রাজধানীর উত্তরখান এলাকায় হাবীবুল্লাহ বাহার ডিগ্রি কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ভূঁইয়া হত্যাকাণ্ডের তদন্তে তাঁর বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়া নবদম্পতিকে আটক করেছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা এই হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বয়সে তরুণ ওই দম্পতি রোজা শুরুর এক দিন আগে সাইফুর রহমানের (৪৯) বাসায় উঠেছিলেন। পালিয়ে নতুন বিয়ে করার পর তাঁরা নীলফামারী থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় এসে টাকাপয়সা হারিয়ে ফেলেন। এই পরিস্থিতিতে তরুণী বাসায় কাজ করবেন এবং তরুণ তাঁর গাড়ি চালাবেন, এমন শর্তে দুজনকে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন সাইফুর রহমান। কিন্তু ১০ দিন না যেতেই গতকাল সোমবার গভীর রাতে খুন হন সাইফুর রহমান।

আজ উত্তরাখানে ওই বাসায় যাওয়ার পর কথা হয় কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে। তাঁরা জানান, সোমবার ভোররাতে রক্তাক্ত অবস্থায় সাইফুর রহমান বাসার টয়লেটের জানালা কাছে এসে ‘বাঁচাও’, ‘বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। তখন সাহ্‌রি শেষ করে কেউ কেউ নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন। চিৎকার শুনে তাঁরা এগিয়ে যান। পরে ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে সাইফুর রহমানকে উদ্ধার করে উত্তরার একটি হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।

মো.

নাঈম রহমান নামের এক প্রতিবেশী প্রথম আলোকে বলেন, সাহ্‌রি খেয়ে তখনো ঘুমাননি। হঠাৎ পাশের বাসা থেকে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার শুনতে পান। পরে কয়েকজন মিলে গিয়ে সাইফুর রহমানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।

আজ ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ফ্ল্যাটের টয়লেটের জানালার বাইরের দিকের দেয়ালে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে রয়েছে।

সাইফুর রহমান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাঁর ছোট ভাই মোহাম্মদ লুৎফর রহমান ভূঁইয়া বাদী হয়ে উত্তরখান থানায় গতকাল একটি মামলা করেছেন। তাতে তিনি লিখেছেন, উত্তরখান এলাকায় তাঁর ভাই সাইফুর রহমানের স্ত্রীর একটি আড়াই কাঠার প্লট রয়েছে। তিন মাস আগে সেই প্লটের পাশেই ওই ছয়তলা ভবনের চারতলায় ভাড়া বাসায় ওঠেন সাইফুর রহমান।

সাইফুর রহমানের স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছেন। তাঁরা রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার একটি বাসায় থাকেন বলে লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ওই নবদম্পতিকে বাসায় আনার পর তাঁর ভাই প্রতিবেশীদের কাছে তরুণীকে নিজের ‘ভাবি’ এবং তরুণকে ‘ভাতিজা’ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

ওই দম্পতি আজকে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার মহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারণ জানার চেষ্টা চলছে। পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।

যেভাবে নবদম্পতির সঙ্গে পরিচয় সাইফুরের

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাইফুর রহমানের বাসায় আশ্রয় নেওয়া তরুণীর বাড়ি নীলফামারী জেলায়। আর তরুণের বাড়ি ফরিদপুরে। মুঠোফোনে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্প্রতি তাঁরা পালিয়ে বিয়ে করেন। রোজা শুরুর আগে তাঁরা ট্রেনে করে নীলফামারী থেকে ঢাকার কমলাপুরে আসেন। কমলাপুরের ৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে তরুণীর সঙ্গে থাকা ব্যাগটি হারিয়ে যায়। চিৎকার শুনে সেখানে এগিয়ে যান সাইফুর রহমান।

তখন ওই তরুণী সাইফুর রহমানকে বলেন, ব্যাগের ভেতরে তাঁদের টাকাপয়সা ছিল। ঢাকায় তাঁদের থাকার জায়গা নেই। টাকাপয়সা চুরি হয়ে গেছে, এখন কী করবেন বলে কান্না শুরু করেন। এই নবদম্পতির ঢাকায় থাকার জায়গা নেই শুনে সাইফুর রহমান তাঁর ভাড়া বাসায় আশ্রয় দেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাইফুর রহমানের সঙ্গে সোমবার দিবাগত রাতে ঝগড়া হয় এই নবদম্পতির। কথা–কাটাকাটির একপর্যায়ে ছেলেটি বাসায় থাকা ছুরি দিয়ে সাইফুর রহমানকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেন। পরে ফ্ল্যাটের বাইরে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যান তাঁরা।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, সাইফুর রহমানের শরীরের বিভিন্ন অংশে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, একসঙ্গে থাকতে গিয়ে সাইফুর রহমানের প্রতি ক্ষোভ জন্মায় এই নবদম্পতির। সেই ক্ষোভ থেকে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তবে কী কারণে সাইফুর রহমানের প্রতি তাঁদের ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটা স্পষ্ট করে বলেননি তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: তদন ত

এছাড়াও পড়ুন:

হাবীবুল্লাহর উপাধ্যক্ষকে হত্যা করে আশ্রয় দেওয়া নবদম্পতি: পুলিশ

ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে অপরিচিত এক দম্পতিকে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজের ভারপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ভুঁইয়া। তারা হলেন– রংপুরের তরুণ মো. নাসিম (২০) ও তার স্ত্রী ফরিদপুরের রূপা (২২)। তাদের মধ্যে নাসিমকে গাড়িচালক ও রূপাকে বাসা পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করার কাজ দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। এরপর নানারকম ভয় দেখিয়ে তাদের বাসায় আটকে রাখা হয়। একপর্যায়ে ঘটনার দিন রূপাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালান সাইফুর। তখন স্বামী–স্ত্রী মিলে তাকে কুপিয়ে পালিয়ে যায়।

রাজধানীর উত্তরখানে শিক্ষক হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার দম্পতি পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এমনটাই দাবি করেছেন। এর আগে মঙ্গলবার ফরিদপুর সদর রেলস্টেশন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। রোববার রাত ২টা থেকে ভোর ৪টার মধ্যে ওই হত্যার ঘটনা ঘটে।

উত্তরখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর রহমান বলেন, এ ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই লুৎফুর রহমান ভুঁইয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে উত্তরখান থানায় মামলা করেছেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার দম্পতিকে বুধবার আদালতে হাজির করা হবে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘটনার তিন–চারদিন আগে রেলস্টেশন থেকে ওই দম্পতিকে এনে নিজের বাসায় আশ্রয় দেন সাইফুর রহমান। তারা নীলফামারী থেকে ট্রেনে ভোরে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনের আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে নামেন। এরপর নাসিম স্ত্রীকে স্টেশনে রেখে নাস্তা কিনতে গেলে ঘুমিয়ে পড়েন রূপা। ঘুম থেকে উঠে দেখেন, সঙ্গের জিনিসপত্র কেউ নিয়ে গেছে। তখন তিনি কান্নাকাটি শুরু করেন। ওই সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন সাইফুর। তিনি কান্নার কারণ জানতে চান। সব শোনার পর তিনি দুজনকে কাজ দেওয়ার কথা বলে বাসায় নিয়ে আসেন। সেখানে কার্যত তাদের বন্দি করে রাখা হয়। তিনি বাসার বাইরে গেলে বাসার দরজায় তালা ঝুলিয়ে যেতেন। এদিকে বাসায় শিক্ষকের পরিবারকে না পেয়ে রূপা এ নিয়ে প্রশ্ন করেন। তখন সাইফুর জানান, তার পরিবারের সদস্যরা বাইরে আছেন। তবে কয়েকদিনেও তারা বাসায় না আসায় স্বামী–স্ত্রীর সন্দেহ হয়। মাঝেমধ্যে নাসিমের সামনেই তার স্ত্রীর শরীরের বিভিন্ন অংশ বাজেভাবে হাত দিতেন সাইফুর। এ নিয়ে ক্ষোভের মধ্যেই ঘটনার দিন ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটে। গ্রেপ্তার দম্পতি সাইফুরকে কুপিয়ে ফেলে যাওয়ার সময় তার মোবাইল ফোন ও বাসার সব চাবি সঙ্গে নিয়ে যায়।

পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার দম্পতি প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে বিয়ে করে ৭ মার্চ বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় তাদের কোনো আশ্রয় না থাকায় কমলাপুর স্টেশনে বসে পরবর্তী গন্তব্য ঠিক করছিলেন। সেখানেই তাদের সঙ্গে পরিচয় হয় নিহত শিক্ষকের। গ্রেপ্তারের পর তারা জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, বাসায় দুটি রুম থাকার পরও সাইফুর নিজের বিছানাতেই স্বামী–স্ত্রীকে রাখতেন।

সোমবার ভোর রাতে উত্তরখান এলাকার পুরান পাড়ার একটি ছয়তলা বাসার চতুর্থ তলার ফ্ল্যাট থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় সাইফুরকে। তাকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে বাথরুমে আটকে রেখে পালিয়ে যায় দম্পতি। পরে বাথরুমের দরজা ভেঙে বের হয়ে চিৎকার করলে প্রতিবেশীরা উত্তরার একটি হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মঙ্গলবার ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, সাইফুর রহমান রাজধানীর শান্তিনগর পীর সাহেবেরে গলিতে একটি বাসায় স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকতেন। উত্তরখানের ভাড়া বাসাটিতেও মাঝেমধ্যে থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর থানার বাসুদেব গ্রামে। তার বাবা মৃত খলিলুর রহমান ভুঁইয়া।

নিহত শিক্ষকের স্ত্রী সাদিয়া রেহমান জানান, তার স্বামী বেশ কয়েক মাস ধরে আলাদা থাকেন। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে বাসায় আসতেন। আবার চলে যেতেন। তবে তার সঙ্গে কথা বলতেন না। কোথায় থাকেন জানতে চাইলে বলতেন- বন্ধুর বাসায় থাকেন। কোন বন্ধু তাও বলতেন না। পরে সোমবার বিকেলে থানার ওসি কল করে হত্যার বিষয়টি জানান। মঙ্গলবার তার লাশ গ্রহণ করে গ্রামের বাড়িতে দাফনের জন্য নেওয়া হয়েছে।

এজাহারে মামলার বাদী উল্লেখ করেন, সাইফুর রহমানের ভাড়া বাসার পাশে তার স্ত্রীর পৈত্রিক সম্পত্তি রয়েছে। সেখানে বাড়িঘর নির্মাণ করার জন্য ৩-৪ মাস ধরে ভাড়াটে হিসেবে বসবাস করে আসছিলেন। সোমবার বিকেলে তার সহকর্মী কবির ফোন করে বিষয়টি জানান।

ডিএমপির উত্তরা বিভাগের সহকারী কমিশনার নাসিম এ-গুলশান সমকালকে বলেন, শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্বামী-স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আর কেউ জড়িত কিনা, তা জানার চেষ্টা চলছে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হাবীবুল্লাহর উপাধ্যক্ষকে হত্যা করে আশ্রয় দেওয়া নবদম্পতি: পুলিশ
  • হাবীবুল্লাহর শিক্ষককে হত্যা করে আশ্রয় দেওয়া নবদম্পতি: পুলিশ