নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে চারটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা। এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে তারা।

আজ মঙ্গলবার এক যৌথ সংবাদ বিবৃতিতে এ দাবি জানায় অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।

নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা রোধে সরকারের নেওয়া ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ধর্ষণের ঘটনায় ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত এবং ৯০ দিনের মধ্যে বিচার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি প্রশংসনীয়। আমরা এই নীতির জরুরি কার্যকারিতা ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন আশা করি। ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানাচ্ছি।’

মানবাধিকার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধর্ষণ আইনের সংস্কার এবং ভুক্তভোগী ব্যক্তি ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করার কথাও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। তারা মনে করে, এতে ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পথ সহজ হবে।

নারী–শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, সমাজকর্মী ও সচেতন নাগরিকদের প্রতিবাদের সঙ্গে একাত্মতা ও সংহতি প্রকাশ করা হয় বিবৃতিতে।

বিবৃতিতে বলা হয়, নারী, কিশোরী ও শিশুদের প্রতি যেকোনো ধরনের সহিংসতা বা হয়রানি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। তাই সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নারী ও মেয়েশিশুদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিতে সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হয়।

একটি বিস্তৃত শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করার দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, নারী ও শিশুদের জন্য নিরাপদ চলাচল, নাগরিক স্বাধীনতা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিতে আনতে হবে আইনি সংস্কারও।

বিবৃতিতে বলা হয়, সংস্থাগুলো বিশ্বাস করে, নারীর প্রতি সহিংসতা কঠোরভাবে দমন হলে, দেশে ন্যায্যতা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ঘটন য়

এছাড়াও পড়ুন:

সংসদীয় গণতন্ত্র নাকি ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ পুনঃপ্রবর্তন

সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে যেসব প্রস্তাব বা সুপারিশ করা হয়েছে তাতে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলের অপশাসনের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এসব সুপারিশের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদকেই একেবারে ‘গৌণ’ করে ফেলা হয়েছে। অথচ সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। শুধু বিগত সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহারকে দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরে সংবিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব কতটুকু যুক্তিসংগত, তা ভেবে দেখা দরকার।

সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে; এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, ব্রিটেনের অনুকরণে যেসব দেশ সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু করেছে, প্রায় প্রতিটি দেশেই এ প্রবণতা বিদ্যমান।

এমনকি খোদ ব্রিটেনেই প্রধানমন্ত্রীর অতিরিক্ত ক্ষমতা বৃদ্ধি নিয়ে ১৯৬০-৭০-এর দশকে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল এবং অনেকেই ব্রিটেনের সরকারকে মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকারের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার হিসেবে অভিহিত করেছেন।

ব্রিটেনের মতো অন্যান্য দেশে যেমন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস এবং তাকে অধিকতর জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতেও প্রধানমন্ত্রীকে অন্যদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয়। এ জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যেসব কমিটি গঠন করা হয়, তাতে সরকারের অন্যান্য বিভাগ ও বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব থাকে। লক্ষণীয়, কোনো ব্যক্তির সঙ্গে নয়, বরং সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য—এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

কমিশনের প্রতিবেদনে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে নির্বাহী কর্তৃত্বের ভাগাভাগি এবং প্রধানমন্ত্রীকে ‘কম গুরুত্ব’ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী যাতে কোনোভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারে, সে জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা সুপারিশ করা হয়েছে। এটা শুধু সংসদীয় রীতিনীতি-বহির্ভূতই নয়, অসাংবিধানিকও বটে। প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারপ্রধান হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাঁর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত করা হয়েছে; তাঁকে অন্যদের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

২.

প্রথমত, ওয়েস্টমিনস্টার সিস্টেমের আদলে গড়ে ওঠা কোনো সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগি দেখা যায় না। কমিশনের সুপারিশে রাষ্ট্রপতিকে যেসব ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে (৩.৩), তা সংসদীয় ব্যবস্থায় অকল্পনীয়। ইতিমধ্যে সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতির অধীনে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ভবিষ্যতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও বিভাগও এ ধরনের আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে। এর ফলে শুরুতেই সরকারব্যবস্থা সেমিপ্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেমে (আধা রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা) রূপ নেবে এবং পরে সরকারব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতার সুযোগে রাষ্ট্রপতির হাতে অধিক মাত্রায় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের সম্ভাবনা রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে সরকারব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতা অবশ্যম্ভাবী। এর প্রধান কারণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের মৌলিক পরিবর্তন। যেখানে শুধু অর্থ বিল পাস ছাড়া অন্য সব বিষয়ে, এমনকি সরকার গঠন এবং সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাসের ব্যাপারে দলীয় সংসদ সদস্যদের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এটা দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও ভাঙন সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। এ অবস্থায় সরকার গঠন ও সরকার পতনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি অধিকতর ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারবেন। এ সুপারিশের ফলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা নির্ধারণের বিষয়টি পুরোপুরি ‘ব্যাকবেঞ্চার’দের (দলীয় প্রস্তাবের বিরোধিতাকারী সংসদ সদস্য) হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এটা স্থিতিশীল সরকার গঠনের পরিপন্থী। এর ফলে ‘হর্স ট্রেডিং’-এর মাধ্যমে যে কারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে।

তৃতীয়ত, কমিশনের সুপারিশের আইনসভা অংশে প্রস্তাব করা হয়েছে, সব সংসদীয় কমিটির সভাপতি বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত হবে। এটা যেকোনো দেশের সংসদীয় রীতিনীতির বিরোধী। প্রধানমন্ত্রী বা সরকারকে জবাবদিহির নামে ‘অপদস্থ’ করতে চাইলে এর থেকে সহজ পন্থা আর কী হতে পারে! সংসদীয় কমিটিগুলো আইন পর্যালোচনা ছাড়াও বিভিন্ন তদারকি কাজ করে থাকে। এর ফলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সংসদের স্থায়ী কমিটিকে তেমন কোনো বেগ পেতে হবে না।

৩.

জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলে (এনসিসি) বিরোধীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যপদ প্রদানের শর্ত (৯ জনের মধ্যে ৫ জন) এবং রাষ্ট্রপতিকে এ কাউন্সিলের সভাপতি করার সুপারিশের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বা সরকারকে অধিকতর ক্ষমতাহীন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ কাউন্সিল সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে—সেই আকাঙ্ক্ষা ইতিবাচক বলেই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু যেভাবে এর গঠনপ্রক্রিয়া প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তে অধিকতর ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করবে। এতে বিরোধীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকারের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থাকবে।

আমাদের এ অঞ্চলে যেসব দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান যেমন, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে রাষ্ট্রপতি কাউন্সিলের সদস্য নয়। নেপালে প্রধানমন্ত্রী এবং শ্রীলঙ্কায় স্পিকার কাউন্সিলের সভাপতি হন। কিন্তু কমিশনের সুপারিশে রাষ্ট্রপতিকে সভাপতি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এটা প্রধানমন্ত্রীকে সব দিক থেকে ‘অকার্যকর’ করে রাখার একটা প্রচেষ্টা; প্রধানমন্ত্রী কাউন্সিলের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসম্মত হলেও তাকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে এবং এর দায় তাঁর ওপরই বর্তাবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধানমন্ত্রীর পদকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেনি, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এটা সংসদীয় সরকারব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সরকারকে চাপে রাখার জন্য বিরোধীদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং অভূতপূর্ব সুযোগ দেওয়ার ফলে সরকারের স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যেতে পারে।

সরকার যত বেশি অস্থিতিশীল হবে, রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তত বাড়বে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর বিকল্প হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে, কমিশনের সুপারিশ থেকে তেমনটাই প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু স্থিতিশীল সরকার না থাকলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই সংকটাপন্ন হতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর পদকে এত খাটো করার প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সাংবিধানিক কাউন্সিলের আকার ছোট করা উচিত, যেখানে সরকার, বিরোধী দল ও বিচার বিভাগের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি করে এবং প্রধান বিচারপতি, জাতীয় সংসদের স্পিকার, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং সিনেটের (উচ্চকক্ষ থাকলে) চেয়ারম্যানকে সদস্য করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করা হলে তা অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল এবং কার্যকর হবে বলে ধারণা করা যায়।৪.

একটা বিষয়ে সবাই একমত, বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শুধু প্রচুর ক্ষমতার অধিকারীই নয়, নিয়মবহির্ভূতভাবে অনেক কাজের জন্য তাঁকে দায়বদ্ধ করা অসম্ভব। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁর চেয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কোন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কি না, তা বলা দুষ্কর।

তবে কমিশন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসের যে প্রস্তাব করেছে, তা সরকার গঠন, সরকারের মেয়াদকাল নির্ধারণ এবং সরকারি কার্যাবলি পরিচালনা—এসব বিষয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করার প্রস্তাব করতে গিয়ে পুরো সরকারব্যবস্থাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু তাঁকে ‘ক্ষমতাশূন্য’ করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।

কিছু সুপারিশ, যেমন প্রধানমন্ত্রীর পরপর দুবারের বেশি ক্ষমতায় না থাকার বিষয়টি—মোটামুটি সবাই সমর্থন করবে বলে ধারণা করা যায়। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি না হওয়ার সুপারিশও মোটামুটি গ্রহণযোগ্য। এতে সরকার পরিচালনায় অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সংসদীয় দলের নেতৃত্ব থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। ভারত, নেপালসহ বেশির ভাগ সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশগুলোয় প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে কাজ করেন। শুধু ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কানাডা কিছুটা ব্যতিক্রম।

প্রধানমন্ত্রীকে সংসদীয় দলের নেতা থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব বাস্তবসম্মত নয়। এর প্রধান কারণ, প্রধানমন্ত্রী একমাত্র ব্যক্তি, যিনি সরকারি বিষয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি অবহিত থাকেন। সংসদে কখন কোন আইন উত্থাপন করতে হবে এবং আইন ছাড়াও অন্যান্য বিষয় সংসদে তুলে ধরতে হবে, এসব বিষয়ে অন্য যেকোনো সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীর তুলনায় প্রধানমন্ত্রী অধিকতর অবহিত থাকেন।

সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা ভাগাভাগির বিষয়ে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো সংসদীয় সরকারব্যবস্থার চেতনাবিরোধী এবং অসামাঞ্জস্যপূর্ণ। অন্য কোনো দেশের ওয়েস্টমিনস্টার সরকারপদ্ধতিতে এ ধরনের ক্ষমতার ভাগাভাগি দেখা যায় না। ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রপতির চেয়েও অনেক কম।

এ রকম অবস্থায় বর্তমান সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রেখে, বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা সাংবিধানিক কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত করা প্রয়োজন, যা সংস্কার কমিটি সঠিকভাবেই সুপারিশ করেছে। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে যে কমিশনের প্রস্তাবিত কাউন্সিলের গঠনপ্রণালি অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ।

ভারতে এ ধরনের কাউন্সিল না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত বিভিন্ন কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীই সভাপতিত্ব করেন। কিন্তু আমাদের সংস্কার কমিটি রাষ্ট্রপতিকে কাউন্সিলের সভাপতি করার সুপারিশ করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতেও প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতিত্ব করার সুযোগও দেওয়া হয়নি। এখানে প্রধান বিচারপতিকে এ দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর পদকে এত খাটো করার প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সাংবিধানিক কাউন্সিলের আকার ছোট করা উচিত, যেখানে সরকার, বিরোধী দল ও বিচার বিভাগের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে সভাপতি করে এবং প্রধান বিচারপতি, জাতীয় সংসদের স্পিকার, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা এবং সিনেটের (উচ্চকক্ষ থাকলে) চেয়ারম্যানকে সদস্য করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন করা হলে তা অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল এবং কার্যকর হবে বলে ধারণা করা যায়।

বিরোধী দল থেকে নিম্নকক্ষের সব কমিটির সভাপতি নির্বাচনের যে সুপারিশ কমিশন করেছে, কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই এ ধরনের বিধান নেই। সাধারণত বিভিন্ন দলের সংখ্যানুপাতে আইনসভার বিভিন্ন কমিটির সদস্য ও সভাপতি নির্বাচন করা হয়। যে দলের সদস্যসংখ্যা বেশি, সেই দলকে অধিকতরসংখ্যক সদস্য ও সভাপতি পদ দেওয়া হয়। এটাই রীতি, যা সংবিধানে নয়, বেশির ভাগ দেশেই সংসদের কার্যপ্রণালিবিধিতে উল্লেখ থাকে।

সংবিধান সংস্কার কমিশন নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভার মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ে যেসব সুপারিশ করেছে, তা ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতিতে পরিচালিত কোনো দেশেই দেখা যায় না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীরাও তেমনটাই করবেন—এ আশঙ্কা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে; প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

কিন্তু কমিশন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার কথা বলে যে সুপারিশ করেছে, তা সংসদীয় সরকারব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে শুধু যে সরকার অস্থিতিশীল হবে, তা-ই নয়, এর ফলে ‘বিভক্ত’ সরকারের উদ্ভবেরও আশঙ্কা থাকে।

৫.

সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু তাঁকে বাদ দিয়ে অথবা ‘অবিশ্বাস করে’ কমিশনের সুপারিশে রাষ্ট্রপতির ভূমিকাকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে; যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন মাত্র ৫৮১ জনের ভোটে। সংবিধান সংস্কার কমিশন আইনসভার ৫০৫ জন সদস্যের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের মাত্র ৭৬ জন প্রতিনিধিকে (৬৪ জন জেলা পরিষদ থেকে এবং ১২ জন সিটি করপোরেশন থেকে) রাষ্ট্রপতির নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। এত অল্পসংখ্যক নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে কয়েক কোটি ভোটারের সমর্থনে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান কতটা যৌক্তিক?

 এ পদ্ধতি ১৯৬০-এর দশকের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের পথে একধরনের পদক্ষেপ বলে প্রতীয়মান হতে পারে। ১৯৬০-এর দশকে তৎকালীন পাকিস্তানে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা রাষ্ট্রপতি, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করতেন। এদের বিডি মেম্বার (বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্রী) হিসেবে অভিহিত করা হতো। নির্বাচনের এ পদ্ধতি ছিল তৎকালীন সেনাশাসক আইয়ুব খানের নিজস্ব উদ্ভাবন। এ পদ্ধতি অনুসারে, প্রায় ৮০ হাজার ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ রাষ্ট্রপতির নির্বাচকমণ্ডলী হিসেবে কাজ করেছেন। আইয়ুব খানের সরকার তাদের অতি সহজেই নিজের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য বাধ্য করেছিলেন।

আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলে সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি অনেক প্রশ্ন ও জটিলতা সৃষ্টি করবে। কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করা, অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো এবং অল্প কিছু ব্যক্তির সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুযোগ তৈরি করা হলে, সেটা ভবিষ্যতে দেশকে রাষ্ট্রপতি শাসিত ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ দিকে নিয়ে যেতে পারে, যৌক্তিক কারণেই এ আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

ড. নিজাম উদ্দিন আহমদ সাবেক অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ