Prothomalo:
2025-03-12@12:20:58 GMT

দুই অর্থনীতি এবং অন্যান্য

Published: 12th, March 2025 GMT

মনে আছে, ১৯৬১ সালের জুন মাস নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে আমি ও নুরুল ইসলাম দুই অর্থনীতির বিষয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করি, যেখানে বক্তা ছিলাম আমি, নুরুল ইসলাম এবং পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন ডেপুটি চিফ ড. হাবিবুর রহমান। আমার বিআইডিএস সহকর্মী সুলতান হাফিজ রহমানের বাবা ড. রহমান দুই অর্থনীতি থিমের ওপর বেশ কিছু দারুণ নিবন্ধ লিখেছিলেন, যেগুলো প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের উষ্মার কারণ হয়। সে কারণে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের আয়োজিত এ রকম বিদগ্ধ আলোচনা চক্র ছাড়া অন্য কোথাও নিজের মতামত গণপ্রচারে তিনি অনিচ্ছুক ছিলেন।

এই সেমিনারে দুই অর্থনীতি বিষয়ে আমিও একটি নিবন্ধ পাঠ করি। নুরুল ইসলাম ও ড.

রহমান দুজনই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে গণমাধ্যমের দৃষ্টি বেশ ভালো রকম আকর্ষণ করে আমার নিবন্ধ। পরদিন সকালে পাকিস্তান অবজারভার খুলে দেখি প্রথম পাতার শিরোনামে লিখেছে ‘রেহমান সোবহান বলেছেন, পাকিস্তানে বর্তমানে দুই অর্থনীতি বিদ্যমান’। আমার নিবন্ধ আরও দুর্নাম কুড়ায়, কারণ, সে সময় আইয়ুব খান তাঁর উপনিবেশ সফরে হাজির ছিলেন। আমাদের কার্জন হল সেমিনারের দিনই ঢাকা থেকে ফিরলে সাংবাদিকেরা দুই অর্থনীতির বিষয়ে তাঁর মত জানতে চান। আমার মন্তব্যের পাশেই আইয়ুবের প্রতিক্রিয়াও প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে ছেপে অবজারভার লেখে, ‘আইয়ুব খান বলেছেন, পাকিস্তানের একটাই অর্থনীতি’। একজন অতি শক্তিমান সমরনায়কের মন্তব্যের পাশাপাশি এক ২৬ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকের মন্তব্য ছেপে দেওয়ার ঘটনায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনমতের গতিপরিবর্তনের ইঙ্গিত ছিল, অবশেষে যা স্বাধীন বাংলাদেশে চূড়ান্ত পরিণতি পায়।

সে বছরের শেষ দিকে, অক্টোবর নাগাদ, বোধ হয় দ্য পাকিস্তান অবজারভার আমাকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসার কারণেই, ‘কীভাবে একটি সুসংগঠিত পাকিস্তান গড়ে তোলা যায়’ বিষয়ে বিএনআর আয়োজিত জাতীয় সেমিনারে আমাকে বক্তব্য রাখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি বিএনআরের পূর্বপরিচিত ছিলাম। সামরিক শাসক নিজেদের সংস্কারক ও দেশ নির্মাতা ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে যেসব নিবেদিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল, বিএনআর ছিল তাদেরই একটি। যা–ই হোক, আইয়ুব তাঁর সরকারের রাজনীতিকরণে উদ্যোগী হলে বিএনআর বেশি করে রাজনৈতিক ভূমিকায় নামে। এর কারণ ছিল, নাগরিকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ, যাদের বেশির ভাগকে বাঙালি বলে অনুমান করা হতো, তারা ইসলামিক পরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল বলে মনে করা হচ্ছিল। ভাবা হতো, এই বিচ্ছিন্নতা একটা মুষ্টিমেয়সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর অপপ্রচারের ফলে তৈরি হচ্ছিল। এই দুষ্কর্ম সংশোধনে পাকিস্তান ভাবাদর্শ প্রচারে বিএনআর আরও বেশি করে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিশেষ অনুমোদিত প্রকাশনার মাধ্যমে আর জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করে, যেখানে দুই প্রান্তের বুদ্ধিজীবীদের জড়ো করা হবে, যাতে তাঁরা পরস্পরকে আরও ভালো করে বুঝতে পারেন এবং সেই সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যৌক্তিকতাও অনুধাবন করতে পারেন।

এদের বোধ হয় মনে হয়েছিল, রেহমান সোবহান বিপথগামী এক বুদ্ধিজীবীমাত্র, ঠিক বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দালাল নন; এবং এভাবেই তাঁকে আলাদা করে সরকারের অনুগত পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে আরও নিবিড় মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় সংহতি নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা যাবে। সেমিনারের নামকরণের উদ্দেশ্য ছিল, আমার নিবন্ধ পরিধির সীমা বেঁধে দেওয়া যাতে আমি মূল বার্তা থেকে সরে যেতে না পারি। আমার নির্দিষ্ট সূচি ছিল ‘পাকিস্তানের জাতীয় অর্থনীতির অবিচ্ছিন্নতা’ বিষয়ে নিবন্ধ উপস্থাপন।

আমার লেখা পড়ে বিএনআর নিশ্চয়ই বিস্মিত হয়েছিল। আমি যুক্তি দেখিয়েছিলাম যে পাকিস্তানের সংহতি সবচেয়ে ভালো রক্ষিত হবে যদি এই রাষ্ট্র তার দুটি খণ্ডে নীতিনির্ধারণে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দেয়। এতে প্রতিটি অংশ নিজস্ব রাজস্ব আদায় ও রপ্তানি বাণিজ্যের আয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে। সেই সময় অবধি দেশের অর্ধেকের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস ছিল পূর্ব পাকিস্তান।

সেমিনারের প্রাসঙ্গিক পর্বেই আমার উপস্থাপনা শেষ করেছিলাম এই মন্তব্য করে, যা আমার লিখিত একাডেমিক পেপারে ছিল না। যদি পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দেওয়া হয় এবং বছরের পর বছর যদি বৈষম্য বাড়তে থাকে, তাহলে এর ফলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিপন্ন হবে এবং পাকিস্তানকে একটি সংগঠিত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।

আমার বক্তব্য বিস্তার, বিশেষ করে পরিসমাপ্তি, যা লিখিত অংশের মধ্যে ছিল না, সেমিনারের মূল সুর থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিল। অধিবেশনের সভাপতিত্ব করছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্টের যে বিচারক, তিনি আমার বন্ধু ইফতেখার বুখারিকে খুঁজে বের করেন। বুখারি আমার সঙ্গে ওই সেমিনারে এসেছিল। তার কাছে সভাপতি জানতে চেয়েছিলেন, আমি যুবকটি কে এবং আমি কি জানতাম না যে পাকিস্তানে তখনো সামরিক শাসন চলছে!

বিএনআর ও তার রাজনৈতিক প্রভুদের দুশ্চিন্তা ভীষণ বেড়ে যায় যখন তারা আবিষ্কার করে যে লাহোরে আমার বক্তৃতা, যেটা পশ্চিম পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম মূলত উপেক্ষা করেছিল, সেটাই ঢাকার প্রধান খবরের কাগজগুলোর প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হয়। দ্য পাকিস্তান অবজারভার তাদের ২৩ থেকে ২৫ অক্টোবর ১৯৬১ সংস্করণে আমার নিবন্ধ পুরোটা ছাপে। এই প্রচার সরকার ও তার গুপ্তচর সংস্থাগুলোর রাজনৈতিক রাডারের পর্দায় আমাকে তুলে আনে। কয়েক বছর পর পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের এক অর্থনীতিক ড. আনিসা ফারুকি, আমার সঙ্গে তাঁর ভালো আলাপ হয়েছিল যখন তিনি এলএসইতে পিএইচডি করছেন, তিনি আমাকে জানান যে এই সেমিনারে নিবন্ধ পাঠের পর আমার লেখা খুঁজে বের করে সেগুলোর যুক্তি খণ্ডনে প্ল্যানিং কমিশনের কিছু সদস্যকে নিযুক্ত পর্যন্ত করা হয়েছিল।

দুই অর্থনীতি ধারণার কথা উচ্চারিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার একটি বেসরকারি রিপোর্টে, যেটি আওয়ামী লীগ জমানায়, যখন অনেক বেশি বাক্​স্বাধীনতা ছিল, তখন পেশ করেছিলেন বাঙালি অর্থনীতিকেরা। অক্টোবর ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সালের মাঝামাঝি সামরিক শাসনের পর্যায়ে শিক্ষাবিদেরা বিতর্কিত বিষয়ে তাঁদের মতামত প্রকাশে অনেকখানি দমিত বোধ করতেন এবং সে সময় নিজস্ব মতামত প্রকাশে সেমিনার অথবা কেতাবি লেখালেখির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকাই তাঁদের বেশি পছন্দ ছিল। 

(সংক্ষেপিত)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ন বন ধ প প রথম প র র জন র আয় জ হয় ছ ল আম র ব কর ছ ল সরক র রহম ন ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন জরুরি

মানসম্পন্ন শিক্ষা ও শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা না গেলে অর্থনৈতিক উন্নতির পরবর্তী ধাপে পৌঁছানো কঠিন হবে। আর শোভন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন জরুরি। যুব সম্প্রদায়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শোভন কর্মসংস্থান খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগও দরকার। 
গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ আয়োজিত ‘জাতীয় এসডিজি রিপোর্ট (ভিএনআর) ২০২৫: যুবসমাজের ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। এ আয়োজনে সহযোগিতা করে ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) বাংলাদেশ এবং ইউনাইটেড নেশনস পোভার্টি-এনভারমেন্ট অ্যাকশন।

এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক এবং গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা সহযোগী সওরোজা তালুকদার। অনুষ্ঠানে তরুণরা সরাসরি তাদের মতামত তুলে ধরেন। তৃতীয় ভিএনআর প্রতিবেদনে এসব মতামত অন্তর্ভুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন সংশ্লিষ্টরা। তরুণরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাকস্বাধীনতা এবং জলবায়ু– এই চারটি বিষয়ে তাদের মতামত দেন। সরকার ব্যবস্থাপনা আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা এবং সব খাতের প্রতিনিধিত্ব চান তারা।
অনুষ্ঠানে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত না হলে পরবর্তী ধাপে যাওয়া কঠিন হবে। তিনি আরও বলেন, বিগত সময়ে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাকস্বাধীনতা এবং জলবায়ু খাতে বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে এর সুফল সমগ্রিকভাবে নায্যতার ভিত্তিতে প্রতিটি নাগরিকের কাছে পৌঁছায়নি। আগামীতে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিতের ওপর জোর দেন। 
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, শোভন কর্মসংস্থান করতে গেলে নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন করা জরুরি। একই সঙ্গে তিনি বিভিন্নমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় আনার ওপর জোর দেন। 

তিনি আরও বলেন, অগ্রাধিকার সমস্যার প্রতিটির ভেতরে আরও অগ্রাধিকার ইস্যু আছে। এর মধ্যেও অনেক টানাপোড়েন আছে। আমরা কীভাবে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব, সেটাই বড় কথা। সেটা যদি ভালোভাবে করা যায় তাহলে প্রতিবেদন (ভিএনআর) ভালোভাবে হবে। প্রতিবেদন ভালো হলো কিন্তু কাজের কাজ হলো না– যা অতীতে হয়েছে। তাহলে কিন্তু অগ্রগতি হবে না। 
ইউএনডিপি বাংলাদেশের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক বলেন, স্বপ্রণীত জাতীয় পর্যালোচনার ভিত্তিতে ভিএনআর প্রতিবেদন প্রস্তুত হওয়ার কথা। কিন্তু এ প্রতিবেদন চূড়ান্তকরণে হস্তক্ষেপ ছিল বেশি। তাই প্রতিবেদনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি। নাগরিকের মতামতের ভিত্তিতেই পরবর্তী প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হবে। এ ক্ষেত্রে শুধু সাফল্য নয়, ব্যর্থতার বিষয়েও উল্লেখ থাকবে।  
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক (এসডিজি-বিষয়ক) শিহাব কাদের বলেন, প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে যুবসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগে যুব সেন্টার চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও জানান। 
অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত যুব ঘোষণাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যুব সমাজের ভূমিকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব উন্নয়নশীল দেশ যুব সম্প্রদায়ের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ করেছে, সেসব দেশ দ্রুত আর্থসামাজিক উন্নয়ন অর্জনে সক্ষম হয়েছে। দারিদ্র্যের মাত্রাও সেসব দেশ দ্রুত হারে হ্রাস করতে পেরেছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন জরুরি
  • মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আগের চেয়ে বেড়েছে