তওবা-ইস্তিগফার: গুনাহ মাফের শ্রেষ্ঠ উপায়
Published: 12th, March 2025 GMT
তওবা অর্থ ফিরে আসা; ইস্তিগফার মানে ক্ষমা প্রার্থনা করা। ‘নাস’ (মানব) মানেই ভুল, ‘ইনসান’ (মানুষ) মানে যে ভুলে যায়। প্রথম মানুষই প্রথম ভুল করেছিলেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পরম ক্ষমাশীল, অতীব করুণাময়। তিনি বান্দার ভুলত্রুটি, পাপতাপ, যাবতীয় অপরাধ ক্ষমা ও মার্জনা করেন এবং দয়া বর্ষণ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদহানি, প্রাণহানি ও ফসলের ক্ষতির মাধ্যমে; তুমি সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের। যারা তাদের প্রতি মুসিবত আপতিত হলে বলে, “নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব।” তাদের প্রতি তাদের রবের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সুরা আল-বাকারা,
আয়াত: ১৫৫-১৫৭)
বান্দা ইস্তিগফার করলে আল্লাহ আজাব দূর করে দেন। কোরআন কারিমে বর্ণিত হয়েছে, ‘আপনি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না এবং তারা ক্ষমা প্রার্থনা করলে তখনো আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না।’ (সুরা আল-আনফাল, আয়াত: ৩৩)
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান। এ মাসে অগণিত মানুষকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘দুর্ভাগা তারা, যারা রমজান পেয়েও মাগফিরাত বা ক্ষমা লাভ করতে পারল না।’
প্রিয় নবীজি (সা.) বলেন, ‘সব মানুষই অপরাধী, তাদের মধ্যে উত্তম হলো তওবাকারী।’ (তিরমিজি: ২৪৯৯; মুসনাদে আহমাদ: ১৩০৪৯; ইবনে মাজাহ: ৪২৫১) ‘যদি কেউ গুনাহ মাফের উদ্দেশ্যে ইস্তিগফার করাকে নিজের ওপর আবশ্যক করে নেয়, তাহলে আল্লাহ তাআলা তাকে তিনটি পুরস্কার দেবেন—তার জীবনের কঠিন অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করবেন, তাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেবেন, তাকে অচিন্তনীয় ও অকল্পনীয় স্থান থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ (মুসলিম ও তিরমিজি)
দোষে-গুণে মানুষ। মানুষের মধ্যে পাপ-পুণ্য বিদ্যমান। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘অতঃপর আল্লাহ তাকে (মানবসত্তায়) অপরাধপ্রবণতা ও তাকওয়া বা সতর্কতার জ্ঞান দান করলেন।’ (সুরা আশ-শামস, আয়াত: ৮) ‘আর আমি তাকে (ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়) দুটি পথ দেখিয়ে দিয়েছি (যাতে সে সঠিক পথে চলতে পারে)।’ (সুরা আল-বালাদ, আয়াত: ১০)
হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, ‘বান্দা যদি দৈনিক ৭০ বার অপরাধ করে এবং ৭০ বার ক্ষমা চায়, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’
রাসুলুল্লাহ (সা.) দৈনিক ৭০ বারের অধিক বা ১০০ বার ইস্তিগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। অথচ তিনিসহ সব নবী-রাসুল (আ.) ছিলেন মাসুম বা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ। কারণ, তওবা ও ইস্তিগফার স্বতন্ত্র ইবাদত। এতে আল্লাহ বেশি খুশি হন।
তওবা ও ইস্তিগফারের জন্য কোরআন মাজিদে ও হাদিস শরিফে বহু দোয়া রয়েছে। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ দোয়াটিকে বলা হয় ‘সাইয়িদুল ইস্তিগফার’ বা ক্ষমার শ্রেষ্ঠ আবেদন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি কেউ সকাল-সন্ধ্যায় বিশ্বাসের সঙ্গে “সাইয়িদুল ইস্তিগফার” পাঠ করে, সে যদি ওই দিন রাত্রে বা দিবসে ইন্তেকাল করে, তাহলে সে জান্নাতি হবে।’
সাইয়িদুল ইস্তিগফার‘আল্লাহুম্মা আন্তা রাব্বি, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা; খালাকতানি ওয়া আনা আবদুকা, ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়া’দিকা মাস্তাতাতু। আউজু বিকা মিন শাররি মা সনা’তু, আবুউ লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়া, ওয়া আবুউ বিজাম্বি। ফাগফির লি ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ্জুনুবা ইল্লা আন্তা।’
(অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমার রব, আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আপনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমি আপনারই বান্দা। আমি আপনার প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের ওপর আছি আমার সাধ্য অনুযায়ী। আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই আমার কৃত অপরাধের অনিষ্ট থেকে। আমি স্বীকার করছি আমার প্রতি আপনার নিয়ামত এবং স্বীকার করছি আমার গুনাহ। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না।) (সহিহ বুখারি: ৬৩২৩; সহিহ মুসলিম)
রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজান। এ মাসে অগণিত মানুষকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। নবীজি (সা.) বলেন, ‘দুর্ভাগা তারা, যারা রমজান পেয়েও মাগফিরাত বা ক্ষমা লাভ করতে পারল না।’ (সহিহ বুখারি)
মহান আল্লাহ তাআলার একটি গুণ হচ্ছে ক্ষমা করা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনি (আল্লাহ) গুনাহ ক্ষমাকারী।’ (সুরা গাফির, আয়াত: ৩) ‘জেনে রেখো, তিনি পরাক্রমশালী পরম ক্ষমাশীল।’ (সুরা আজ-জুমার, আয়াত: ৫) ‘হে নবী! আপনি আমার বান্দাদের বলে দিন, আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (সুরা আল-হিজর, আয়াত: ৪৯)
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আল ল হ ত আপন র রমজ ন অপর ধ ক রআন
এছাড়াও পড়ুন:
রমজানে হালাল খাবার ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ
রমজান মাস এলে দেখা যায়, ইফতার ও সাহ্রির সামগ্রীসহ বেশ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেক গুণ বেড়ে যায়। অথচ রমজান মাস ছাড়া বছরের অন্য মাসগুলোতে এসব খাদ্যদ্রব্যের দাম অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে থাকে; ব্যতিক্রম ঘটে শুধু পবিত্র রমজান মাসে। অধিক মুনাফালোভী সুযোগসন্ধানীরা পবিত্র রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু খাদ্যদ্রব্য অনৈতিকভাবে মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রমজানের কিছুদিন আগে বাজারের চাহিদা অনুপাতে অনেক কম পরিমাণে দ্রব্য বাজারে সরবরাহ করে এবং এর মূল্য বৃদ্ধি করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘সত্যবাদী আমজনতা ও বিশ্বাসী ব্যবসায়ী হাশরের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের কাতারে থাকবেন।’ (তিরমিজি)
আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৭৫)। কোনো মুসলমান ব্যবসায়ী ভাই রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটিয়ে অন্য কোনো মুসলমানদের আল্লাহর স্মরণের পথে কি কখনো বাধার সৃষ্টি করতে পারে? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দেওয়া হয় এবং মুসলমানরা প্রতিযোগিতা করে রোজাদারদের সেবা দিতে। যেখানে বিশ্বব্যাপী পবিত্র রমজান মাস এলে মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি বেড়ে যায়; ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
ব্যবসায়ীরা যদি তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন, তবে প্রত্যেক রোজাদার স্বস্তিতে ইফতার–সাহ্রির আয়োজন করতে পারবেন এবং সঠিকভাবে রোজা পালনে কষ্ট ও হয়রানির শিকার হবেন না। ব্যবসায়ীরা যদি তাঁদের ব্যবসায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, রোজাদারদের পাশে সহানুভূতির দায়িত্ব নিয়ে দাঁড়াতে পারেন; তবে নিশ্চয়ই তাঁদের জন্য থাকবে আল্লাহ তাআলার ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে দুনিয়ায় রহমত, বরকত এবং পরকালের মাগফিরাত, নাজাতসহ অনেক অনেক কল্যাণ।
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যের প্রশিক্ষণের মাস রমজান। এ রহমত, মাগফিরাত, নাজাতের মাসেও আমাদের ভ্রাতৃঘাতী ও নির্মমতার চর্চা হতে দেখা যায়। মাহে রমজানকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী গুদামজাত করেন অতি মুনাফার লোভে; ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জনগণের জীবিকা সংকীর্ণ করে যে ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করবে, সে বড় অপরাধী হিসেবে গণ্য হবে।’ (মুসলিম ও তিরমিজি) প্রিয় নবী (সা.) আরও বলেন, ‘মুজরিম তথা অপরাধীর পক্ষেই সম্ভব পণ্য মজুত করে জনগণের সংকট সৃষ্টি করা।’ (মুসলিম) মুহাদ্দিসগণ বলেন, আলোচ্য হাদিসে মজুতদারকে অপরাধী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআনে অপরাধী শব্দটি ফেরাউন, হামান ও কারুনের মতো প্রতাপশালী এবং অহংকারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। (সুরা-২৮ কসাস, আয়াত: ৮)
মজুতদারের হীন মানসিকতা ও কদর্যপূর্ণ স্বার্থপরতাকে মহানবী (সা.) এভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘গুদামজাতকারী কতই না ঘৃণিত মানুষ। আল্লাহ তাআলা দ্রব্যমূল্য কমিয়ে দিলে সে চিন্তায় পড়ে যায়। আর বাড়িয়ে দিলে সে আনন্দিত হয়। (মিশকাত ও শুআবুল ইমান) রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন খাদ্যদ্রব্য গুদামজাত করে রাখবে, মানুষকে কষ্ট দেবে, সে এ সম্পদ দান করে দিলেও তার গুনাহ মাফের জন্য যথেষ্ট হবে না।’ (মিশকাত) খাদ্যগুদামজাতকারী সম্পর্কে রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমদানি করে, সে রিজিকপ্রাপ্ত। আর যে গুদামজাত করবে, সে অভিশপ্ত হবে।’ (ইবনে মাজাহ ও দারেমি)
মাহে রমজান উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা মজুতদারি থেকে নিজে বিরত থাকবেন, অন্যকেও এই ভয়াবহ গুনাহ থেকে বিরত রাখবেন। রোজাদারদের ঠকানোর গুনাহ থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন। হালালভাবে ব্যবসা করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং দুনিয়ার সুখ–শান্তি ও আখিরাতে মুক্তি লাভের পাশাপাশি নবী-সিদ্দিকদের সঙ্গে জান্নাতে যাওয়ার তাওফিক আমাদের দিন।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]