মানুষ অনেক কিছু করে বেঁচে থাকলে। মানুষ গান গায়, দর্শন–ইতিহাস চর্চা করে। ছবি আঁকে। বিভিন্ন মতের মধ্যে তর্ক–মারামারি হয় কার মত ভুল আর কারটা ঠিক তাই নিয়ে। তর্কে অবশ্য তার সুরাহা হয় না। আরও তর্ক হয়। তর্ক মারামারিতে গিয়ে গড়ায়। তবে একটা বিষয় নিয়ে তর্কের কোনো অবকাশ নেই। আর তা হলো দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি...এই সবই করে জীবিত মানুষ। মৃত মানুষ কোনো দর্শন চর্চা করে না, ইতিহাস লেখে না। এসব করার জন্য আগে আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে।  

কিন্তু এই বেঁচে থাকার ব্যাপারটাই আমাদের রাজনীতির আলাপ থেকে ক্রমে উধাও হয়ে যাচ্ছে কেন? কিছুদিন আগেও যেকোনো বক্তৃতা, রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা আর আলাপ শুরু হতো শ্রমিক–কৃষকের কথা দিয়ে। মানে, যে মানুষগুলো সমাজে সংখ্যায় বেশি, যারা আসলে কেবল টিকে থাকে, যারা বেঁচে থাকে না, সেই মানুষগুলোর কথা দিয়ে। সেসব মানুষ এখন অদৃশ্য আর নেই হয়ে গেছেন আমাদের রাজনীতির আলাপ থেকে। তারা পত্রিকার পাতায় আসেন কদাচিৎ। কখনো আসেন কৃষিপণ্যের দাম কমে যাওয়ার সূত্র ধরে। কখনো শ্রমিক বেতন না পেয়ে রাস্তা অবরোধ করলে যানজটের খবরের প্রসঙ্গক্রমে।

দুনিয়াজুড়ে এই ঘটনা ঘটছে। মানুষ হারিয়ে গিয়ে রাজনীতির বিষয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন মতাদর্শ। গরিব মানুষ এখন আর রাজনীতির বিষয় নয়। তারা বড়জোর ভোটের সময় দিন কয়েকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তা–ও যদি সত্যি সত্যি তাঁরা ভোট দেওয়ার সুযোগ পান।

নিখোঁজ হয়ে রাজনীতির কেন্দ্র থেকে মুছে যাচ্ছে মানুষ। একসময় রাজনীতিতে বাস্তব মানুষের প্রতিফলন পাওয়া যেত। ক্ষমতায় যাওয়াই এখনো বহাল রাজনীতির মূল কথা। কিন্তু তা হয়ে গেছে এক বিমূর্ত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায়। বাস্তব মানুষ ধীরে ধীরে গৌণ হয়ে পড়েছে। তাদের জায়গা নিয়েছে ‘সংস্কৃতি’, ‘পরিচয়’ এবং ‘প্রতিনিধিত্ব’-এর মতো বিমূর্ত ধারণা।

এ ব্যাপারটা ঘটার একটা অন্যতম সূত্র হলো পশ্চিমের কালচারাল স্টাডিজ। কালচারাল স্টাডিজের উৎপত্তি মূলত ১৯৬০-এর দশকে ব্রিটেনের বার্মিংহাম স্কুল থেকে। রিচার্ড হগার্ট, স্টুয়ার্ট হল এবং তাঁদের সহকর্মীরা দেখাতে চেয়েছিলেন যে সাংস্কৃতিক চর্চা কেবল উঁচুতলার বিষয় নয়, বরং সাধারণ মানুষও তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে তোলে এবং তা রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম দিকে, এটি একটি বিপ্লবী ধারণা ছিল। প্রচলিত একাডেমিক কাঠামোতে শ্রমজীবী শ্রেণির সাংস্কৃতিক অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তুলেছিল।

কম্পিউটারের কাছে তথ্য আছে যে পৃথিবী মানুষের বাসের যোগ্য নয়, সেখানে যাওয়া যাবে না। এমন সময় খবর পাওয়া গেল, পৃথিবী আবার বাসযোগ্য হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাইলে কম্পিউটার বলল, সেখানে গেলে টিকে থাকা যাবে না। ক্যাপ্টেন জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি টিকে থাকতে চাই না। আমি বাঁচতে চাই।’  

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে থাকে। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে কালচারাল স্টাডিজ শ্রমজীবী শ্রেণির বাস্তব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের পরিবর্তে ‘পরিচয়ের রাজনীতি’কে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করে। শ্রমিকদের মজুরি, জীবনমান এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার মতো বাস্তব ইস্যুগুলোকে পাশ কাটিয়ে গবেষণা ঘুরে যায় লিঙ্গ, জাতিসত্তা, যৌন পরিচয়, জনপ্রিয় সংস্কৃতি ইত্যাদির দিকে।
এই পরিবর্তন কাকতালীয় ছিল না। ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে ধীরে ধীরে একাডেমিক বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে একটি নতুন ধারা প্রচলিত করতে শুরু করে। বাস্তব মানুষের জীবন আর সমস্যা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ‘ভাষা’, ‘সংস্কৃতি’, ও ‘প্রতিনিধিত্ব’ রাজনীতির প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠল।

এখন তো দুনিয়াজোড়াই আমজনতার প্রকৃত সংকট—আর্থিক বৈষম্য, কাজ উপার্জনের নিরাপত্তাহীনতা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া—এসব ইস্যু রাজনীতির মূলধারায় গুরুত্ব হারিয়েছে। মানুষের কথা বলবে এমন কোনো প্রক্রিয়া এখন আর শক্তিশালী নয়। এখন রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সাংস্কৃতিক প্রশ্নের দিকে ঝুঁকে পড়েছে।  

কোনোমতে টিকে থাকা মানুষগুলো সব সময় খাপ খাইয়ে নেয়। ভোটের সময় কিছুদিনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাছে আসে, প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু নির্বাচনের পর তারা আবার বিস্মৃত হয়। পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি মূলধারার আলোচনায় উঠে আসে।

মানুষের বাস্তব সমস্যাগুলো যখন অন্য কোনো রাজনীতির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়, তখন কার লাভ হয়? কোনো একটা মূল সমস্যা যে সমাধান না হয়ে টিকে থাকে, তা তো বোঝা যায়। নইলে আমাদেরকে কেন বারবার মুক্ত হওয়ার জন্য, স্বাধীন হওয়ার জন্য লড়তে হয়, মরতে হয়। সে কোন জিনিস, যা বদলাচ্ছে না বলে এতবার যুদ্ধে নামতে হয়?

ওয়াল ই নামে একটা অ্যানিমেশন ছবি আছে। মানুষের হাতে পড়েই পৃথিবী আর বাসযোগ্য নেই। মানুষ তাই বিশাল এক মহাকাশযানে করে চলে গেছে মহাশূন্যে। সেই যান চালায় এক কম্পিউটার। একজন ক্যাপ্টেনও আছেন।

কম্পিউটারের কাছে তথ্য আছে যে পৃথিবী মানুষের বাসের যোগ্য নয়, সেখানে যাওয়া যাবে না। এমন সময় খবর পাওয়া গেল, পৃথিবী আবার বাসযোগ্য হয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন পৃথিবীতে ফিরে যেতে চাইলে কম্পিউটার বলল, সেখানে গেলে টিকে থাকা যাবে না। ক্যাপ্টেন জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি টিকে থাকতে চাই না। আমি বাঁচতে চাই।’  

টিকে থেকে আর কত দিন? আমরা বাঁচতে চাই।

জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত র র জন ত ক র র জন ত র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

৮৮ এসআইকে পুলিশের শূন্য পদে নিয়োগের নির্দেশ 

পুলিশের ৮৮ উপপরিদর্শককে (এসআই, নিরস্ত্র) শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ দিতে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ-সংক্রান্ত রুল যথাযথ ঘোষণা করে গতকাল বুধবার এ রায় দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী বি এম ইলিয়াস, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মনিরুল ইসলাম মিয়া।

২০২৩ সালের ৩ মে পুলিশ নন-ক্যাডার এসআই (নিরস্ত্র) পদে জনবল নিয়োগ দিতে বিজ্ঞপ্তি দেয়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ শেষে একই বছরের ১৩ অক্টোবর ৫ হাজার ৩১ জন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ৯২১ জনকে নিয়োগ দিতে প্রাথমিকভাবে সুপারিশ করা হয়। পরে ওই বছরের ১৭ থেকে ২৩ অক্টোবর স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে ৮৫৭ জন চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। কিন্তু শারীরিক পরীক্ষা, লিখিত, মনস্তত্ত্ব পরীক্ষা ও কম্পিউটার টেস্টে অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হলেও ৯৮ জন প্রার্থীকে সুপারিশ করা হয়নি। এ পর্যায়ে সংক্ষুব্ধ মো. এখলাছ চৌধুরীসহ ৮৮ জন ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন।

ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। রিট চলা অবস্থায় গত ১ ফেব্রুয়ারি আবার শূন্যপদের বিপরীতে এসআই (নিরস্ত্র) নিয়োগের লক্ষ্যে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করে পুলিশ। এর পর এসআই পদের ৮৮টি পদ সংরক্ষণের জন্য পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবরে আবেদন করেন রিটকারীরা। ওই আবেদন নিষ্পত্তি না করায় পুলিশের ৮৮টি এসআই (নিরস্ত্র) পদ সংরক্ষণ চেয়ে হাইকোর্টে একটি সম্পূরক আবেদনও করেন রিটকারীরা। তখন হাইকোর্ট নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত পদ থেকে ৮৮টি পদ সংরক্ষণের নির্দেশ দেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ