এলডিসি থেকে বের না হতে চাওয়া কতটা সঠিক
Published: 13th, March 2025 GMT
পাঁচ দশক ধরে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় আছে বাংলাদেশ। এলডিসিতে থাকা দেশগুলো মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে পিছিয়ে থাকা দেশ। স্বল্পোন্নত দেশগুলো যাতে এগিয়ে যেতে পারে এবং নিজেদের উন্নতি করতে পারে, সে জন্য উন্নত দেশগুলো নানা ধরনের সুবিধা দেয়।
বাংলাদেশ নানা ধরনের যাচাই–বাছাই পেরিয়ে ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য সময় নির্ধারণ করেছে। তবে বাংলাদেশ এখন এই সময়সীমা কিছুটা পিছিয়ে দিতে চায়।
এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে একটি দেশের মানমর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হয়। এতে বিদেশি বিনিয়োগকারী আস্থা রাখতে পারেন। একটি দেশের সমৃদ্ধি বিবেচনা করা হয় দেশটি কোন শ্রেণিতে আছে, এর ওপর।
অন্যদিকে এলডিসি তালিকায় থাকলে ওই দেশকে নানা ধরনের সুবিধা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় উন্নত দেশগুলো। এটি অনেকটা পরনির্ভরশীলতায় থাকার মতো বিষয়।
অধ্যাপক নুরুল ইসলামের প্রচেষ্টায়
১৯৭১ সাল থেকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৩ সাল থেকে এলডিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য দর-কষাকষি শুরু করে বাংলাদেশ। প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নুরুল ইসলামের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালে প্রথম এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ। এলডিসিভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য–সুবিধাসহ নানা সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বর্তমান যে অগ্রগতি, তার মূল কারণ এই এলডিসিভুক্তি।
জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, ছোট দ্বীপপুঞ্জ, ভূবেষ্টিত দেশ—এসব বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এলডিসিতে তালিকাভুক্ত করে জাতিসংঘ। কিন্তু বাংলাদেশ এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ছিল না। বাংলাদেশকে জনসংখ্যার আধিক্যের বিচারে অর্থনৈতিক সক্ষমতা কম—এমন বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়েছিল জাতিসংঘ।
এলডিসি কী ও কারা
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে উন্নয়নশীল ও উন্নত—এই দুই শ্রেণিতে সব দেশকে ভাগ করে থাকে জাতিসংঘ। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যে দেশগুলো তুলনামূলক দুর্বল, তাদের নিয়ে ১৯৭১ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা হয়। স্বল্পোন্নত দেশ হলেও এসব দেশও একধরনের উন্নয়নশীল দেশ।
সময় পেছানো হলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এমন ধারণা জন্মাবে যে আমরা আফগানিস্তানের মতো অযোগ্য দেশদেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সদস্য, সিডিপিবর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, বুরুন্ডি, কম্বোডিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, চাদ, কমরোস, কঙ্গো, জিবুতি, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, গিনি বিসাউ, হাইতি, কিরিবাতি, লাওস, লেসেতে, লাইবেরিয়া, মাদাগাস্কার, মালাউই, মালি, মৌরিতানিয়া, মোজাম্বিক, মিয়ানমার, নেপাল, নাইজার, রুয়ান্ডা, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, সুদান, তিমুর, টোগো, টুভালু, উগান্ডা, তানজানিয়া, ইয়েমেন ও জাম্বিয়া।
এলডিসি থেকে উত্তরণের নিয়ম
এলডিসি থেকে কোনো দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এ জন্য প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যেকোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।
সিডিপি পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক মূল্যায়নে এসব মান অর্জন করলেই এলডিসি থেকে বের হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ করে সিডিপি। সিডিপির সুপারিশ প্রথমে জাতিসংঘের ইকোসকে যায়। প্রস্তুতির জন্য তিন বছর সময় দেওয়া হয়। তিন বছর পর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অনুমোদনের জন্য ওঠে। এরপর চূড়ান্তভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণের হয়ে যায় ওই দেশ। এ প্রক্রিয়ায় এই দেশটির ইচ্ছা-অনিচ্ছার খুব একটা প্রভাব থাকে না।
বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে পারে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে প্রস্তুতির জন্য আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে উত্তীর্ণ হয়, তাহলে বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ, যারা তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে বের হবে। অবশ্য বাংলাদেশ এখন এলডিসি থেকে উত্তরণের সময় আরও পেছাতে চায়।
উত্তরণের যত সুবিধা-অসুবিধা
এলডিসি থেকে বের হলে সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হবে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে। কারণ, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য–সুবিধা পায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তো আঞ্চলিক বা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও (যেমন ভারত, চীন) এ ধরনের শুল্ক–সুবিধা পেয়ে থাকে। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ২০২৬ সালে এসব সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপির আওতায় এই শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকবে ২০২৯ সাল পর্যন্ত।
বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধশিল্প। এলডিসি থেকে বের হলে ওষুধশিল্পের ওপর মেধাস্বত্ব বিধিবিধান আরও কড়াকড়ি হবে। এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে মেধাস্বত্বের জন্য অর্থ দিতে দিতে হয় না। এ কারণে এলডিসির গরিব নাগরিকেরা স্বল্প মূল্যে ওষুধ পায়। ২০৩৩ সালের আগে কোনো দেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে ওষুধশিল্পের এই সুবিধা থাকবে না।
এলডিসি হিসেবে যেকোনো দেশ তার দেশে উৎপাদিত পণ্য বা সেবার ওপর নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন যে রপ্তানি আয় বা রেমিট্যান্স আনায় নগদ সহায়তা দেয়, তা নিয়ে আপত্তি উঠতে পারে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলো আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে সহজ শর্তের ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হতে পারে।
এলডিসি থেকে বের হলে জাতিসংঘে চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের বৃত্তি দেয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এ ধরনের বৃত্তির সংখ্যা কমে যাবে।
• ১৯৭৫ সালে প্রথম এলডিসি তালিকায় যুক্ত হয় বাংলাদেশ• বাংলাদেশই হবে প্রথম দেশ, যারা তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে উত্তরণ হবে
• গত পাঁচ দশকে মাত্র আটটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়
• অপেক্ষায় আছে বাংলাদেশসহ ছয় দেশ
• বর্তমানে ৪৪টি দেশ এলডিসি তালিকাভুক্ত
এবার দেখা যাক, এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে কী ধরনের লাভ হতে পারে। এলডিসি থেকে বের হলে প্রথমে যে লাভটি হবে, তা হলো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। গরিব বা স্বল্পোন্নত দেশের তকমা থাকবে না। অর্থনৈতিক সক্ষমতার কারণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বেশি সুদে অনেক বেশি ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়বে।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলডিসি উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত নই। বর্তমান যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে এলডিসি উত্তরণ পেছানো দরকার। এ ছাড়া আগের সরকারের সময় উত্তরণের সূচকগুলোতে ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে তথ্য দেওয়া হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে।’
শ্বেতপত্রে উত্তরণের পক্ষে সুপারিশ
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এ প্রতিবেদনে ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণের পক্ষে সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এলডিসি উত্তরণের পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য এখনো স্বস্তিদায়ক। যেসব সূচকের ওপর ভিত্তি করে এলডিসি উত্তরণ হয়, তা বেশ সুসংহত। কিন্তু অর্থনীতি কিছু সূচক ফুলিয়ে–ফাঁপিয়ে দেখানোর জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে, তা এলডিসি উত্তরণের সূচকগুলোর সঙ্গে কমই সম্পৃক্ত। যদি কোনো দেশের সরকার এসব তথ্য–উপাত্ত সংশোধন করে, তখনই শুধু জাতিসংঘ উত্তরণের সূচকগুলো পর্যালোচনা করে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কিছু গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এলডিসি উত্তরণ নিয়ে আপত্তি করা হচ্ছে। কিন্তু এই উত্তরণ পিছিয়ে দেওয়ার মতো বিশ্বাসযোগ্য কোনো কারণ নেই। এ ছাড়া এলডিসি উত্তরণে পিছিয়ে দেওয়া হলেও তা কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিও অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
এদিকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের সর্বশেষ সিডিপির পর্যালোচনা সভা যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এলডিসি উত্তরণ হবে, এমন দেশগুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়। সেখানে বাংলাদেশ ভালো ও সঠিক পথে আছে বলেই মত দেওয়া হয় বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের দৃষ্টিভঙ্গি
কোন কোন দেশ এলডিসি থেকে উত্তরণ হবে, এই উত্তরণপ্রক্রিয়ার মূল কাজটি করে থাকেন জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। দীর্ঘদিন ধরে সিডিপি সদস্য হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণপ্রক্রিয়ায় নিবিড়ভাবে জড়িত আছেন তিনি।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেকোনো শিক্ষিত মানুষ এলডিসি উত্তরণ চাইবে। কিন্তু এলডিসি উত্তরণ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো দেশের জন্য ক্ষতিকারক। আমরা আবেদন করে যোগ্য হইনি, আন্তর্জাতিক বিচারে প্রতিষ্ঠিত মাপকাঠিতে যোগ্য হয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, শ্বেতপত্রেও বলা হয়েছে, তথ্যের বিকৃতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ মানদণ্ডের বিচারে ওপরে আছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণ পেছাতে হলে সরকারপ্রধানকে সিডিপিতে লিখতে হবে, কী এমন ঘটনা ঘটেছে, যার জন্য এলডিসি পেছানোর ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, ‘সময় পেছানো হলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এমন ধারণা জন্মাবে যে আমরা আফগানিস্তানের মতো অযোগ্য দেশ। কারণ, তত দিনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপালও এলডিসি থেকে উত্তরণ হয়ে যাবে।’
৫০ বছরে আট দেশ
ষাটের দশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) ধারণাটি আসে। তবে ১৯৭১ সালে প্রথম স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা করা হয়। এ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকে সব মিলিয়ে মাত্র আটটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে। দেশগুলো হলো ভুটান, বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, ইকুইটোরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ, সামোয়া, ভানুয়াতু, সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ।
১৯৭১ সালে এলডিসির তালিকা হওয়ার ২৩ বছর পর ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথম দেশ হিসেবে বতসোয়ানা উত্তরণ করে। আর সর্বশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ অষ্টম দেশ হিসেবে এলডিসি থেকে বের হয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বের হয় ভুটান।
আগামী পাঁচ বছরে এলডিসি তালিকা থেকে বের হতে অপেক্ষায় ছয়টি দেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় আরও দুটি দেশ লাওস ও নেপাল আছে। কম্বোডিয়া ও সেনেগাল ২০২৯ সালে এলডিসি থেকে বের হওয়ার কথা আছে। নিজেদের অক্ষমতার কথা জানিয়ে সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এলডিসি থেকে বের হওয়ার সময় বাড়ানোর আবেদন করেছিল। এখন ২০২৭ সালে ওই দেশ এলডিসি থেকে বের হবে।
এলডিসি, উন্নয়নশীল দেশ ও মধ্যম আয়ের দেশ কী
এলডিসি, উন্নয়নশীল দেশ ও মধ্যম আয়ের দেশ—এসব দেশের সংজ্ঞা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। কোন দেশ কোন শ্রেণিতে, তা নিয়ে অনেকের পরিষ্কার ধারণা কম। এবার বিষয়টি পরিষ্কার করা যাক।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে উন্নয়নশীল ও উন্নত—এই দুই শ্রেণিতে সব দেশকে ভাগ করে থাকে জাতিসংঘ। আবার উন্নয়নশীলগুলোর মধ্যে যেসব দেশ দুর্বল, সেসব দেশকে এলডিসি তালিকাভুক্ত করা হয়। ওই দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেসব দেশকে এলডিসি থেকে বের করে দেওয়া হয়।
মনে রাখতে হবে, এলডিসি দেশগুলোও একধরনের উন্নয়নশীল দেশ। এসব দেশকে সাহায্য–সহযোগিতা দিয়ে তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করা হয়। বাংলাদেশ এখনো এলডিসি।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক শুধু মাথাপিছু আয়ের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশকে শ্রেণিভুক্ত করে। শ্রেণিগুলো হলো নিম্ন আয়ের দেশ; মধ্যম আয়ের দেশ এবং উচ্চ আয়ের দেশ।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, বর্তমানে কোনো দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৪৫ মার্কিন ডলারের কম হলে সেটি নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এ ছাড়া মাথাপিছু আয় ১ হাজার ১৪৬ থেকে ৪ হাজার ৫১৫ ডলার হলে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ এবং ৪ হাজার ৫১৬ থেকে ১৪ হাজার ৫ ডলার হলে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গণ্য হয়। আর ১৫ হাজার ৫ ডলারের বেশি মাথাপিছু আয় হলে উচ্চ আয়ের দেশ চিহ্নিত হয়। বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ।
জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশ। আবার নিম্নমধ্যম আয়ের দেশও বাংলাদেশ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ শ এলড স ব র হওয় র শ ব তপত র ল দ শ এখন ২০২৬ স ল পর স থ ত র এলড স র জন য সব দ শ ত ক পর ব র হয় ব র হল ওই দ শ বছর প প রথম র সময় ধরন র র ওপর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত
দেশে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক হারে উর্ধ্বমুখী। কিডনি রোগের কারণে শুধু ব্যক্তিগত জীবনই বিপর্যস্ত হয় না বরং এই রোগ পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপরও বিশাল অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে। কিডনি রোগের মারাত্মক পরিণতি, অতিরিক্ত চিকিৎসা খরচ এবং চিকিৎসা ব্যয় সাধ্যাতীত হওয়ায় সিংহভাগ রোগী প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।
বিশ্ব কিডনি দিবস-২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটির (ক্যাম্পস) আয়োজনে আজ মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণ: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এমন তথ্য জানান।
গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ক্যাম্পস-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ। তিনি তার মূল প্রবন্ধে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, কিডনি রোগ বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে একটি। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কিডনি রোগের প্রকোপ বাড়ছে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতার মতো অসংক্রামক রোগের কারণে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এই সংখ্যা ডায়াবেটিস রোগীদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ এবং ক্যান্সার রোগীদের চেয়ে প্রায় বিশ গুণ। মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ ১৯৯০ সালে ছিল ১৯তম স্থানে, বর্তমানে দাঁড়িয়েছে সপ্তম স্থানে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে দখল করে নেবে পঞ্চম স্থান। আবার উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে কিডনি রোগের হার সবচেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশেও কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক। তথ্য মতে, প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ লোক কোনো না কোনো কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কিডনি রোগী ডায়ালাইসিসের ওপর নির্ভরশীল হয়। শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানভাবে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। দারিদ্র্য, অসচেতনতা, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা এবং অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। আরও ২৪ থেকে ৩০ হাজার রোগী হঠাৎ কিডনি বিকল হয়ে সাময়িক ডায়ালাইসিস প্রয়োজন হয়। এই রোগ আমাদের দেশের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা। পক্ষান্তরে, সবাই যদি কিডনি রোগের ব্যাপকতা, ভয়াবহতা, পরিণতি ও কারণ সম্পর্কে সচেতন থাকে এবং স্বাস্থ্য সম্মত জীবনযাপন করে তা হলে ৬০-৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এই মরণঘাতী কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কিডনি রোগের সাধারণ কারণগুলো হলো- অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্থূলতা, নেফ্রাইটিস, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, ব্যাথানাশক ঔষধের অতিরিক্ত ব্যবহার, জন্মগত ও বংশগত কিডনি রোগ, মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ ও পাথুরে রোগী। আমরা একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবো যে, প্রায় সবগুলো কারণই আমাদের অস্বাস্থ্যকর জীবন ধারার সঙ্গে জড়িত, একটু সচেতন হলে প্রতিরোধ যোগ্য। তাছাড়া যারা ঝুঁকিতে আছেন যেমন যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ওজন বেশি, বংশে কিডনি রোগ আছে, যারা ধূমপায়ী, যারা তীব্র মাত্রার ব্যাথার ঔষধ খেয়েছেন, যাদের পূর্বে কোনো কিডনি রোগের ঝুঁকি আছে তাদের বছরে অন্তত ২ বার প্রস্রাব ও রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করে নেওয়া উচিৎ। কেননা প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ শনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ডা. সামাদ বলেন, কিডনি বিকলের চিকিৎসা সর্বাধিক ব্যয়বহুল। ফলে চিকিৎসা করতে গিয়ে পুরো পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। তাই ক্যাম্পস এর স্লোগান ‘কিডনি রোগ জীবননাশা-প্রতিরোধই বাঁচার আশা’ ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে চাই। অর্থাৎ কিডনি রোগ প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করে চিকিৎসার মাধ্যমে মরণব্যাধি কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা যায়। এর জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা।