সন্ধ্যা নামার আগ থেকেই জমতে থাকে ভিড়। সারি বেঁধে অপেক্ষায় নানা বয়সী মানুষ। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন। এক কাতারে সবাই মেঝেতে বসেছেন। স্বেচ্ছাসেবকেরা প্রথমে পানি বিতরণ করেন, পরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ইফতারি বিতরণে। মসজিদের ভেতরেও বসতে শুরু করেন রোজাদারেরা। সবার অপেক্ষা একটাই, দরগাহে থাকা ইফতারের বিশেষ ‘সাইরেন’।

রমজানে প্রতিদিনই সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.

)–এর দরগাহে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। এখানে রমজানের ইফতার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। শত শত বছর ধরে এখানে ইফতারে এমন আয়োজন হয়। সাহ্‌রিতেও এমন দৃশ্য দেখা যায়। এখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। ধনী-গরিব, মুসাফির-স্থানীয়, নারী-পুরুষ—সবাই এক কাতারে বসে ইফতার করেন। খাবারও সবার জন্য এক। খেজুর, শরবত, ছোলা, পেঁয়াজু—সবকিছুই থাকে। তবে ইফতারের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে আখনি কিংবা ভুনা খিচুড়ি। রমজানে প্রতিদিনই ৩০০ থেকে ৬০০ মানুষ এখানে ইফতার করেন। বৃহস্পতি ও শুক্রবার এ সংখ্যা এর দ্বিগুণ হয়ে থাকে।

শুধু দরগাহ চত্বরেই নয়, পাশের মসজিদেও ইফতার করেন বহু মানুষ। কেউ নিজের ইফতারি নিয়ে আসেন, কেউ আবার মসজিদে আগত রোজাদারদের জন্য ইফতারি পাঠান। এখানে বসার ক্ষেত্রে কোনো শ্রেণিভেদ নেই। ভিক্ষুক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী থেকে রাজনীতিবিদ—সবাই একসঙ্গে বসে ইফতার করেন। নিজের খাবারটুকু অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার যে শিক্ষা, সেটিই যেন এখানে বাস্তব রূপ পায়। ইফতার ও সাহ্‌রির খাবারের রান্নাবান্নার এ আয়োজন দরগাহের লঙ্গরখানায় সকাল থেকেই শুরু হয়।

সোমবার শাহজালাল (রহ.)–এর দরগাহে গিয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন মুসাফির, স্বেচ্ছাসেবক, স্থানীয় বাসিন্দা, দরগাহের বাবুর্চি ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।

ঢাকা থেকে সিলেটে ভ্রমণে এসেছিলেন ব্যবসায়ী সায়মুম জাহিদ। দরগাহে ইফতার করতে যান তিনি। এমন আয়োজনে অভিভূত সায়মুম জাহিদ বলেন, ‘এই ইফতার যেন বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। কারণ, এখানে যাঁরা মেঝেতে বসেছেন, তাঁদের কারও পদ-পদবির কোনো পরিচয় নেই। সবাই রোজাদার। এটি আমাদের সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা দেয়।’

ইফতার ও সাহ্‌রিতে ২৭ বছর ধরে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন ইসহাক নূর। দরগাহে কাজ করতে তাঁর ভালো লাগে। কথা হলে দরগাহের লঙ্গরখানার প্রধান বাবুর্চি সৌরভ সোহেল বলেন, তাঁর দাদা প্রথমে এ পেশায় ছিলেন। পরে তাঁর বাবাও এখানে রান্নার কাজ করতেন। এখন তিনি এ কাজ করছেন। তিনি বলেন, ইফতার-সাহ্‌রির খাবারে প্রায় প্রতিদিনই আখনি কিংবা খিচুড়ি থাকে। তবে মাঝেমধ্যে পোলাও, বিরিয়ানির সঙ্গে গরু কিংবা খাসির মাংস, ডিম, কোর্মা ইত্যাদি রান্না করা হয়। কেউ কেউ আবার ইফতারি নিয়ে আসেন। তবে প্রতিদিনই এখানে রান্না হয়।

দরগাহের খাদেম সামুন মাহমুদ খান বলেন, হজরত শাহজালাল (রহ.) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে একত্রে বসে ইফতার করতেন। তাঁর ওফাতের সময় ৭০৬ বছর হয়েছে। ওফাতের পর তাঁর অনুসারীরাও এ নিয়ম চালিয়ে যান। সেই ধারাবাহিকতায় আজও এখানে চলে ইফতারের আয়োজন। প্রতিদিন শুধু সিলেট নয়, দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে ইফতার করতে আসেন।

দরগাহে ইফতার করাকে অনেকে ‘ঐতিহ্যের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার মিশেল’ বলে থাকেন। শাহজালাল (রহ.)–এর দরগাহে আসা ভক্তদের কয়েকজন বলেন, প্রতিবছর অন্তত একবার হলেও তাঁরা দরগাহে ইফতার করতে আসেন। এখানে ইফতার করা শুধু খাবার খাওয়া নয়, বরং এক অনন্য অনুভূতি, যা মনে ভ্রাতৃত্ববোধ ও প্রশান্তি এনে দেয়।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইফত র করত শ হজ ল ল দরগ হ র র দরগ হ

এছাড়াও পড়ুন:

যে কারণে দোয়া ইউনুস পড়া হয়

হজরত ইউনুস (আ.) ছিলেন একজন নবী। সুরা ইউনুস নামে পবিত্র কোরআনে স্বতন্ত্র একটি সুরা আছে। এই সুরায় তওহিদের প্রমাণ ও অংশীবাদের প্রতিবাদ রয়েছে। সুরাটিতে অবিশ্বাসীদের সম্বোধন করে তওহিদ, ওহি, নবুয়ত ও পরকালের সত্যতা ঘোষণা করা হয়েছে।

সুরা ইউনুস ছাড়াও কোরআনে আরও ছয়টি সুরায় হজরত ইউনুস (আ.) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দুজন নবী মায়ের নামে পরিচিত হয়েছেন। একজন হজরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.), অন্যজন হজরত ইউনুস ইবনে মাত্তা (আ.)। মাত্তা হজরত ইউনুস (আ.)-এর মায়ের নাম। মায়ের নামেই তাঁকে ইউনুস ইবনে মাত্তা বলা হয়। কোরআনে তাঁকে তিনটি নামে উল্লেখ করা হয়েছে—ইউনুস, জুননুন ও সাহিবুল হুত। জুননুন ও সাহিবুল হুতের অর্থ মাছওয়ালা। মাছ–সংশ্লিষ্ট ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে তাঁকে এ নামে ডাকা হয়েছে।

হজরত ইউনুস (আ.)-কে বর্তমান ইরাকের মসুল নগরীর কাছাকাছি নিনাওয়া জনপদে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। সুরা সাফফাতের ১৪৭ আয়াতে এ নিয়ে আলোচনা আছে। তিনি মসুলবাসীকে আল্লাহর পথে ডাকলেন। আখিরাতের বিষয়ে সতর্ক করলেন। কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর কথা শোনেনি। নবী ইউনুস (আ.) তাদের ইমান নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেন।

আরও পড়ুন‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া’ কেন পড়ব২৪ মার্চ ২০২৪

তিন দিনের মধ্যে আল্লাহর আজাব তাদের ওপর নিপতিত হচ্ছে ঘোষণা দিয়ে তিনি নিজ এলাকা ছেড়ে গেলেন। কিন্তু এলাকা ছাড়ার ব্যাপারে তিনি আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করেননি। আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা না করে তাঁর নিজে নিজে বের হয়ে যাওয়াটা আল্লাহর পছন্দ হয়নি। এ ধরনের বিচ্যুতিতে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন।

হজরত ইউনুস (আ.) এলাকা ছাড়ার পর লোকজন ভয় পেয়ে গেল যে এবার নিশ্চিত আল্লাহর আজাব চলে আসবে। তারা লোকালয় ছেড়ে বনবাদাড়ের দিকে চলে গেল। গবাদিপশু ও শিশুদেরও সঙ্গে নিল। সেখানে সবাই আল্লাহর কাছে আশ্রয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করল। তাদের তওবার কারণে আল্লাহ তাদের ওপর থেকে আজাব সরিয়ে নেন।

এলাকা ছাড়ার পর হজরত ইউনুস (আ.) ভাবলেন, তার সম্প্রদায় হয়তো আল্লাহর আজাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি কল্পনাও করেননি যে তারা তওবা করে আল্লাহর প্রতি ইমান নিয়ে আসবে। তিনি যখন জানতে পারলেন, তারা সবাই ইমান নিয়ে এসেছে, একদিকে তিনি অবাক হলেন, অন্যদিকে ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, তিন দিনের মধ্যে আল্লাহর আজাব আসবে, কিন্তু সেই আজাব সরে গেছে। তারা তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে হত্যা করতে পারে। সে সময়ে মিথ্যা বলার শাস্তি ছিল হত্যা। এ আশঙ্কায় তিনি দেশে না ফিরে দূর দেশে যাওয়ার জন্য মানুষবোঝাই একটি নৌকায় চড়ে বসলেন। নৌকা মাঝনদীতে পৌঁছামাত্র প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো। প্রবল ঢেউয়ে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে মাঝি বললেন, মালিকের অবাধ্য হয়ে এই নৌকায় কেউ উঠেছে। এমন কেউ থেকে থাকলে তাকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। না হলে অন্য যাত্রীরা এই বিপদ থেকে রক্ষা পাবে না।

যাত্রীদের মধ্যে লটারি করা হলো। তিনবার লটারি করা হলে প্রতিবারই হজরত ইউনুস (আ.)-এর নাম এল। হজরত ইউনুস (আ.) তখন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একটি বিশালদেহী মাছ এসে তাঁকে গিলে ফেলল। মাছটির প্রতি আল্লাহর নির্দেশ ছিল, হজরত ইউনুস (আ.)-এর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

আরও পড়ুনযে কারণে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়া হয়২৫ মার্চ ২০২৪

মাছের পেটে গিয়ে হজরত ইউনুস (আ.) একটি দোয়া পড়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইলেন। ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সেটিই দোয়া ইউনুস নামে পরিচিত। তিনি বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭ ) অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র মহান, আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’

এই দোয়ার ফলে মাছের পেট থেকে আল্লাহ তাঁকে মুক্তি দেন। কোরআনে আছে, ‘সে যদি আল্লাহর মহিমা আবৃত্তি না করত, তাহলে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত তাকে মাছের পেটে থাকতে হতো।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ১৪৩-১৪৪)

কিছুদিন পর মাছটি হজরত ইউনুস (আ.)-কে নদীতীরে উগড়ে ফেলে দিল। আল্লাহ সেখানে তাঁর শারীরিক প্রশান্তির জন্য একটি লতাবিশিষ্ট গাছ উদ্‌গত করে দেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তারপর ইউনুসকে আমি তৃণহীন প্রান্তরে ফেলে দিলাম, তখন সে অসুস্থ ছিল। পরে তাকে ছায়া দেওয়ার জন্য আমি একটি লাউগাছ গজালাম।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ১৪৫-১৪৬)

আরও পড়ুনপাপ থেকে প্রত্যাবর্তন করার নাম তওবা২৬ মার্চ ২০২৪

‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭ )

দোয়া ইউনুসের অর্থ

অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র মহান, আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’

দোয়া ইউনুস এর ফজিলত

মাছের পেটে গিয়ে হজরত ইউনুস (আ.) একটি দোয়া পড়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইলেন। ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সেটিই দোয়া ইউনুস নামে পরিচিত। তিনি বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭ ) অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র মহান, আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’

এই দোয়ার ফলে মাছের পেট থেকে আল্লাহ তাঁকে মুক্তি দেন। কোরআনে আছে, ‘সে যদি আল্লাহর মহিমা আবৃত্তি না করত, তাহলে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত তাকে মাছের পেটে থাকতে হতো।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ১৪৩-১৪৪)

যেকোনো বিপদে পড়লে আল্লাহর সাহায্য ও আশ্রয় কামনা করতে হয়।

হজরত সাদ (রা.)-এর বরাতে একটি হাদিস পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুননুন ইউনুস (আ.) মাছের পেটে দোয়া করেছিলেন, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন। কোনো মুসলমান যখনই এই দোয়া পড়ে, আল্লাহ অবশ্যই তার দোয়া কবুল করে থাকেন। (তিরমিজি, হাদিস: ৩৫০৫)

আরও পড়ুনহাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল কখন পড়বেন২৬ মার্চ ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বুদ্ধিমানের ৮ গুণ
  • যে কারণে দোয়া ইউনুস পড়া হয়