লক্ষ্মীপুরের গণগ্রন্থাগার স্থাপনের উদ্যোগ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী পদক্ষেপ। ৫টি উপজেলার ৩৬টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয়ে গ্রন্থাগারগুলো স্থাপিত হয়েছে। বাকি ২২টি ইউপি কার্যালয়ে গ্রন্থাগার স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন। লক্ষ্মীপুর জেলা ও উপজেলা প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে গণগ্রন্থাগারগুলো। এতে যুক্ত হয়েছেন শিক্ষকসহ নানা পেশার মানুষ। প্রশাসনের এই প্রচেষ্টা কেবল বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবে না, বরং এটি একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভিত্তিও গড়ে তুলতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এবং বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যমের কারণে বই পড়ার হার ক্রমে কমে আসছে।

প্রথম আলোর উদ্যোগে ২০২১ সালে ওআরজি-কোয়েস্ট পরিচালিত এক জরিপে উঠে আসে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে তরুণদের পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়ার হার প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশ কমেছিল। বাংলাদেশে গ্রামীণ পর্যায়ে পাঠাগারব্যবস্থার অভাব দীর্ঘদিনের সমস্যা। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসনের এমন উদ্যোগ সত্যিকার অর্থেই প্রশংসার দাবিদার। এই পাঠাগারে কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত আসা বোঝায়, তারা জ্ঞানার্জনে আগ্রহী। এর ফলে তাদের চিন্তাধারা পরিশীলিত হবে, সৃজনশীলতা বাড়বে এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা গড়ে উঠবে।

তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতায় তরুণেরা মুঠোফোনের স্ক্রিনে বেশি সময় ব্যয় করছে, যা তাদের মনোযোগের স্থায়িত্ব কমিয়ে দিচ্ছে। পাঠাগার এ সমস্যা মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারে। এরপরও পুঁথিপাঠের আসর এবং সাহিত্যসভার মতো উদ্যোগ পাঠাগারকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে। এ উদ্যোগ থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারি, একজন সরকারি কর্মকর্তার সদিচ্ছা থাকলে কীভাবে সমাজে ইতিবাচক সম্ভাবনার দুয়ার খোলা সম্ভব। জেলা প্রশাসক রাজীব কুমার সরকারের মন্তব্য থেকেও স্পষ্ট, তিনি এ উদ্যোগকে কেবল একটি আনুষ্ঠানিক প্রকল্প হিসেবে নয়, বরং একটি স্থায়ী ও কার্যকর সামাজিক পরিবর্তনের অংশ হিসেবে দেখছেন। প্রশাসনের পরিকল্পিত বাজেট বরাদ্দ ও সমন্বিত উদ্যোগের ফলে এটি সফল হয়েছে।

তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। পাঠাগারে কী ধরনের বই থাকবে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি পাঠাগারে আকর্ষণীয় ও জ্ঞানসমৃদ্ধ বই না থাকে, তবে এটি তরুণদের আগ্রহ ধরে রাখতে পারবে না। নিশ্চিত করতে হবে যে এখানে সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শনসহ বহুমুখী বিষয়ের বই থাকবে এবং তা নিয়মিত হালনাগাদ হতে থাকবে। সেই সঙ্গে তরুণদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যেন পাঠাগারগুলো ভূমিকা রাখতে, তা–ও একটি বিবেচনার বিষয়। বাংলাদেশে এ উদ্যোগ অনুকরণীয় হতে পারে।

দেশের অন্যান্য জেলার স্থানীয় প্রশাসন যদি এ মডেল অনুসরণ করে, তাহলে বই পড়ার হার বৃদ্ধি পাবে এবং একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে। প্রশাসনের সদিচ্ছা, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এবং সঠিক পরিকল্পনার সমন্বয়ে এটি আরও সফল হয়ে উঠবে।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ঢালাইকার থেকে প্রথম মানুষ হিসেবে যেভাবে মহাকাশে পা রাখলেন গ্যাগারিন

দিনটি ছিল ১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। কাজাখস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিচালিত মহাকাশ বন্দর বাইকোনুর কসমোড্রমে শীতের চাদর ভেদ করে ভোরের আলো ফুটতেই শুরু হয়েছে প্রকৌশলীদের দৌড়ঝাঁপ। প্রতিটি যন্ত্র, প্রতিটি সংযোগ—দ্বিগুণ সতর্কতায় পরীক্ষা চলছে। লঞ্চপ্যাডে (যে স্থান থেকে রকেট উৎক্ষেপণ হয়) তখন উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। এর মধ্যে সেখানে অপেক্ষমাণ ভস্তক–১ রকেটের ককপিটে গিয়ে বসলেন এক তরুণ। গায়ে চাপানো কমলা রঙের স্পেস স্যুট আর চোখে বিস্ময়ের ঝিলিক।

সেই ঐতিহাসিক সকালে ২৭ বছর বয়সী ওই তরুণকে নিয়ে ছোট্ট মহাকাশ যানটি ছুটে গেল অসীম অজানার উদ্দেশ্যে। সামনে সীমাহীন অনিশ্চয়তা। আর কখনো চেনা ডেরায় ফিরতে পারবেন কি না, জানা নেই। যে গন্তব্যের উদ্দেশে ছুটে চলেছেন সেখানে পৌঁছাতে পারবেন কি না, তার ঠিক নেই। যাত্রাপথে উনিশ-বিশ হলে নেই বেঁচে ফেরার একরত্তি সম্ভাবনা। এরপরও এক অদম্য নেশায় পাড়ি দিলেন পৃথিবী নামক গ্রহের চৌহদ্দি। আর ফিরলেন ইতিহাসের খোলনলচে বদলে দিয়ে। মহাকাশে যাওয়া প্রথম ব্যক্তি হিসেবে পা রাখলেন পৃথিবীর বুকে।  

ইউরি গাগারিনের ছেলেবেলা কেটেছে সোভিয়েত রাশিয়ার স্মোলেনস্কক অঞ্চলের ক্লুশিনো গ্রামে, জন্মও সেখানেই। বাবা-মা দুজনই ছিলেন কৃষক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁদের পরিবার নাৎসিদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। যুদ্ধের প্রভাব সংসারে এসে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব সংসারের হাল ধরার তাড়না অনুভত করেন তিনি। ১৯৪৯ সালে বয়স যখন ১৫, ঠিক করলেন মাধ্যমিক স্কুলের পড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে নেমে পড়বেন।

বলছি বিখ্যাত সোভিয়েত মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিনের কথা। কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া গ্যাগারিন কৈশোরে ছিলেন ঢালাইকার। আকাশে ওড়ার অদম্য নেশা তাঁকে ঢালাই কারখানা থেকে নিয়ে গেছে উড়োজাহাজের ককপিট পর্যন্ত। সময়ের আবর্তে সেই স্বপ্ন আকাশ ছাড়িয়ে ছুঁয়েছে মহাকাশের গণ্ডি। ইউরি গ্যাগারিনের দুঃসাহসী অভিযান খুলে দিয়েছে মহাকাশ গবেষণা নিয়ে অপার সম্ভাবনার দুয়ার।
প্রথম মানব হিসেবে এই তরুণের মহাকাশে পা রাখার ঘটনা সে সময় বিশ্বের বুকে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বিশ্বদরবারে রাতারাতি তারকা বনে যান ইউরি গ্যাগারিন। তাঁকে দেওয়া হয় জাতীয় বীরের খেতাব। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেতর-বাহির থেকে তাঁর ঝুলিতে যোগ হতে থাকে একের পর এক পুরস্কার-সম্মাননা।

সংসারের হাল ধরতে ঢালাইকারের চাকরি

ইউরি গ্যাগারিনের ছেলেবেলা কেটেছে সোভিয়েত রাশিয়ার স্মোলেনস্কক অঞ্চলের ক্লুশিনো গ্রামে, জন্মও সেখানেই। বাবা-মা দুজনই ছিলেন কৃষক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁদের পরিবার নাৎসিদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। যুদ্ধের প্রভাব সংসারে এসে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব সংসারের হাল ধরার তাড়না অনুভব করেন তিনি।

১৯৪৯ সালে বয়স যখন ১৫, ঠিক করলেন মাধ্যমিক স্কুলের পড়া ছেড়ে দিয়ে কাজে নেমে পড়বেন। বাবা-মা ছাড়তে না চাইলেও সিদ্ধান্তে অনড়, চলে গেলেন মস্কোয় চাচার কাছে। তাঁর পরামর্শে মস্কোর উপকণ্ঠে ল্যুবের্তস্কি শহরের কৃষিযন্ত্র বৃত্তি বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। তরুণ শ্রমিকদের সন্ধ্যাকালীন বিদ্যালয়ে তার ভবিষ্যৎ পেশা নির্ধারিত হলো ঢালাই কলঘরের ঢালাইকার।  

—‘পৃথিবী দেখছি’ শিরোনামে নিজের লেখা বইয়ে ইউরি গ্যাগারিন বলেছেন, ‘পেশাটা সহজ নয়। তাতে শুধু জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নয়, রীতিমতো দৈহিক শক্তিও দরকার।’
আকাশে ওড়ার নেশা

মহাকাশে সফর অভিযানের পর বিশ্বদরবারে রাতারাতি তারকা বনে যান ইউরি গাগারিন

সম্পর্কিত নিবন্ধ