রাজস্ব আহরণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন জাতীয় রাজস্ব নীতি বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মাধ্যমে ৫৩ বছরের এ সংস্থা বিলুপ্ত হবে।

উপদেষ্টা পরিষদে তা চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে কমিটি গঠনের মাধ্যমে চেয়ারম্যান নিয়োগ হবে। এর ফলে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগে বন্ধ হবে সরকারের হস্তক্ষেপ। একক ইচ্ছায় কাউকে ওএসডি বা চাকরিচ্যুত করা যাবে না। 

গত ১৬ জানুয়ারি উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বিদ্যমান এনবিআরকে ভেঙে দুটি বিভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা এ দুটি কার্যক্রমকে পৃথক্‌করণের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। দুই বিভাগের সচিব হবেন আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা। তারা সচিব বা জ্যেষ্ঠ সচিবের মর্যাদা পাবেন। নীতি বোর্ডের সদস্যরা পদমর্যাদা পাবেন গ্রেড-১।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান এই বোর্ডের প্রশাসন, আর্থিক, উন্নয়ন ও সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করবেন। দেখভাল করবেন বোর্ড সদস্যদের কাজ। তিনি বোর্ড সভা ও উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে সভারও আয়োজন করবেন। চেয়ারম্যানকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এই অধ্যাদেশে সংজ্ঞায়িত বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর অনুবিভাগের দু’জন এবং শুল্ক, মূসক ও আবগারি অনুবিভাগের দু’জন করে কর্মকর্তা নীতি বোর্ডের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পাবেন। তাদের এনবিআরের সদস্য বা কমিশনার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এতে বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে পারবেন না আমলারা। তবে স্বাধীনতার পর বেশির ভাগ সময় আমলারাই ছিলেন এনবিআরের চেয়ারম্যান। 

আইআরডির নিয়ন্ত্রণে থাকছে না বোর্ড

নতুন অধ্যাদেশ চূড়ান্তভাবে জারি হলে জাতীয় রাজস্ব নীতি বোর্ড আইআরডিতে সংযুক্ত থাকবে। কিন্তু কোনোভাবে অধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে না। আয়কর নীতি, কর নীতি, ভ্যাট নীতি ও শুল্ক নীতি প্রণয়ন এবং এসআরও, ব্যাখ্যা ও প্রজ্ঞাপন জারীকরণে রাজস্ব নীতি বোর্ডের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হবে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডার থেকে। সদস্য চারজন কাজ করবেন আয়কর নীতি ও গবেষণা, আন্তর্জাতিক ও অন্যান্য কর নীতি ও গবেষণা, ভ্যাট নীতি ও গবেষণা এবং শুদ্ধ নীতি ও গবেষণা বিষয়ে। 

বিদ্যমান নিয়মে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) অধীনে কাজ করছে এনবিআর। আইআরডি প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কর আরোপ ও আহরণ এবং এ-সংক্রান্ত আইন, বিধিবিধান প্রণয়ন-নবায়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করে। তবে আইআরডির সচিব একই সঙ্গে এনবিআরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এক ব্যক্তি দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ায় অভিযোগ আছে নানা জটিলতার। আইআরডির কাজ সম্পাদন করেন উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা। 
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সমকালকে বলেন, অভ‍্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কার্যকরভাবে আলাদা হলে সে ক্ষেত্রে একদিকে এনবিআর রাজস্ব নীতি বাস্তবায়নে অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করবে; অন্যদিকে আইআরডি রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী তার স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে পারবে। ভারতে একদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব বিভাগ এবং অন্যদিকে প্রত‍্যক্ষ কর বোর্ড ও পরোক্ষ কর বোর্ড এ কাজগুলো করে থাকে। স্বাধীনতা ও জবাবদিহি পরস্পরের পরিপূরক।

জানা যায়, শিগগির জাতীয় রাজস্ব নীতি বোর্ড অধ্যাদেশের খসড়া আইআরডি থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। এরপর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এই অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করবে। উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর তা কার্যকর হবে। একই সঙ্গে বিদ্যমান এনবিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে নতুন কাঠামো তৈরি করা হবে। সংশোধন হবে রুলস অব বিজনেস, অ্যালোকেশন অব বিজনেস, বিসিএস (কাস্টমস ও ট্যাক্স) কম্পোজিশন অ্যান্ড ক্যাডার রুলস-১৯৮০।

এদিকে গতকাল বুধবার এক অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ঈদের আগেই অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদে উঠবে এবং জারি হবে। কার্যক্রম শুরু হবে নতুন অর্থবছরের প্রথম থেকেই। প্রধান উপদেষ্টা গতকালও (মঙ্গলবার) ডেকে জানিয়েছেন ঈদের আগেই আলাদা হওয়ার বিষয়টি পাস হবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব নীতি বিভাগে যারা কাজ করবেন, তাদের এ বিষয়ে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা লাগবে। আমলাতান্ত্রিক নিয়মে না করে যোগ্যতা অনুযায়ী সঠিক ব্যক্তি নিয়োগ করতে হবে। রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন স্বতন্ত্র দুটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে কারও ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ না থাকে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদের নিয়োগে রাষ্ট্রকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ, সরকারি সিদ্ধান্তে নিয়োগ হলে আগের মতো পছন্দের ব্যক্তিরাই নিয়োগ হতে পারে। সরকারের ব্যক্তিরা যেহেতু নিজেই করদাতা, এ জন্য তারা তাদের সুবিধা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য লাগবে।

অস্ট্রেলিয়ার মতো নিয়োগ কমিটির প্রস্তাব

রাজস্ব নীতি সংস্কার-সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটি এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাদের প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ হয় সার্চ কমিটির মাধ্যমে। সার্চ কমিটিতে থাকেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতি। তারা সম্মিলিতভাবে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগের জন্য আগ্রহী প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেন। এর পর যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার তার নিয়োগ বাতিল করতে হলে সবার মতামত নিতে হয়। বাংলাদেশেও এভাবে রাজস্ব নীতির চেয়ারম্যান নিয়োগের প্রস্তাব করা হয়েছে। 

বাস্তবায়নে রয়েছে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ

এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রয়েছে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। কারণ, বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের পছন্দের ব্যক্তিরা হাজার হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেন। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বাধা দিতে পারেন। এর আগে ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে রাজস্ব প্রশাসন ও নীতি প্রণয়ন কার্যক্রম পৃথক করতে একটি আদেশ জারি করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার সেই সিদ্ধান্ত বাতিল বা স্থগিত না করে সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে। রাজস্ব নীতি সংস্কার-সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির একাধিক সদস্য সমকালকে বলেন, রাষ্ট্রের কল্যাণে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরি। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে শক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। যাতে হাকিম নড়বে, কিন্তু হুকুম নড়বে না। 

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, করদাতারা যাতে সহজে ও হয়রানিমুক্তভাবে কর দিতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। এ জন্য রাজস্ব খাতের সংস্কার জরুরি হয়ে গেছে। 

এনবিআরের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম তিন মাসে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগ ২৮৬ কোটি টাকার কর ফাঁকির ঘটনা খুঁজে পেয়েছে সংস্থাটি। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সবচেয়ে বেশি কর ফাঁকির তথ্য পেয়েছে ভ্যাট বিভাগ। এই খাতে সব মিলিয়ে ১৬৭ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য মিলেছে।
সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী সমকালকে বলেন, রাজস্ব ব্যবস্থাপনা একটি পেশাগত কাজ, কিন্তু সাধারণ হয়ে গেছে। এটা আলাদা করা জরুরি। এ জন্য পৃথক মানবসম্পদ বিভাগ করতে হবে। কেউ যেন হস্তক্ষেপ করতে না পারে। তবে রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন বিভাগ দুটি স্বতন্ত্র করতে হবে। এক বিভাগের জনবল যেন অন্য বিভাগে যেতে না পারে। কারণ, এখানে একটা স্বার্থের সংঘাত কাজ করে। তিনি বলেন, যোগ্যতার মাপকাঠি শুধু জ্যেষ্ঠতা হতে পারে না। যারা নীতি বিভাগে কাজ করবে, তাদের ২০ বছরের অভিজ্ঞতাসহ বিভিন্ন শর্ত রাখতে হবে। এ ছাড়া রাজস্ব সংগ্রহ যেন মূল লক্ষ্য না হয়; বরং অর্থনীতিতে সমতা, প্রবৃদ্ধি ও শিল্পায়নের বিষয়টি সামনে রাখতে হবে। 

নীতি প্রণয়নে সহায়তা করবে উপদেষ্টা পরিষদ

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বোর্ডের নীতি প্রণয়ন কাজে সহায়তা ও পরামর্শ প্রদানের জন্য সরকার প্রতিবছর অনধিক সাত সদস্যের একটি রাজস্ব নীতি-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবে। ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে সভা আয়োজন করবে বোর্ড। এর পর বোর্ডকে বিভিন্ন সুপারিশ প্রদান করা হবে। 
মুসলিম চৌধুরী বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা কোন খাতের হবেন, সেটি রুল বা বিধি দিয়ে স্পষ্ট করতে হবে। উপদেষ্টাদের বৈঠকে সম্মানী রাখা যেতে পারে। এতে তারা কাজে উৎসাহ পাবেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য কাজী মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদন হলে শুধু রাজস্ব খাতের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্য হতে পারবেন। চেয়ারম্যান নিয়োগ করবে উপদেষ্টা পরিষদ। তবে সংশ্লিষ্ট আইনবিধি সংশোধন করে বাস্তবায়ন কাজ শুরু করতে আরও চার থেকে পাঁচ মাস লাগবে। 
এনবিআর সংস্কারে গত ৯ অক্টোবর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এ কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কারকাজ শুরু হয়। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব র ড র সদস য কর মকর ত র জন ত ক সরক র র উপদ ষ ট প রণয়ন কর ন ত অন য য় ক জ কর ত র পর মন ত র কম ট র এ জন য বছর র করব ন

এছাড়াও পড়ুন:

সঠিক ডিপিপি প্রণয়নই বিপুল অর্থ বাঁচাতে পারে

বাংলাদেশে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কিন্তু দেখা যায়, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ঘন ঘন মেয়াদ বৃদ্ধি ও সংশোধনের প্রয়োজন হয়। এর অন্যতম কারণ হলো উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়নে তাড়াহুড়া করা, উত্তোলিত অর্থের ব্যয় সক্ষমতা ও কাজের অগ্রগতির ফলোআপ না থাকা। এতে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের (এডিপি) মোট ব্যয়ের প্রায় ২ শতাংশ লস হয়।

এ তথ্য পাওয়া গেছে ড. রনজিৎ কুমার সরকারের ‘প্রকল্পের মেয়াদ নির্ণয়, ভৌত অগ্রগতি পরিমাপ এবং সময়ের দক্ষতা পরিমাপ’ লেখা থেকে। ড. সরকার আরও জানান, ডিপিপি প্রণয়নে সবচেয়ে দুর্বল দিক হলো কর্মপরিকল্পনা না করে ডিপিপি প্রণয়ন করা। ডিপিপি প্রণয়নের যে জিনিসগুলো মনে রাখা দরকার, তা নিয়ে আলোচনা নিচে পেশ করা হলো।

মোট কর্মপরিকল্পনা ও মেয়াদকাল

কর্মপরিকল্পনা হলো একটি প্রকল্পের হৃৎপিণ্ড। প্রকল্পের কোন অংশে কী কী কাজ করা প্রয়োজন এবং সেসব শেষ করতে কত সময় লাগতে পারে, তা দেখানো থাকে লগ ফ্রেম বা কর্মপরিকল্পনা ছকে। অধিকাংশ প্রকল্প প্রণয়নের সময় মোট কর্মপরিকল্পনা করে ডিপিপি প্রণয়ন করা হয় না। ফলে প্রকল্প প্রণয়নের সময় সঠিক মেয়াদকাল নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব হয়। সঠিক মেয়াদকাল নির্ণয় না করার ফলে প্রকল্প শেষ হতে দীর্ঘসূত্রতা হয়।

ভৌত অগ্রগতির পরিমাণ

একটি প্রকল্পে গড়ে সাধারণত ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ ও ৩০ শতাংশ পরিচালনা ব্যয় হয়ে থাকে। দেখা যায়, মোট বিনিয়োগের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয় ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন ও তদারকিতে। এ কাজ যত দ্রুত হয়, প্রকল্প পরিচালনা ব্যয় তত সাশ্রয় হয়। আমাদের দেশে পেশ করা ডিপিপিগুলোতে ভৌত অগ্রগতি পরিমাপের কোনো জুতসই পরিমাপক বা মানদণ্ড না থাকায় আনুমানিক পদ্ধতি বা যে সূত্রটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। দৃশ্যত এখানে আর্থিক অগ্রগতির সঙ্গে সমন্বয় করে বাস্তব অগ্রগতি দেখা হয় বলে আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তাই ভৌত অগ্রগতি পরিমাপের সুনির্দিষ্ট পরিমাপক বের করা এখন সময়ের দাবি।

অভিজ্ঞতা

আমাদের দেশে টপ-ডাউন অ্যাপ্রোচে বা ওপর থেকে চুইয়ে পড়া পদ্ধতিতে প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। সহজ কথায়, টাকা কীভাবে খরচ হবে, তা দেখানো হয়। কিন্তু সত্যিকার প্রজেক্ট পরিকল্পনায় যা থাকা উচিত, তা হলো সমস্যা কী, সমস্যার কতটুকু ইতিমধ্যে স্পর্শ করা হয়েছে, কী পদ্ধতিতে তা সমাধান করা হয়েছিল, এখন কী করা দরকার, কীভাবে ও কাজের পর্যায় কী হবে? পেশ করা প্রকল্পের ব্যয় কীভাবে কোন তরিকায় ধরতে হবে? আউটপুট কী আসবে? ভবিষ্যৎ ভাবনায় তা কি ইতিবাচক ফল আনবে? সোজা কথায় দক্ষ, অভিজ্ঞ এবং বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা যাচাই করে ৫০ কোটি বা একনেকে পাস হওয়ার মতো ডিপিপিগুলো ছাড় দেওয়া দরকার।

অযাচিত ঝামেলা

প্রকল্পের সময় যত বাড়ে, পদে পদে ভোগান্তি তত বাড়ে। যেনতেনভাবে প্রকল্পটি দাঁড় করানোর ফলে বিষয়ভিত্তিক মন্ত্রণালয়/বিভাগ বা সংস্থায় ফাইলটি পাস করতে অনেক সময় নেওয়া হয় (আদর্শ অনুমোদন সময় ১৬৭ দিন)। অনেক সময় বিশেষজ্ঞ মতামত নিতে হয় প্রকল্পের সংশোধনের প্রয়োজন হলে। বিভিন্ন পর্যায়ে প্রেজেন্টেশনের সময় যদি প্রকল্পটি স্বব্যাখ্যায়িত হয়, লজিস্টিক সাপোর্ট কম লাগে, যথাযথ নিয়ম নীতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, তবে ঝামেলা কম পোহাতে হয়।

বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমডি) মনিটরিং ফরমেট সংশোধন

আইএমইডির মোট পাঁচটি ফরমেট রয়েছে। এর মধ্যে চারটি ফরমেটের মাধ্যমে প্রকল্পের বাস্তবায়নকালের অগ্রগতির তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব ফরমেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেকোনো ফরম্যাট প্রকল্পের মোট বাস্তব অবস্থা বা ভৌত অগ্রগতি পরিমাপের তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া ফরমেটের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে মোট অগ্রগতি পরিমাপ করা যায় না। তাই আইএমইডির ছকসমূহ সংশোধন ও অধিকতর উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।

শেষ কথা হলো, প্রতিটি ডিপিপির টাকা আসে নাগরিকদের আয়করের অংশ বা বৈদেশিক লোন দিয়ে। এ টাকা দিনশেষে টানতে হবে আমাদের সবাইকে। তাই সঠিক ভৌত অগ্রগতি নিরূপণ, সময়ের সদ্ব্যবহার, আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি এবং প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অযাচিত চাপ রোধই পারে ডিপিপি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

ড. মো. আবুল কালাম আজাদ গবেষক ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সঠিক ডিপিপি প্রণয়নই বিপুল অর্থ বাঁচাতে পারে