জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠিত হয়েছে। বিতর্ক উঠেছে, এ কি আরেকটি ‘কিংস পার্টি’? কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে কিংস পার্টি গঠনের বাস্তবতাই নেই। কিন্তু কিংস পার্টি গঠনের অন্তত তাত্ত্বিক বাস্তবতা এ দেশে রয়েছে।

আমরা জানি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ক্ষমতার কাঠামো নিয়ন্ত্রণ করে একটি ছোট কিন্তু প্রভাবশালী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার পক্ষে কাজ করে, যা তাদের কাঙ্ক্ষিত স্থিতিশীলতা ও নির্ভরতা প্রদান করে। এই ক্ষুদ্র অভিজাত গোষ্ঠীর প্রভাবের ফলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো অধিকাংশ সময় কয়েকজনের স্বার্থানুযায়ীই নির্ধারিত হয়।

বাংলাদেশের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রও দীর্ঘকাল ধরে দেশের শাসনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে আসছে। তারা ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণকে কেবল পছন্দ হিসেবে নয়, বরং একটি কৌশলগত প্রয়োজন হিসেবে দেখে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কেন্দ্রীয় স্তরায়িত কাঠামো সরকারি আদেশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দরকারি স্থিতিশীলতা প্রদান করে। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত পরিবেশে এমন স্থিতিশীলতা বাধার মুখে পড়ে।
গণঅভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতা রাজনৈতিক অর্থনীতির অভিজাত গোষ্ঠী এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র উভয় পক্ষের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিই কিংস পার্টি গঠনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতিতে কিংস পার্টি সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা নিরসনের উপায় হিসেবে গণ্য হয়। রাজনৈতিক বিভাজনের ঝুঁকি এড়িয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র প্রায়ই এমন পদক্ষেপ অবলম্বন করে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে পারে, এমন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দরকষাকষির দ্বারও এতে উন্মুক্ত হয়।
তৃতীয় বিশ্বের বাংলাদেশে যেখানে সামাজিক মর্যাদা ‘ক্ষমতা’ দিয়ে নির্ধারিত হয়; সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রসৃষ্ট কিংস পার্টির বাস্তবতা সেখানে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সামরিক সরকারের মতো রাষ্ট্রক্ষমতা দখল না করেও সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক, জনবিচ্ছিন্ন বা জনসমর্থনপুষ্ট গোষ্ঠীগুলোর সমন্বয়ে কিংস পার্টি গঠন করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে কিংস পার্টি গঠন চেষ্টার কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান কেবল বিদ্যমান স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেনি; দেশের গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজনগুলো আরও স্পষ্ট করেছে। এই গভীর বিভাজনের ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলো মোকাবিলায় বিভিন্ন গোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ কিংস পার্টির ধারণা গ্রহণ করতে পারে। এই ধারণা ক্ষমতা দখলের সুযোগ-সন্ধানী উপায় হিসেবে নয়, বরং বিরোধী স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংহতি স্থাপনের প্রয়োজনীয় শক্তি হিসেবে মূল্যায়িত হয়। যদি এই দলটি মাঠ পর্যায়ে সুসংহত নেতৃত্ব ও নীতি নির্দেশনা প্রদান করতে পারে, তবে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটতে পারে। বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায় সক্ষমতাও অর্জন করতে পারে।

এমন পরিস্থিতিতে যদি সামরিক অভ্যুত্থান বা গণঅভ্যুত্থানের পর কোনো একটি দলকে মাঠ পর্যায়ে সুসংহত নেতৃত্ব এবং নীতি নির্দেশনা প্রদান করে জনপ্রিয়তা লাভের বিশেষ সুযোগ করে দেওয়া হয়, তাহলে তাকে কিংস পার্টি বলা ছাড়া অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কিংস পার্টির প্রতিশ্রুত স্থিতিশীলতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কারণ এ ধরনের স্থিতিশীলতা বিনিয়োগের জন্য একটি পূর্বাভাসযোগ্য ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান গুরুত্ববহ। কারণ এ অঞ্চল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, নিরাপত্তা এবং সাহায্যের ক্ষেত্রে ‘স্ট্র্যাটেজিক হাব’ হিসেবে কাজ করে। ফলে দেশের শাসন কার্যক্রমে স্থিতিশীলতার স্বার্থে এবং এই আন্তর্জাতিক অবস্থানের মর্যাদা বজায় রাখতে রাজনৈতিক অভিমুখগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারী ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রভাব অনুভব করে এবং তাদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি সাহায্যপুষ্ট কিংস পার্টির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, যা শাসন কার্যক্রমে স্থিতিশীলতার অঙ্গীকার করে এবং বিশৃঙ্খলা ও অন্যান্য সমস্যা মোকাবিলায় বিদেশি স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়।
দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে অর্থনৈতিক অস্থিরতার সম্ভাবনা বিনিয়োগের পরিবেশকে প্রভাবিত করে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক মহল স্থিতিশীলতা ও নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে সক্ষম এমন কেন্দ্রীভূত শাসন মডেলের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়। কিংস পার্টি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি প্রদান করতে পারলে তা শুধু ব্যবসায়িক অভিজাতদের কাছ থেকেই নয়, বরং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছ থেকেও ব্যাপক সমর্থন লাভ করতে পারে। এই শ্রেণিগুলো সাধারণত অর্থনৈতিক অস্থিরতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে পারে, এমন স্থিতিশীল সরকারের দিকে ঝোঁকে।

সাংস্কৃতিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত কর্তৃপক্ষের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে, যা তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক আচরণে প্রভাব ফেলে। এ ধরনের প্রবণতা তাদের ক্ষমতাসীন শ্রেণির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের ফলে গড়ে ওঠে, যারা জাতীয় শক্তি এবং সংকট মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। ফলে যে কোনো দল যদি স্থিতিশীল শাসন এবং সংকট মোকাবিলায় নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা দেখাতে পারে, তার প্রতি জনসাধারণের সমর্থন অর্জন সহজ হয়। কিংস পার্টি এ ধরনের একটি দল হিসেবে উঠে আসতে পারে, যা তাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আশাবাদের প্রতিফলন ঘটায়।
শেষ পর্যন্ত যদিও বিকেন্দ্রীকৃত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের ধারণা অনেকের মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়, মাটির ওপরের বাস্তবতা দেশকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে পারে। কিংস পার্টির সম্ভাব্য উত্থানের পেছনের ধারণাগত ও বাস্তবিক কারণগুলো স্বীকার করা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য আরও নির্ভুল বোঝাপড়া ও যুক্তিসংগত আচরণের কৌশল প্রদান করে। এই বোঝাপড়া বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গঠনে জড়িত সব পক্ষের জন্য অপরিহার্য, যাতে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাগুলো জটিল ও বৈচিত্র্যময় জাতি শাসনের বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

ড.

কাজী এ এস এম নুরুল হুদা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক 
huda@du.ac.bd

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণঅভ য ত থ ন পর স থ ত ত র ব স তবত র জন ত ক র জন য পর ব শ গঠন র ন করত সরক র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি মুছে দিল দুর্বৃত্তরা

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) সংলগ্ন ছাত্র আন্দোলন চত্বরে বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন ‘পাটাতন’ অঙ্কিত গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি সংবলিত গ্রাফিতি রাতের কোনো এক সময় মুছে দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাটি জানাজানি হয়। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বুধবার রাতেও গ্রাফিতিগুলো রঙিন ছিল। রাতের কোনো এক সময় গ্রাফিতির ওপর কালো রঙের স্প্রে দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে।

পাটাতনের সাধারণ সম্পাদক সায়েম মোহাইমিন জানান, গণহত্যার ইতিহাসকে যদি ভুলে যাওয়া হয়, তাহলে গণহত্যা বারবার হবে। তাই পাটাতন থেকে জুলাইয়ের শহীদদের স্মৃতিকে গ্রাফিতি আকারে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন তারা। বিশেষ করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন চত্বর থেকেই এ আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়েছিল, বাংলা ব্লকেড এখান থেকেই করা হয়। এখানে এমন ঘৃণ্য কাজ করা কেবল গণহত্যার দোসরদের দ্বারাই সম্ভব। এ ধরনের কাজের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। 
প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন তিনি। সেই সঙ্গে জুলাইয়ের স্মৃতিতে ক্যাম্পাসে একটি ‘স্মৃতি মিনার’ তৈরি করতে অনুরোধ জানান তিনি।

এ বিষয়ে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক হান্নান রহিম বলেন, ‘গ্রাফিতি মুছে ফেলার মাধ্যমে স্বৈরাচারের দোসররা জুলাইকে মুছতে চায়, ছাত্র আন্দোলন চত্বরকে মুছতে চায়, তারা জানে না– যা কিছু রক্ত দিয়া লেখা হয়, তা মুছা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, পাশাপাশি জুলাইকে বাঁচিয়ে রাখতে স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে বিশ্বাস রাখতে চাই।’

কুবি ছাত্রদলের সদস্য সচিব মোস্তাফিজুর রহমান শুভর ভাষ্য, গণআন্দোলনে দল-মত নির্বিশেষে যৌক্তিক দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তারা। এ আন্দোলনে অনেকে শহীদ হয়েছেন। তাদের স্মৃতিতে গ্রাফিতি অঙ্কনের জন্য ‘পাটাতন’ সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। ছাত্রদলও এমন কিছু করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র করে যারা এগুলো মুছে দিতে চাইছে, হয়তো তারা ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগ কিংবা প্রশাসনে থাকা স্বৈরাচারের দোসর। এতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, স্বৈরাচার এখনও বিদ্যমান।

কুবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি ইউসুফ ইসলাহী বলেন, ‘পাটাতন যে গ্রাফিতি অঙ্কন করেছিল, সেগুলো যারাই মুছে দিয়েছে, তারা ফ্যাসিস্টের পদলেহী বলেই আমরা মনে করি। আমি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাই।’

সহকারী প্রক্টর ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুতাসিম বিল্লাহ জানান, প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ ও দাবি এলে হয়তো প্রশাসন আমলে নেবে। গণআন্দোলনে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাই এর স্মৃতি সংরক্ষণে দাবি-দাওয়া আমলে নিয়ে প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত।

প্রক্টর অধ্যাপক ড. আব্দুল হাকিমের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি এখনও লিখিত অভিযোগ পাইনি। আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। আর জুলাই স্মৃতি মিনার করার ব্যাপারে রেজিস্ট্রারের কাছে লিখিত আবেদন করলে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করব।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তরুণরা নতুন রাজনীতির কথা বলে পুরোনো পথেই হাঁটছে: নুরুল হক নুর
  • তরুণরা নতুন রাজনীতির কথা বলে পুরোনো পথেই হাঁটছে: নুরুল হক নূর
  • অস্ত্র ফেরত চান আ.লীগ নেতারা
  • গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি মুছে দিল দুর্বৃত্তরা
  • আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাবিতে মানববন্ধন
  • গণঅভ্যুত্থান কখনোই আইন মেনে চলে না, বরং আইন ভাঙার মাধ্যমেই শুরু হয়: ফরহাদ মজহার
  • ‘সংবিধান’ নামে শেখ হাসিনার ভূত এখনো রয়ে গেছে: ফরহাদ মজহার