দেশের মেডিকেল কলেজসমূহে শিক্ষক সংকট অনাকাঙ্ক্ষিত হইলেও অপ্রত্যাশিত নহে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) তথ্য উদ্ধৃত করিয়া মঙ্গলবারের সমকাল জানাইয়াছে, সমগ্র দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ রহিয়াছে ৩৭টি, যেগুলিতে শিক্ষকের পদসংখ্যা ৬ সহস্র ৪৪৬টি।
অথচ বর্তমানে ৩ সহস্র ৭০০ শিক্ষক দিয়া চলিতেছে মেডিকেল শিক্ষা কার্যক্রম। অর্থাৎ সরকারি মেডিকেল কলেজসমূহে প্রায় ৪৩ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য। বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত। কারণ চাহিদার প্রায় অর্ধেক সংখ্যক শিক্ষকশূন্যতার কারণে একদিকে মেডিকেল শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হইতেছে, অন্যদিকে দেশীয় এমবিবিএস ডিগ্রির বহির্বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা হারাইবার শঙ্কা দেখা দিয়াছে। বিগত সরকার মেডিকেল শিক্ষার প্রসারের নামে জেলায় জেলায় অপরিকল্পিতভাবে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার কারণে এই সংকট প্রত্যাশিতই ছিল।
মুখ্যত দলীয় নেতাদের অযৌক্তিক আব্দার পূরণকল্পে প্রতিষ্ঠিত এই সকল মেডিকেল কলেজে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের বিষয় বিবেচনায় লওয়া হয় নাই। এমনকি অনেক মেডিকেল কলেজে হাসপাতালও নাই; দক্ষ চিকিৎসক সৃষ্টির জন্য যাহা অপরিহার্য। এদিকে শিক্ষকদের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকেন অধ্যাপক। মেডিকেল কলেজসমূহে এই অধ্যাপক সংকট সর্বাপেক্ষা অধিক হইলেও, অভিযোগ, নূতন করিয়া অধ্যাপক নিয়োগ দেওয়া যাইতেছে না। কারণ সহকারী বা সহযোগী অধ্যাপক পদোন্নতি পাইতেছেন না। মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরিয়া আটক থাকিবার কারণে সংকট বৃদ্ধি পাইয়াছে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এই সকল শিক্ষকের বঞ্চনা গ্রহণযোগ্য নহে। সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যোগ্য সাড়ে ৭ সহস্র শিক্ষকের পদোন্নতির ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরি।
আমরা মনে করি, শিক্ষক সংকট নিরসনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজসমূহে সুপারনিউমারারি পদে অতিদ্রুত শিক্ষক নিয়োগ এবং নূতন শিক্ষক পদ সৃজন করা। ইহা করিতে গেলেও সরকারের দুই-তিন বৎসর সময় লাগিবে বটে, কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে ইহা জরুরি।
প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষ সহকারী স্বীকার করিয়াছেন, মৌলিক আটটি বিষয়ে শিক্ষক সংকট সর্বাধিক। গাইনি, কার্ডিওলজির ন্যায় ক্লিনিক্যাল সাবজেক্টে শিক্ষক সংকট না থাকিলেও মৌলিক বিষয়ে অনুশীলনের সুযোগ কম থাকায় এই সকল বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের হার কম। আমরা বিশ্বাস করি, সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করিলে সকল বিষয়ে শিক্ষক সৃজন অসম্ভব নহে। এই ক্ষেত্রে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা লইতে হইবে, নচেৎ মেডিকেল শিক্ষার মান লইয়া প্রশ্ন উঠিবে।
আমরা জানি, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা এমনিতেই চতুর্মুখী সমস্যায় জর্জরিত। জনসংখ্যার তুলনায় চিকিৎসক সংখ্যা যে অপ্রতুল, উহাও উল্লেখযোগ্য। এই চিকিৎসকদের মধ্যেই যদি মানের ঘাটতি থাকে, উহা অপেক্ষা দুঃখজনক বিষয় আর কী হইতে পারে?
একটা সময় ছিল যখন বিদেশে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের চিকিৎসকদের বেশ চাহিদা ছিল। বিদ্যমান পরিস্থিতি সেই চাহিদার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলিতে পারে। দেশে নূতন মেডিকেল কলেজ দরকার বটে। কিন্তু উহা প্রতিষ্ঠা করিবার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এবং শিক্ষক অবশ্যই নিয়োগ দিতে হইবে।
সমকালের প্রতিবেদনেই স্পষ্ট, অবকাঠামো ও শিক্ষক সংকট লইয়া নূতন করিয়া গঠিত ছয়টি মেডিকেল কলেজের অবস্থা এতটাই নাজুক, সেইগুলি বন্ধের উদ্যোগ লইয়াছিল সরকার। তবে জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসনের বাধায় সেই সিদ্ধান্ত হইতে সরিয়া আসিয়াছে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তর।
আমরা চাহিব, সর্বশেষ গঠিত ছয়টি মেডিকেল কলেজ ও অধিক সংকটে থাকা পুরাতন আট মেডিকেল কলেজের মানোন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হউক। সার্বিকভাবে মেডিকেল শিক্ষার মানোন্নয়ন সরকারের অগ্রাধিকারে থাকিলে শিক্ষক ও অবকাঠামোগত সংকট কাটিয়া উঠা কঠিন হইবে না।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম ড ক ল কল জ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
বছরে ১৭ হাজার মানুষের মৃত্যু কিডনির রোগে
কিডনির রোগে ভুগছেন দেশে এমন মানুষের অনুমিত সংখ্যা ১ কোটি ২৯ লাখের বেশি। প্রতিবছর কিডনির রোগে প্রায় ১৭ হাজার মানুষ মারা যান। মূলত ৯ ধরনের কিডনির রোগে এই মৃত্যু হয়। কিডনির চিকিৎসায় অনেক মানুষ প্রতিবছর দেশের বাইরে যান।
বাংলাদেশে কিডনির রোগে আক্রান্ত, মৃত্যু ও কিডনির রোগের ধরন বিষয়ে এই তথ্য পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) ওয়েবসাইটে। আইএইচএমই দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশের রোগ পরিস্থিতির তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি নিয়মিতভাবে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করছে। তাদের তথ্যভান্ডারে বিশ্বের প্রায় সব দেশ ও অঞ্চলের বিভিন্ন রোগের পরিসংখ্যান পাওয়া পায়।
কিডনির রোগ নিয়ে দেশে জাতীয়ভাবে কোনো জরিপ বা গবেষণা নেই। কিডনির রোগবিশেষজ্ঞরা প্রায় দুই দশক ধরে বলে আসছেন, কোনো না কোনো কিডনির রোগে ভুগছেন, দেশে এমন মানুষ আছেন প্রায় ২ কোটি। গণমাধ্যমসহ নানা পর্যায়ে এই পরিসংখ্যানই ব্যবহার করা হচ্ছে।
আইএইচএমইর তথ্য অনুযায়ী, ৯ ধরনের কিডনির রোগে বাংলাদেশের মানুষ ভুগছেন। এর মধ্যে আছে: টাইপ-২ ডায়াবেটিসজনিত দীর্ঘস্থায়ী কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত দীর্ঘস্থায়ী কিডনির রোগ, টাইপ-১ ডায়াবেটিসজনিত দীর্ঘস্থায়ী কিডনির রোগ, কিডনির ক্যানসার, মূত্রতন্ত্রের কিছু সমস্যাজনিত কিডনির রোগ, কিডনির পাথর, দীর্ঘস্থায়ী কিডনির প্রদাহ, তীব্র কিডনির প্রদাহ এবং বেশ কিছু অনির্দিষ্ট কারণে কিডনির রোগ।
কিডনির রোগবিশেষজ্ঞরা প্রায় দুই দশক ধরে বলে আসছেন, কোনো না কোনো কিডনির রোগে ভুগছেন, দেশে এমন মানুষ আছেন প্রায় ২ কোটি।বোঝা কত বড়আইএইচএমইর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ মানুষের কোনো না কোনো কিডনির রোগ দেখা দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিডনিতে পাথরের সমস্যা। জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক কাজী রফিকুল আবেদিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এই সমস্যা প্রকট। একবার পাথর সরানো বা চিকিৎসার পরও এটি আবার হয়। প্রতিরোধের কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, কিডনির রোগের অন্যতম প্রধান কারণ টাইপ-২ ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে কিডনির রোগের ঝুঁকি বাড়ে। পরিসংখ্যান বলছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসজনিত দেশে দীর্ঘস্থায়ী কিডনির রোগে ভুগছেন ২০ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি মানুষ। উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনির রোগে ভুগছেন ৩ লাখ ৮৯ হাজার মানুষ। আবার কিডনিতে ক্যানসার আছে এমন রোগী ৪ হাজার ৭১৬ জন।
মৃত্যুর পরিসংখ্যানও পাওয়া যায় আইএইচএমইর কাছ থেকে। তারা বলছে, দেশে প্রতিবছর ১৭ হাজার ৭৮ জন কিডনির রোগে মারা যান। সবচেয়ে বেশি মারা যান টাইপ-২ ডায়াবেটিসজনিত কিডনির রোগে। এই কারণে মারা যান সাড়ে চার হাজার মানুষ। উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনির রোগে বছরে মারা যান তিন হাজারের বেশি মানুষ। কিডনির ক্যানসারে মারা যান ৮১৩ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দুনিয়া আইএইচএমইর তথ্য-পরিসংখ্যান ব্যবহার করছে। এটা অনুমিত হলেও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান। এখান থেকে আমরা বাংলাদেশের কিডনির রোগ সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য পাচ্ছি, যা আগে আমাদের হাতে ছিল না।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, কিডনির রোগের অন্যতম প্রধান কারণ টাইপ-২ ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকলে কিডনির রোগের ঝুঁকি বাড়ে। পরিসংখ্যান বলছে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসজনিত দেশে দীর্ঘস্থায়ী কিডনির রোগে ভুগছেন ২০ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি মানুষ। উচ্চ রক্তচাপজনিত কিডনির রোগে ভুগছেন ৩ লাখ ৮৯ হাজার মানুষ। আবার কিডনিতে ক্যানসার আছে এমন রোগী ৪ হাজার ৭১৬ জন।বিদেশে যেতে হয়কিডনির রোগী দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিডনি বিকল হলে তার দুই ধরনের চিকিৎসা। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করা এবং কিডনি প্রতিস্থাপন। প্রতিবার ডায়ালাইসিসে সরকারি হাসপাতালে খরচ হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। সপ্তাহে অন্তত দুবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষেও দীর্ঘদিন ডায়ালাইসিস চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। অন্যদিকে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনি পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি এককালীন খরচও অনেক বেশি।
এসব কারণে সাধারণ মানুষের একটি অংশের মধ্যে দেশে কিডনির রোগ চিকিৎসা নিয়ে সংশয় কাজ করে। অনেকে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে চান। যে কয়টি রোগের চিকিৎসায় দেশের মানুষ বেশি বাইরে যান, কিডনির রোগ তার মধ্যে অন্যতম।
গত মাসে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারবিষয়ক জনমত জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। জরিপে দেখা যায়, মূলত ১১টি রোগের চিকিৎসায় মানুষ বিদেশে যান। এই তালিকায় আছে: ক্যানসার, হৃদ্রোগ, কিডনির রোগ, বন্ধ্যত্ব, ডায়াবেটিস, সড়ক বা অগ্নিদুর্ঘটনা, হাড় ও মেরুদণ্ডের সমস্যা, চোখের সমস্যা, স্নায়ুরোগ, মানসিক রোগ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ।
জরিপে দেখা যায়, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বা ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ বিদেশে যান হৃদ্রোগ চিকিৎসায়। এর পরের কারণটি কিডনির রোগ চিকিৎসা। কিডনির রোগ চিকিৎসায় ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ বিদেশে যান। ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ বিদেশে যান ক্যানসার চিকিৎসার জন্য।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ১৩ মার্চ বিশ্ব কিডনি দিবস পালিত হচ্ছে। বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দিবসটি পালন করছে।
যে কয়টি রোগের চিকিৎসায় দেশের মানুষ বেশি বাইরে যান, কিডনির রোগ তার মধ্যে অন্যতম।