সামনে কী? জাতীয় নির্বাচন? কত দূর?
Published: 12th, March 2025 GMT
হঠাৎই মনে হচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন কিছু হতে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বেশ কিছুদিন ধরে বলছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টা অবশ্য প্রথম দেশের বাইরে এ কথা বলেছিলেন। সেই থেকে ধারাবাহিকভাবে তিনি এ কথা বলে যাচ্ছিলেন। প্রায় সবাই, এমনকি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো পর্যন্ত এ কথা বিশ্বাস করছিল। গ্রামগঞ্জে, চায়ের টেবিলেও এ কথাগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ তিনি বললেন, ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যখন এ কথা বলছিলেন, তখন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান প্রথমে বললেন, ‘ডিসেম্বর থেকে জুনের’ মধ্যেই নির্বাচন হবে। এর পরপরই নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা ইংরেজিতে এনসিপির নতুন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বললেন, দেশে এখনো নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। প্রশাসন ও পুলিশের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বললেন, এই পুলিশ নির্বাচন করার মতো হয়ে ওঠেনি।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা রাইট টু ফ্রিডমের প্রেসিডেন্ট সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম এবং নির্বাহী পরিচালক সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিচের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় বলেন, ছয়টি কমিশন সংস্কার বিষয়ে যে প্রস্তাবগুলো রেখেছে, সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে। সংলাপ শেষে রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদ (জুলাই চার্টার) স্বাক্ষর করবে।
অন্তর্বর্তী সরকার এই সনদের সুপারিশগুলোর কিছু অংশ বাস্তবায়ন করবে এবং বাকি অংশ বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এ–ও বলেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে কম সংস্কারে সম্মত হয়, তবে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে পারে। অন্যথায় জাতীয় নির্বাচন পরবর্তী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।
ব্যাপারটা কেমন একটু হলো না? জুলাই চার্টার ও সংস্কার নিশ্চয়ই এক জিনিস নয়। কিন্তু মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা যে রকম করে বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে জুলাই সনদ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য হলে পরে সেটা সংস্কার–সংক্রান্ত ঐকমত্য হবে। ব্যাপারটা একটু বিস্তারিত আলোচনা হওয়া দরকার।
পাঠকদের নিশ্চয়ই জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ সম্পর্কে স্মরণ আছে। তখন এটাকে প্রক্লেমেশন বলা হয়েছে। ছাত্ররা ব্যাপারটাতে তখন খুবই সিরিয়াস। জুলাই অভ্যুত্থানের ওপর একটি প্রক্লেমেশন যে নেই, তাতে তাঁরা খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। সে জন্য তাঁরা সরকারকে দোষারোপও করছিলেন। সরকার তখন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বলেছিল, প্রক্লেমেশন তো আর একা একা করা যাবে না। এ জন্য ঐকমত্য দরকার। সরকার সেই ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা বলা শুরু করবে।
আরও পড়ুননির্বাচন নিয়ে বিএনপির কেন এত তাড়া২২ নভেম্বর ২০২৪জুলাই সনদ বা চার্টার মানে তো কেবল জুলাইয়ের অভ্যুত্থান নয়, এটা একটা ইতিহাস। এ জন্যই এর অতীত আছে, বর্তমান আছে এবং ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা থাকবে। যাঁরা আন্দোলনে ছিলেন, তাঁরা সবাই এ জন্যই বলছেন, এ হচ্ছে একটা ধারাবাহিকতা। বায়ান্ন থেকে আজ পর্যন্ত সে ধারাবাহিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে। অনেকে, এমনকি ভারত বিভক্তির মধ্যেও আজকের বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকনির্দেশনা খুঁজে পান।
যদি সুনির্দিষ্ট করে বলি, তবে প্রক্লেমেশন হলো সেই জিনিস, যা ওই ভাঙাচোরার সময়টাকে ব্যাখ্যা করে এবং ভবিষ্যতের গড়ার আশা জাগিয়ে দেয়। এটা তাই আশাজাগানিয়া একটি বিশ্লেষণ, রাষ্ট্রসংস্কারের রূপরেখা নয়।
ডিসেম্বরের শেষেই ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা একটি প্রক্লেমেশনের জন্য জোর চাপ তৈরি করেছিল। তারা একটি সনদের খসড়াও তৈরি করে রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীদের কাছে পাঠিয়েছিল। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ছাত্রদের এই উদ্যোগে তখন বিভিন্ন অংশীজন তেমন আগ্রহ দেখায়নি। না, ছাত্রদের প্রতি কোনো অবহেলা নয়; বিষয়টাকে নিজেদের মতো করে গ্রহণ করার প্রশ্ন।
যেহেতু এটি বড়মাপের রাজনৈতিক প্রশ্ন, এই সনদের সঙ্গে সামগ্রিক রাজনীতিকে মিলিয়ে দেখার প্রশ্ন। কেউ প্রস্তাবিত সনদের সঙ্গে একমত হতে পারে, কেউ আংশিকভাবে একমত হতে পারে, আবার কেউ এমন হতে পারে যে সামগ্রিক ধারণার সঙ্গেই সে একমত নয়।
সাত মাস পর সমগ্র জাতি আজ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে মনে করছে ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা। যেমন নতুন গঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মনে করছেন, দেশের পুলিশ বাহিনী একটি কোয়ালিটি নির্বাচন করার জন্য মোটেই তৈরি হয়নি। কথাটার সঙ্গে আমি একমত। প্রশ্ন হলো গত সাত মাসে পুলিশকে কি কমপক্ষে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত না। এখনো সাত মাসের মধ্যে নেওয়া যায় না?রাষ্ট্রসংস্কারের বিষয়টি সনদের সমার্থক নয়। সংস্কার, বিশেষ করে বর্তমান সময়ে সংবিধান এবং নির্বাচন পদ্ধতির ওপর একটি গুণগত পরিবর্তনের কর্মসূচি। এটা কোনোক্রমে জুলাই অভ্যুত্থানের সনদ নয়। সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করেছে, যারা তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে। এই ছয় কমিশন ছয়টি স্প্রেডশিট তৈরি করেছে, যার ওপর অংশীদার হ্যাঁ–না অথবা খানিকটা পরিবর্তনের প্রস্তাব রাখতে পারবে। এখানে (টিক) দেওয়ার অথবা প্রস্তাব দেওয়ার পরামর্শ আছে। দুটির পদ্ধতি আলাদা।
দুটিকে কি এক করে দেখা হচ্ছে? এর তো কোনো সুযোগ নেই। তা ছাড়া দলগুলো যদি অল্প সংস্কারে রাজি হয়, তবে ডিসেম্বরে নির্বাচন হতে পারে, আর না হলে মার্চে বা জুনে হবে নির্বাচন, এটাও কী রকম কথা! এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সংস্কার সম্পর্কেই একটি ধোঁয়াশা তৈরি হয়ে যায় না কি? কম সংস্কার বা বেশি সংস্কার ব্যাপারটা কি এ রকম?
সাত মাস পর সমগ্র জাতি আজ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে মনে করছে ভালো ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা। যেমন নতুন গঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মনে করছেন, দেশের পুলিশ বাহিনী একটি কোয়ালিটি নির্বাচন করার জন্য মোটেই তৈরি হয়নি। কথাটার সঙ্গে আমি একমত। প্রশ্ন হলো গত সাত মাসে পুলিশকে কি কমপক্ষে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেত না। এখনো সাত মাসের মধ্যে নেওয়া যায় না?
জনপ্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশন সম্পর্কেও প্রায় একই কথা বলা যেতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সংস্কার কথাটার মানে কী? অবশ্যই সংস্কার মানে প্রায় খোলনলচে বদলে ফেলার কথা বলা যায়। আবার পুলিশ প্রো-অ্যাকটিভ না হয়ে মোটামুটি অ্যাকটিভ হয়েও কাজ চালিয়ে নিতে পারে। যাঁরা এখন দায়িত্বে আছেন, তাঁরা এইভাবে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করার কথা ভাবতে পারছেন বলে মনে হয় না। এ জন্যই প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পাওয়ার এক মাস পর যতটুকু সংস্কার (?) করেছেন, তার কথা বলছেন; আবার সেদিন বললেন, এখন পর্যন্ত সংস্কার শুরুই করেননি। হঠাৎ এভাবে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলায় দেশ কি একটু থমকে গেছে? আমার মনে হয়।
শেখ হাসিনার হৃদয়হীন ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে ছাত্র–জনতা যে বিজয় অর্জন করেছিল, তার কারণে এ দেশের জনগণ, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্রদের ওপর শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিশীল। ছাত্ররা যে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, সেটি তাঁরা গভীর মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং সেটিই স্বাভাবিক।
আর রাজনৈতিক দলগুলো তো নতুন রাজনৈতিক দলকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখবে। নতুন গঠিত এই দলের আচরণ বা উচ্চারণ তারা শুরু থেকেই মনোযোগের সঙ্গে পর্যালোচনা করছে এবং করবে।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যে এই দল এবং দলের সংগঠকদের প্রতি বিশেষভাবে অনুভূতিশীল, সেটা তো আর গোপন নেই। তাঁদের কথা যে প্রধান উপদেষ্টা বিশেষভাবে শোনেন, তা তাঁরা মনে করেন। তাঁরা এ–ও মনে করেন যে সরকার তাঁদের রাজনৈতিকভাবে বিশেষ সুবিধা দিতে পারে। যেমন দল গঠন করতে তাঁদের সময়ের প্রয়োজন, এ জন্যই তাড়াতাড়ি নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মসূচি থেকে সরকার পিছিয়ে যেতে পারে। এ জন্যই হয়তো ডিসেম্বর থেকে একবারেই জুনে চলে যাওয়া। প্রয়োজনে আরও পিছিয়ে যাওয়া যাবে।
আগামী দিনের রাজনীতি তাই সার্বিকভাবে আরও গভীর পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে।
● মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের সভাপতি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র জন ত ক জ ল ই সনদ ড স ম বর সনদ র স ঐকমত য অন ষ ঠ এ জন য র ওপর বলল ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
১৬৬ সুপারিশসহ ৩৪ রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্য কমিশনের চিঠি
ছয়টি সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশ ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনসহ ৩৪টি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। চিঠিতে দলগুলোকে আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে তাদের মতামত জানাতে বলা হয়েছে। তাদের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার বিষয়ে আলোচনা শুরু হবে। এরপর একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা হবে।
আজ সোমবার জাতীয় সংসদ ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, যখন যে দলের মতামত পাওয়া যাবে, সে সময় থেকেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে। আশা করছি, ১৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের মতামত জানাবে। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন থাকলে তারা কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। কমিশন এ বিষয়ে সবসময় প্রস্তুত রয়েছে।
সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানোর কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সুপারিশগুলোর মধ্যে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত ৭০টি, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার সংক্রান্ত ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত ২৬টি ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত ২০টি সুপারিশ ৩৪টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছে। তবে পুলিশ সংস্কার কমিশন মনে করে, তাদের সুপারিশগুলো প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
ড. আলী রীয়াজ বলেন, প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো- ‘একমত’, ‘একমত নই’ এবং ‘আংশিকভাবে একমত’। এ তিনটি বিকল্পের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এছাড়া প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায়ের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই ক্ষেত্রে ছয়টি বিকল্প আছে। সেগুলো হলো ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ এবং ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যেকোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোর ‘মন্তব্য’ দেয়ার একটি জায়গাও রাখা হয়েছে।
এ সময় রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ব্যাপারে নাগরিকদের মতামত জানার ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান ড. আলী রীয়াজ।