খোঁড়াখুঁড়ি ও জলাবদ্ধতায় ভোগান্তি, সনদ পেতে ঘুষ-হয়রানির অভিযোগ
Published: 11th, March 2025 GMT
কোথাও পানি নিষ্কাশনের নালা ও রাস্তার উন্নয়নকাজের জন্য দীর্ঘদিন ধরে সড়ক খুঁড়ে-কেটে রাখা হয়েছে। হেঁটে চলাচলও করা যাচ্ছে না। কিছু এলাকায় পয়োনালার পানি আটকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও বাসাবাড়ির বর্জ্য নিয়ে মানুষকে জিম্মি করা হচ্ছে। কোনো কোনো এলাকায় হাঁটার রাস্তা (ওয়াকওয়ে), পার্ক-মাঠ কিছুই নেই। সড়কবাতিগুলো নষ্ট হয়ে আছে মাসের পর মাস। ওয়ার্ড কার্যালয়ে গেলে হয়রানি করা হচ্ছে। ঘুষ না দিলে সনদ পাওয়া যাচ্ছে না।
এমন সব অভিযোগ জানালেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সঙ্গে যুক্ত নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশান ২ নম্বরে ডিএনসিসির নগর ভবন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক গণশুনানিতে এসব ওয়ার্ডের বাসিন্দারা এমন অভিযোগ জানান। নাগরিকসেবা–সংক্রান্ত বিষয়ে এ গণশুনানির আয়োজন করে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ।
শুনানি শুরু হয় বেলা ১১টার কিছু পরেই। গণশুনানিতে ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ উপস্থিত হন একেবারে শেষে, বেলা একটা এক মিনিটে। এর প্রায় আধা ঘণ্টা আগে শুনানিতে যুক্ত হন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো.
ভাঙাচোরা রাস্তাঘাটের সমস্যার কথা তুলে ধরে ডিএনসিসির ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাদেক আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, ওই ওয়ার্ড এলাকায় তিনি ২৫ বছর ধরে বসবাস করছেন। গত ১৭ বছরে সেখানে রাস্তার কোনো উন্নয়নকাজ করতে দেখেননি।
সাদেক আহমেদ ভূঁইয়া আরও বলেন, আশকোনার মদিনা টাওয়ার থেকে দক্ষিণখান মূল রাস্তা পর্যন্ত অংশে সড়কটি সংস্কার করা হবে—এমনটা এক বছর আগে শুনেছেন। এই শুষ্ক মৌসুমেও ওই রাস্তায় পানি জমে আছে। প্রধান প্রকৌশলী এ সময় বলেন, সব জায়গায় একসঙ্গে কাজ ধরলে লোকজন বাসা থেকেই বের হতে পারবেন না।
ডিএনসিসির ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ বাদশা কয়েকটি সমস্যা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সাত মাস ধরে ওই এলাকায় সড়কবাতি নষ্ট। করপোরেশনকে জানালেও বাতি ঠিক করা হয়নি। নালার ময়লা-আবর্জনা তুলে নালার পাশেই রাখা হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই যা নালায় গিয়ে পড়বে। নুরেরচালা বোটঘাটের রাস্তা দেড় মাসের বেশি সময় কেটে ফেলে রাখা হয়েছে।
ঈদের পরে আমরা এ ধরনের বড় বড় প্রোগ্রামে যাব। ঈদের আগে খুব একটা ঝামেলা করতে চাচ্ছি না এখন। ঈদের পরে গ্র্যাজুয়ালি আমরা রিকশাগুলোকে মেইন রোড থেকে সরিয়ে দেব। এটা হচ্ছে আমাদের টার্গেট।ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিন, প্রধান প্রকৌশলী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন৫০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ওয়ার্ডের ৪ নম্বর সড়কে নবজাগরণী ক্লাব থেকে মুন্সি মার্কেট এলাকা পর্যন্ত রাস্তার কাজ অনেক দিন ধরে বন্ধ। এ নিয়ে তাঁরা করপোরেশনে গিয়েছেন। করপোরেশন তাঁদের ভোগান্তির মূল্যায়ন করেনি। এমন পরিস্থিতিতে বৃষ্টি হলেই সেখানে কোমরপানি জমার শঙ্কায় রয়েছেন বাসিন্দারা। প্রধান প্রকৌশলী তাঁদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে আবেদনের অনুরোধ জানান।
দীর্ঘ সময় নিয়ে চালানো উন্নয়নকাজে দুর্ভোগ, অপ্রতুল নাগরিক–সুবিধা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ওয়াসার পানির সংকট নিয়ে অভিযোগ দেন ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সৈয়দ আহমেদ। তিনি বলেন, তাঁদের এলাকায় দুই বছর আগে থেকে শুরু হওয়া রাস্তার কাজ শেষ হচ্ছে না। এতে বাসিন্দাদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তাঁদের এলাকায় বয়স্ক, নারী ও শিশুদের হাঁটাচলার কোনো সুযোগ নেই। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের পাশে আবদুল্লাহপুর খালের পাড়ে হাঁটার রাস্তা করার আবেদন করা হলেও তা হয়নি। বাসিন্দাদের জিম্মি করে ইচ্ছেমতো ময়লার বিল নেওয়া হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ময়লার বিল নগরবাসী জানেন না। এ জন্য মানুষের চোখে পড়ে, এমন বিভিন্ন স্থানে ঠিকাদারের নাম ও নির্দিষ্ট বিল সাইনবোর্ডে লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন তিনি।
ডিএনসিসির ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাত্তার চৌধুরী বলেন, কয়েক দিন আগে তাঁর এক স্কুলশিক্ষকের মৃত্যুসনদ নিতে গিয়ে সাত হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। জন্মনিবন্ধনের সরকারি ফি ৫০-১০০ টাকা হলেও, ২০০–৩০০ টাকা চেয়ে বসে থাকে। ময়লা সংগ্রহের কাজও কল্যাণ সমিতি থেকে জোর করে দখল করে নেওয়া হয়েছে। এ কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন তিনি। এই ব্যক্তির বক্তব্যের পরে করপোরেশনের কোনো কর্মকর্তা জবাব দেননি।
উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নগরের জন্য তিনি চারটি কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যেগুলোর ভিত্তিতে ন্যায্য নগর গড়ে তোলা হবে।সন্ধ্যার পর প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে নিমন্ত্রণ
গণশুনানির এক পর্যায়ে বক্তব্য দেন ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এক ঘণ্টা ২০ মিনিট এখানে আমি ছিলাম। মশার ব্যাপারটা কিন্তু তেমনভাবে উঠে আসে নাই। আপনাদের প্রয়োরিটিতে ছিল রাস্তাঘাট, কালভার্ট-ব্রিজ, হোল্ডিং ট্যাক্স। মশার ব্যাপারটা আসেনি। তার মানে এটা হচ্ছে লেস প্রায়োরিটি (কম অগ্রাধিকার)।’
এমন সময় শুনানিতে আসা উত্তরার এক বাসিন্দা ওই কর্মকর্তাকে থামিয়ে বলেন, ‘আপনি বলছেন, মশার বিষয়টি লেস প্রায়োরিটি দিয়ে আলোচনায় এসেছে। বিষয়টি সে রকম নয়। আপনাকে উত্তরা এলাকায় দাওয়াত দিয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পর যদি আমাদের এলাকা পরিদর্শন করতেন, আমরা অনেক খুশি হতাম। আমরা যে বাস্তব পরিস্থিতিতে বসবাস করছি, সেটা তুলে ধরতে পারতাম।’
ঈদের পর অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
গণশুনানিতে উপস্থিত থাকা অনেকেই তাঁদের বক্তব্যে অবৈধ অটোরিকশার চলাচল বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণের দাবি জানান। এ বিষয়ে সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘ডিএমপির সঙ্গে আমাদের একটি মিটিং হয়েছে। আমরা গ্র্যাজুয়ালি ফেস আউট করে দিচ্ছি, রিকশাগুলো যাতে মেইন রোডে আসতে না পারে। আমরা একটা ট্র্যাপ তৈরি করছি।’
প্রধান প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘ঈদের পরে আমরা এ ধরনের বড় বড় প্রোগ্রামে যাব। ঈদের আগে খুব একটা ঝামেলা করতে চাচ্ছি না এখন। ঈদের পরে গ্র্যাজুয়ালি আমরা রিকশাগুলোকে মেইন রোড থেকে সরিয়ে দেব। এটা হচ্ছে আমাদের টার্গেট। রিকশা ঈদের পরে মূল সড়কে আসবে না, এই প্ল্যানে আমরা ডিএমপি পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে আগাব।’
অগ্রাধিকারে ১৮টি ওয়ার্ডের উন্নয়ন
শুনানির একেবারে শেষ পর্যায়ে উপস্থিত হন ঢাকা উত্তর সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। প্রথমেই তিনি মশার সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। পরে সার্বিকভাবে তিনি বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নগরের জন্য তিনি চারটি কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যেগুলোর ভিত্তিতে ন্যায্য নগর গড়ে তোলা হবে। এর মধ্যে প্রথমে পরিবেশ ঠিক করা, দ্বিতীয়ত জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত, তৃতীয়ত আবাসনে ন্যায্যতা এবং চতুর্থত ১৮টি ওয়ার্ডের অবকাঠামো উন্নয়নে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা হবে। নগরবাসীকে সেবা প্রদানে জনবলসংকটের বিষয়টিও তুলে ধরেন তিনি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ড এনস স র কর মকর ত দ র এল ক ম হ ম মদ গণশ ন ন ক জ কর আম দ র এল ক য় সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
আলোর পথযাত্রী
বাংলাদেশের অর্থনীতির তিন দিকপাল—তিনজনই আমার শিক্ষক। প্রথম দুজনের একজন হচ্ছেন প্রয়াত অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন, অন্যজন প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুর রহমান এবং তৃতীয়জন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। শ্রেণিকক্ষে অধ্যাপক রেহমান সোবহান আমাকে কখনো পড়াননি বটে, কিন্তু আমার উন্নয়ন অর্থনীতির পাঠ যেমন তাঁর লেখা ও বলা থেকে, আমার জীবনের বহু শিক্ষাও তাঁর নৈতিকতা ও মূল্যবোধ থেকে পাওয়া। আজ ১২ মার্চ, আমার এই শিক্ষকের জন্মদিন। হৃদয়ের সমস্ত শ্রদ্ধার্ঘ্যটুকু নিয়ে নমিত চিত্তে বলি, ‘শুভ জন্মদিন স্যার।’
রেহমান সোবহানের কথা ও নাম প্রথম শুনি ষাটের দশকের শেষার্ধে। আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বাবা তাঁর কথা বলতেন, বলতেন আমার কলেজশিক্ষকেরাও, যাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের শিক্ষার্থী হিসেবে তাঁকে দেখেছেন এবং তাঁর সম্পর্কে জানতেন। তাঁরা সবাই বলতেন অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মেধা ও মনন সম্পর্কে, তাঁর বাগ্মিতা বিষয়ে, তাঁর লেখা ও কথার ধার বিষয়ে। সবকিছু শুনে তিনি আমার কাছে হয়ে উঠেছিলেন একজন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, মুগ্ধ করা একজন মানুষ।
১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার পর রেহমান সোবহানকে আমি প্রথম দেখতে পাই। প্রথম দেখাতেই তাঁর তিনটি জিনিস আমাকে আকৃষ্ট করে—তাঁর দৃপ্ত পদচারণ, তাঁর ইংরেজি বলা এবং তাঁর অন্তর্ভেদী চোখের দৃষ্টি। পরবর্তী সময়েও দেখেছি যে তাঁর কথার দার্ঢ্য, তাঁর যুক্তির ধার এবং চোখের তীক্ষ্ণতা মিলে এমন একটি আবহ তৈরি হয় যে তাঁর মুখোমুখি বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যায় না।
ছাত্র হিসেবেই জানলাম যে পাকিস্তানের দুই অর্থনীতি তত্ত্বের তিনি অন্যতম প্রবক্তা, ছয় দফার তিনি এক বিশিষ্ট কারিগর, পাকিস্তানের চতুর্থ পরিকল্পনা প্রণয়নে বাঙালি অর্থনীতিবিদেরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন, তিনি তাঁর সদস্য। আমরা অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কোনো ক্লাস পাইনি, কিন্তু তাতে কি! নানা সভা-সমিতিতে তাঁর বক্তব্য শুনে এবং হামিদা হোসেন ও তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ফোরাম পত্রিকায় তাঁর লেখা পড়ে আমার নানা শিক্ষার শুরু তাঁর কাছ থেকে—অর্থনীতির শিক্ষা, যুক্তির শিক্ষা, বক্তব্যের শিক্ষা। ফোরাম পত্রিকাটি তদানীন্তন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য তুলে ধরেছিল এবং আমাদের গণ-আন্দোলনে একটি বিরাট ভূমিকা রেখেছিল।
তারপর শুরু হলো আমাদের স্বাধিকারের আন্দোলন, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ। এর প্রতিটি পরতে পরতে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের কাজ ও অবদান সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হন। ১৯৭৫ সালে আমার এমএ পরীক্ষা শেষ হয়। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তখন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তিনি খুব চাইলেন, আমি সেই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিই। কিন্তু অধ্যাপক মুশাররফ হোসেন আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ধরে রাখলেন। ১৯৭৭ সালে আমি যখন উচ্চশিক্ষার্থে কানাডায় চলে যাই, তত দিনে অধ্যাপক রেহমান সোবহান অক্সফোর্ডে চলে গেছেন।
রেহমান সোবহানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে, যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। রেহমান সোবহান তখন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক। এ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গবেষণার সঙ্গে আমি যুক্ত হই। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নানা কর্মকাণ্ডেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়, সভা-সমিতিতে উভয়েই বক্তব্য রাখি। আশির দশকের শেষের দিকে এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘নাগরিক কমিটি’ গঠিত হলে আমি খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলাম রেহমান সোবহান, প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও প্রয়াত অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের সঙ্গে। তখন বাংলাদেশ অর্থনীতির স্থবিরতার ওপরে রেহমান সোবহান দ্য ডিকেড অব স্ট্যাগনেশন শিরোনামে একটি বই সম্পাদনা করেছিলেন। বইটির প্রথম প্রবন্ধটিই ছিল আমার লেখা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা প্রায়ই নানা জায়গায় আলোচনায় বসতাম। একবার অধ্যাপক মুশাররফ হোসেনের ফুলার রোডের বাড়িতে তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে গেল—রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী হবে? বুদ্ধিজীবীরা কি শুধু ‘রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক’ আর ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষকের’ ভূমিকাই নেবে? বিতর্কের একপর্যায়ে রেহমান সোবহান আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, যা এখনো আমার মনে আছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস বলেছিলেন, ‘ষাটের দশকে আমরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলাম। আশির দশকে তোমরা কেন অমনটা যুক্ত নও?’ মনে আছে, নানাজনের ওপরে দোষ চাপিয়ে আমি একধরনের টালবাহানা উত্তর দিয়েছিলাম। তিনি আমার সব কথা শুনলেন। তারপর শুধু বললেন, ‘শোনো, দেশের পরিবর্তন যদি করতে চাও, তাহলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। বাইরে থেকে শুধু বুদ্ধিজীবীর মতামত দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ এমন অমোঘ বাণী বড় একটা শুনিনি।
১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা হলেন রেহমান সোবহান। বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির নানা দিকের সমস্যা চিহ্নিতকরণ, তার বিশ্লেষণ এবং আগামী পথযাত্রার রূপরেখা দেওয়ার জন্য তিনি দেশের প্রায় আড়াই শ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ নিয়ে ২৯টি কর্মদল গঠন করেন। তাঁর ডাকে তাঁরা সবাই কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই এই বিশাল কাজ করে দিতে সম্মত হন। আমি নিজে সামষ্টিক অর্থনীতি এবং যমুনা সেতু কর্মদলের সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। প্রথম কর্মদলটির দলনেতা ছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, দ্বিতীয়টির জামিলুর রেজা চৌধুরী।
রেহমান সোবহানের স্বপ্ন ছিল, বাংলাদেশের নানা বিষয় ও নানা খাতের ওপর এমন একটি কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন হলে পরবর্তী সময়ে যে নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাঁরা এসব কর্মদলের প্রতিবেদন থেকে একটি দিকনির্দেশনা পাবেন। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো যে তারপরের কোনো নির্বাচিত সরকারই সেসব প্রতিবেদনের বাস্তবায়ন বিষয়ে কিছুই করলেন না। কিন্তু এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে এমন একটি সৃজনশীল, সৃষ্টিশীল, সময়োপযোগী ও প্রাসঙ্গিক কর্মযজ্ঞের পথিকৃৎ ছিলেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এই বিশাল অবদানের জন্য আমরা সর্বদা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে আমি জাতিসংঘে যোগ দিলে রেহমান সোবহানের সঙ্গে আমার কর্মযোগাযোগ বেড়ে যায়। তখন নানা সময়ে নানা বিষয়ে আমরা যৌথভাবে কাজ করেছি নানা কর্মসূচিতে। মনে আছে, একবার দিল্লিতে এমন এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন অধ্যাপক অমর্ত্য সেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, মন্টেক সিং আহলুওয়ালা, মুচকুন্দ দুবের মতো দিকপালেরা।
দেশজ রাজনীতির নানা বিষয়ে গল্পে মাততেন রেহমান সোবহান। আমি প্রবাসে থাকি বলে আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা তিনি জানতে চাইতেন। রাজনীতির নানা বিষয়ে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী তিনি জানাতেন আমাকে। ভাবতে অবাক লাগে, বহুক্ষেত্রে তাঁর কথাগুলো ঠিক প্রমাণিত হয়েছে।
কয়েক সপ্তাহ আগে ঢাকায় আমার দুটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন রেহমান সোবহান। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ দার্ঢ্যের সঙ্গে বলেছেন অর্থনীতিবিদ, বিশেষজ্ঞ ও সমাজচিন্তক হিসেবে আমাদের কী করণীয়, কোথায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি এবং কেন। রাখঢাক রাখেননি, যা শুনতে চেয়েছি তা বলেননি, যা আমাদের শোনা দরকার, তা-ই বলেছেন। ইদানীং নানা আলোচনা সভায় তাঁর কথা শুনে আমার মনে হয়েছে, তিনি যেন এক সন্ত—নির্মম সততার সঙ্গে ব্যবচ্ছেদ করছেন অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বর্তমান কাঠামোর; আমাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন, নির্দেশনা দিচ্ছেন আমাদের ভবিষ্যৎ পথযাত্রার।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান তাই এক আলোর দিশারি, যিনি আলো দেখান, পথ দেখান। তাঁকে আমাদের বড় প্রয়োজন। তাই বলি, ‘স্যার, আপনি সুস্থ থাকুন, শতায়ু হোন এবং আমাদের মাঝেই থাকুন। জন্মদিনের নিরন্তর শুভেচ্ছা।’