বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় সুশাসন ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের দায়িত্বে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, প্রতিষ্ঠানটির স্বীয় সুশাসন লইয়াই প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে, যাহা সম্পূর্ণ উচ্চশিক্ষা খাতের জন্যই উদ্বেগজনক। মঙ্গলবার সমকালে প্রকাশিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে ঋণের মহোৎসব’ শিরোনামের প্রতিবেদনে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর সূত্রে জানা যাইতেছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করিয়াই কর্মকর্তাদের নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত বিপুল অঙ্কের ঋণ প্রদান করিয়াছে ইউজিসি। অনেক কর্মকর্তাকেই নিয়ম ভঙ্গ করিয়া প্রাপ্যতার অধিক ঋণ দেওয়া হইয়াছে। অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটির অনেক কর্মী দীর্ঘ দিনব্যাপী চাকুরি করিলেও বাড়ি তৈয়ারিতে ঋণ পাইতেছেন না। অথচ একই ব্যক্তি একাধিকবার ঋণ গ্রহণ করিয়াছেন।
উচ্চশিক্ষায় উদ্ভাবন ও গবেষণায় উৎকর্ষ অর্জনের মাধ্যমে টেকসই আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়িয়া তুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কী ভূমিকা রাখিতে পারে, তাহা আমরা জানি। সেই ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে সার্বিক সুবিধা ও দিকনির্দেশনা দান ইউজিসির মূল কাজ, ইহাও জানি। কিন্তু সংস্থাটি সেই সকল দায়িত্ব কতটা সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতেছে– উহা লইয়া প্রশ্ন বহুদিন যাবৎ। বিশেষত দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের প্রশাসনে যেই প্রকার দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা প্রায়শ সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানিয়া থাকি, সেইখানেই উহা স্পষ্ট। এখন যখন ইউজিসির স্বীয় প্রশাসনে সাধারণ ঋণ লইয়া অনিয়ম ঘটিয়াছে বলিয়া অভিযোগ, তখন প্রতিষ্ঠানটি অন্যদের জবাবদিহি কীরূপে নিশ্চিত করিবে– সেই সন্দেহ প্রস্তরীভূত হয়। ধারণা ছিল, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে দেশে পট পরিবর্তনের তরঙ্গ ইউজিসির তটেও আঘাত হানিবে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে সেই অর্থে সংস্কারের স্পর্শ লাগে নাই বলিলেই চলে। প্রতিষ্ঠানটির উচ্চ পদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটিলেও বাস্তবে তথায় ব্যক্তিরই পরিবর্তন ঘটিয়াছে; উহার পরিচালন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের প্রত্যাশা পূরণ হয় নাই। সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউজিসিতে চেয়ারম্যানের এপিএস পদ না থাকিলেও প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র সহকারী সচিব নিজেকে জনপরিসরে এই পরিচয়ে পরিচিত করিয়া থাকেন। তাঁহার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগও বিস্তর। উপরন্তু, তাঁহার নামে বিপুল অঙ্কের ঋণ থাকিবার পরও তিনি বর্তমান কমিশনের আমলে আরও চার লক্ষ টাকা ঋণ গ্রহণ করিয়াছেন। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে ইউজিসির যেই প্রকার নৈতিক মান জরুরি, উহা এহেন অভিযোগের কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হইবে। ইহা স্বতঃসিদ্ধ, অন্যদের ভ্রান্তি চিহ্নিতকরণের পূর্বে নিজের পরিশুদ্ধ হওয়া জরুরি। আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাও– কথাটা বাত কি বাত নহে। ইউজিসি নিজেকে সেই অবস্থানে দেখাইতে না পারিলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ তাহাকে মান্য করিতে কিংবা তাহার নির্দেশনা পালনে গড়িমসি করিবার অবকাশ পাইবে।
আমরা জানি, দেশের উচ্চশিক্ষায় এখনও অনেক করণীয়। বিশেষ করিয়া জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর এই সুযোগ আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। সেইখানে ইউজিসির কতটা ভূমিকা পালন করিয়াছে, উহা অনুধাবনযোগ্য। সপ্ত-মহাবিদ্যালয় সংকট ইউজিসির নিয়ন্ত্রণাধীন হইলেও এখনও উহার টেকসই সমাধান আসে নাই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় এখনও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করিতে পারে নাই। এই সকল উচ্চশিক্ষাঙ্গনে অধ্যয়নের পরিবেশ নিশ্চিতে ইউজিসি কতটা উদ্যোগী–সেই প্রশ্নও কম শক্তিশালী নহে। অথচ ইউজিসি চাহিলে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করিতে পারে। সেই ক্ষেত্রে পূর্বেই ইহার কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আনয়ন জরুরি।
আমরা প্রত্যাশা করি, ইউজিসির ঋণ লইয়া যেই সকল অনিয়মের অভিযোগ উঠিয়াছে, সেইগুলি গুরুত্ব সহকারে তদন্তপূর্বক সুরাহা করিবে। অনিয়মের সহিত সংশ্লিষ্টদিগের শাস্তির ব্যবস্থা করিয়া ইউজিসিকে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করিতে হইবে, যাহাতে প্রতিষ্ঠান স্বচ্ছ থাকিতে পারে এবং উচ্চশিক্ষায় তদারকিতে তাহার নৈতিক মান বজায় রাখিতে সক্ষম হয়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইউজ স র ন কর ত কর য় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
বেপরোয়া নিরীক্ষা, ট্রাম্প বৈশ্বিক বিভাজনকারী
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত কয়েক সপ্তাহে ওয়াশিংটনজুড়ে যে বিপ্লবের বিস্তৃতি ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার সবচেয়ে স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হলো– এটা প্রথমে পুড়িয়ে ফেলবে, পরে বেপরোয়া আচরণের পরিণতি খুঁজে বের করবে। তাঁর এ ধরনের আচরণের মূল্য এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
গতকাল বুধবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পণ্য আমদানিতে শুল্ক আরোপের প্রভাব নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানতেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন তাঁর দীর্ঘ প্রতিশ্রুতিলব্ধ আনুপাতিক পাল্টা শুল্ক বা রিসিপ্রক্যাল ট্যারিফ ঘোষণা করলেন, তখন বিভিন্ন দেশের বাজার ডুবে যাবে; পাশাপাশি অন্য দেশগুলোও প্রতিশোধ নিতে মাঠে নামবে। কিন্তু চাপের মুখে বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, তারা অর্থনৈতিক ভূমিকম্পের দ্বিতীয়-ক্রমের প্রভাব কেমন হতে পারে, তা যাচাইয়ের জন্য মাত্র কয়েক দিন সময় পেয়েছিলেন। অর্থাৎ, এ নিয়ে তারা গভীরভাবে চিন্তা করা বা বুঝে ওঠার সুযোগ পাননি।
ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা এখনও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক ধাক্কা কেটে যাওয়ার পর অভূতপূর্ব জটিলতার একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থা পরিচালনার কৌশল বাতলাতে পারেননি। এ অবস্থায় বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির নেতা ট্রাম্প কেবল অন্য সবাইকে হুমকি-ধমকি আর আলোচনাই চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম একমাত্র পরাশক্তি চীনের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে অব্যবস্থাপিত উত্তেজনার কথাই ধরুন। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বর্ণনা অনুযায়ী, বাণিজ্যযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে ট্রাম্প ও চীনের শীর্ষ নেতা শি জিনপিংয়ের মধ্যে কোনো বাস্তব কথোপকথন বা তাদের ঊর্ধ্বতন সহযোগীদের মধ্যে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।
গত বুধবার ট্রাম্পের তাড়াহুড়া করে তৈরি করা দেশভিত্তিক শুল্ক নির্ধারণের সূত্রে চীনের সব পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছিল। গাড়ির যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে আইফোন, ওয়ালমার্ট ও অ্যামাজনের অ্যাপে যা আছে তার বেশির ভাগই এসেছে এর আওতায়। যখন জিনপিং পাল্টা পদক্ষেপ নেন, তখন ট্রাম্প তাঁকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের আলটিমেটাম দেন। এমন একজন নেতার সামনে তিনি লাল পতাকা তুলে ধরেন, যিনি কখনও ওয়াশিংটনের সামনে নতজানু বা পিছু হটতে চান না। গতকাল বুধবার উত্তেজনা হ্রাসের জন্য কোনো দৃশ্যমান কৌশল ছাড়াই শুল্ক ১০৪ শতাংশে পৌঁছে যায়।
বিশ্লেষকরা জানান, ট্রাম্প প্রশাসনের এ শুল্ক আরোপের জেরে চীনে থাকা মার্কিন কোম্পানিগুলোকে মূল্য দিতে হবে। চীন এখনও মার্কিন শুল্কের প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি স্পষ্ট করেনি। তবে তাদের হাতে কেবল একের পর এক শুল্ক আরোপ করার চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের নিক মারোর মতে, উদাহরণস্বরূপ বেইজিং চীনে কর্মরত মার্কিন কোম্পানিগুলোর জীবনকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।
মারো আলজাজিরাকে বলেন, বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা এখনও বিশ্বাস করেন, মার্কিন করপোরেট খাত এ উত্তেজনা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে। আমি মনে করি, বাস্তবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর প্রভাব আগের তুলনায় অনেক কম এবং বেইজিং তাদের যে কৃতিত্ব দেয়, তার চেয়ে অনেক কম।
তিনি বলেন, এর অর্থ হলো, চীন যদি মনে করে মার্কিন ব্যবসায়িক খাত এ উত্তেজনা কমানোর জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করছে না, তাহলে তারা আরও বেশি উগ্র প্রতিক্রিয়া ও কোম্পানিগুলোকে শাস্তি দেওয়ার জন্য আরও কঠোর প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে পারে। মারো জানান, ট্রাম্পের প্রথম বাণিজ্যযুদ্ধের সময় বেইজিং একই ধরনের কৌশল নিয়েছিল। কিন্তু এর প্রভাব সম্পূর্ণরূপে পরিমাপ করা কঠিন ছিল। কারণ, তখন অনেক মার্কিন কোম্পানি নীরব ছিল; তারা চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করে কিছু বিষয় সঠিক জায়গায় রেখেছিলেন।