাসিস্টদের তাড়িয়ে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছিল।
আমরা এখন সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে গেছি। তরুণরা তাদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন ও পুনর্গঠনের যে রূপরেখা হাজির করেছিল, তা নিয়ে চারদিকে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার অভূতপূর্ব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে চলেছে। সংস্কারের জন্য চলছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। দ্বিমত অবশ্যই থাকবে। সমাজে নানা মত থাকলে নানা পথও থাকবে। কিন্তু তরুণরা এমন এক বাস্তবতা তৈরি করেছে, মানুষের মনে এমন এক স্বপ্ন জাগিয়ে দিয়েছে– যা থেকে ফিরে আসা খুব কঠিন।
পুনর্গঠিত নতুন এক বাংলাদেশ তৈরি না হলে এবার বিপুলভাবে আশাহত হয়ে পড়বে জাতি। ফলে এই কর্মযজ্ঞকে সফল করে তুলতে হবে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, গণজাগরণের মধ্য দিয়ে তরুণরা যে স্বপ্ন বপন করেছে, তাকে জাগরূক রাখতে হবে। স্মরণে, উদযাপনে তারুণ্যের শক্তি যেন বাংলাদেশকে নতুন অভিযাত্রায় নিয়ে যেতে পারে সেজন্য যে কোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
হার না মানা যে শহীদেরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, তাদের কথা মনে রেখে সহযোদ্ধাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে তারুণ্যের উৎসবে পরিণত করতে হবে।
মাহবুব মোর্শেদ: লেখক ও সাংবাদিক