কোন দল কোথা থেকে টাকা পাচ্ছে, কেন পাচ্ছে?
Published: 12th, March 2025 GMT
আমাদের কাছে খুব পরিচিত একটা খবর হচ্ছে, জিডিপি অনুপাতে রাজস্ব আদায়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। এর পাশাপাশি আরেকটি খবর পরিচিতি পাওয়াটা জরুরি। সেটা হচ্ছে, চাঁদাবাজির মতো ব্যবস্থা কীভাবে রাষ্ট্রের মধ্যে আরও অসংখ্য ‘রাষ্ট্র’ কিংবা ‘জমিদারি’ তৈরি করছে এবং এসব ‘জমিদারির’ একেকজন অধিপতির কাছে মানুষ কীভাবে তাদের আয়ের বড় একটা অংশ ‘খাজনা’ হিসেবে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
কয়েক দিন আগে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের খবরে দেখছিলাম, বায়তুল মোকারমের আশপাশে ফুটপাতে ৪ ফুট বাই ৪ ফুট জায়গায় দোকানদারি করার জন্য বছরে দেড় লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন ইজারাদারেরা। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দিনে তাঁদেরকে ৭০ টাকা চাঁদা দিতে হতো। সরকার পতনের পর নতুন যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, তাতে নতুন পক্ষকে তাঁরা আগের চেয়ে দ্বিগুণ চাঁদা দিতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু নতুন পক্ষের দাবি, বছরে এককলীন দেড় লাখ টাকা।
কিছুদিন আগে, গাজীপুরের শ্রীপুরে সাঙ্গপাঙ্গসহ দেশি অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়ে একটি বাজারে চাঁদা তোলে একটি সংঘবদ্ধ দল, তাতে নেতৃত্ব দেন বিএনপির একজন নেতা। একটি ভিডিওতে ওই নেতাকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আপনাদের আমি বলছি, দোকানদার ভাইয়েরা। আজকে থেকে আপনারা খাজনা দেওয়া শুরু করে দেন। এখন এই মুহূর্তে আমার লোকজন খাজনা ওঠাবে। কেউ বাধার সৃষ্টি করলে তাকে কঠিনভাবে প্রতিহত করব।’
ভাইরাল হওয়া ভিডিওর সূত্র ধরে তাঁকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ফুটপাতের হকার, ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বাজারের সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, ডাব বিক্রেতাসহ বিপুলসংখ্যক মানুষকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা–কর্মীদের ‘খাজনা’ দিয়েই চলতে হয়।
এর বিনিময়ে তাঁরা ব্যবসা করে জীবন চালান। রাজনীতি এই কারণেই বাংলাদেশে অত্যন্ত মুনাফাদায়ী ব্যবসা। রাজনীতি সে কারণেই এত রক্তপাতের। দলে দলে লোক ক্ষমতাসীনদের পতাকাতলে গিয়ে ভেড়ে। অমুক ভাই, তমুক ভাইয়ের নামে স্লোগান দেয়।
এর বিনিময়ে একেকটা বাজার, একেকটা হাট, একেকটা জলমহাল, একেকটা ফুটপাত বন্দোবস্ত দেওয়া হয় পার্টির পাতি ও উপনেতাদের কাছে। তাঁরা কিছু কর্মী বাহিনী পোষেন। পার্টির ফান্ডে চাঁদা দেন। তার বিনিময়ে জনগণের কাছ থেকে ‘খাজনা’ তোলেন। পরিবহন খাত তাঁদের চাঁদাবাজি ও মুনাফাবাজির আরেকটি বড় খাত। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পকেট উপচে পড়ে এ খাত থেকে। বিনিময়ে জনগণকে উপহার দেওয়া হয় চরম নৈরাজ্য। প্রতিদিন দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর মিছিল আর জিম্মি দশা তার দৃষ্টান্ত।
এই প্রশ্নটা যৌক্তিক। কেননা, চব্বিশের অভ্যুত্থান সবখানেই জবাবদিহির প্রশ্নটাকে সামনে এনেছে। বিএনপি এ মুহূর্তে সবচেয়ে প্রভাবশালী দল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে হলে বিএনপি তো পারেই সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিতে। রাষ্ট্র সংস্কারে তারা ৩২ দফা দিয়েছে। একইভাবে দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি সংস্কারের ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নিলে নিশ্চিত করেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আসত। অন্য দলগুলোর জন্যও দৃষ্টান্ত হতে পারত।৫ আগস্টের আগপর্যন্ত আওয়ামী লীগের পরিচয়ে এই চাঁদাবাজিটা করা হতো। ৫ আগস্ট দুপুরের পর থেকে বেশির ভাগ জায়গাটা দখলে নিতে শুরু করে বিএনপি। কোথাও কোথাও কেউ বেশি মাত্রায় বাড়াবাড়ি করেছে এবং তাদের খবর প্রকাশ্যে এসেছে। সংবাদ প্রকাশের পর তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু দেশজুড়ে চাঁদাবাজির নেটওয়ার্কের সিংহভাগ অংশ আওয়ামী লীগের জায়গায় বিএনপির নেতাকর্মীরা দখল করে নিয়েছে এমন অভিযোগ স্বীকার করতে নারাজ বিএনপি। ৫ আগস্টের পর থেকে এ রকম চাঁদাবাজি ও অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত প্রায় দেড় হাজার জনকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। কিন্তু এটা শুধু বহিষ্কারের বিষয় নয়, এটা রাজনৈতিক দলগুলোর একটি স্বীকৃত চর্চা।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের বরাতে ৯ মার্চ ডেইলি স্টার শুধু ঢাকা শহরের পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির যে তথ্য দিয়েছে, সেটা অত্যন্ত ভয়াবহ। ঢাকা শহরের ৫৩টি পরিবহন টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করা হয়। প্রতি মাসে এটি ৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা, আবার কখনো তা বেড়ে ৮০ কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছায় বলে একটি সরকারি তদন্তে উঠে এসেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্র থেকে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে আরও দেখা গেছে যে স্থানীয় প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা, বিশেষ করে বিএনপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।
অভিযোগ থেকে বাদ যাচ্ছেন না অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরাও। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের নাম কিংবা পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়মিতই আসছে।
আমাদের এখানে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো টিকে আছেই এ রকম চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, তদবিরবাজির নেটওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করে।.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র র জন ত ক ক র কর সরক র দলগ ল ব যবস ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
নন-এমপিও শিক্ষকদের দাবি মানল সরকার, আন্দোলন প্রত্যাহার
নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শিক্ষকদের টানা ১৭ দিন আন্দোলনের পর শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরারের সঙ্গে বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে সম্মিলিত নন-এমপিও ঐক্য পরিষদ। শিক্ষা উপদেষ্টার আশ্বাস পেয়ে আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন শিক্ষকরা। বুধবার (১২ মার্চ) থেকে এমপিওভুক্তির কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি।
মঙ্গলবার (১১ মার্চ) রাতে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন সম্মিলিত নন-এমপিও ঐক্য পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক অধ্যক্ষ মো. সেলিম মিঞা।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেছেন, “আমরা নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, মানববন্ধন ও স্মারকলিপির মাধ্যমে দাবি পূরণে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলাম। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সব জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি প্রদান ও মানববন্ধন করে সরকারকে এমপিওভুক্তির আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু, সরকার আমাদের আহ্বানে সাড়া না দেওয়ায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৭ দিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে টানা অবস্থান কর্মসূচি চলমান রেখেছিলাম। কর্মসূচি চলাকালে দুজন নন-এমপিও শিক্ষক আর্থিক দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যান এবং কর্মসূচি চলাকালীন এই রমজানে রোজা, তারাবির নামাজ, ইফতার, সাহরি ও রাতে অবস্থান করে অনেক শিক্ষক-কর্মচারী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।”
অধ্যক্ষ মো. সেলিম মিঞা বলেন, “বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের সময় পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আমরা চেয়েছি, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দীর্ঘ ২৫-৩০ বছর ধরে বেতনহীন শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে তাদের বেতনের ব্যবস্থা করা হোক। আজ আমরা ওই দাবিতে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাতের লক্ষ্যে পদযাত্রা করি। পরে পুলিশ ও প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের দাবির বিষয়ে আলোচনার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আলোচনা প্রস্তাব দেওয়া হয়।”
তিনি আরো বলেন, “আলোচনায় সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়ের ও আরেকজন যুগ্ম সচিব। নন-এমপিও শিক্ষকদের পক্ষে ছিল সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক প্রিন্সিপাল সেলিম মিঞার নেতৃত্বে ৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল। বেশকিছু বিষয়ে আলোচনা হয়। এ সময় শিক্ষা সচিব আমাদের সব কথা লিপিবদ্ধ করেন এবং উভয়েই আমাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেন। আলোচনা চলার সময় সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সচল সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নীতিগতভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিব আমাদের লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি প্রত্যাহারের জন্য অনুরোধ করেন।”
সম্মিলিত নন-এমপিও ঐক্য পরিষদের প্রধান সমন্বয়ক বলেন, “শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা সচিব জানান, বুধবার থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির প্রাথমিক কাজ শুরু হবে এবং আগামী মে মাসের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত আকারে এমপিওর তালিকা প্রকাশ করা হবে। সরকার আমাদের এমপিওভুক্তির দাবি মেনে নেওয়ায় সমন্বয়ক পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তক্রমে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত ঘোষণা করা হলো।”
তিনি বলেন, “আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নন-এমিপও শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে থেকে যারা আহত ও অসুস্থ হয়েছেন এবং চিকিৎসাধীন, তাদের প্রতি সমবেদনা ও দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি। বিভিন্ন সময়ে আর্থিক অভাব অনটনের জন্য সুচিকিৎসা না পাওয়ায় আমাদের ৯ জন শিক্ষক মারা গেছেন। তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করছি।”
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির মুখ্য সমন্বয়ক অধ্যক্ষ মো. দবিরুল ইসলাম, অধ্যক্ষ মো. নাজমুস শাহাদত আজাদী, সাংগঠনিক সমন্বয়ক অধ্যক্ষ মনিমুল হক, যুগ্ম সাংগঠনিক সমন্বয়ক অধ্যক্ষ ইমরান বিন সোলায়মান, সমন্বয়ক অধ্যক্ষ মো. সাজ্জাদ হোসেন, সমন্বয়ক অধ্যক্ষ মো. আব্দুস সালাম প্রমুখ।
ঢাকা/হাসান/রফিক