আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট গভীর, তা সমাধানের জন্য ঐকমত্যভিত্তিক সংস্কারপ্রক্রিয়া জরুরি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আয়োজিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ এই ঐকমত্য গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তা বা কঠোর ‘প্রথমে সংস্কার, পরে নির্বাচন’ বা ‘আমার পথই একমাত্র পথ’ ধরনের অনমনীয় মনোভাব সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। এর পরিবর্তে দরকার ‘ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচির একটি নকশা’। 

সমঝোতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটি মৌলনীতি অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমে, রাজনৈতিক নেতারা জরুরি সংস্কার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক করে সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচির ইস্যুগুলো নির্ধারণ করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, সর্বসম্মতভাবে গৃহীত এজেন্ডাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ইস্যুভিত্তিক প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন। সব বিষয়ে ঐকমত্য হবে না। আলাপ-আলোচনা চালিয়ে সর্বসম্মত ন্যূনতম ঐকমত্য খুঁজে বের করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা যায়। এর দুটি ধাপ থাকতে পারে। নির্বাচনের আগে এবং পরের ধাপের সংস্কার কার্যক্রম চিহ্নিত করা যায়।

জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি দায়বদ্ধতায় আন্তরিক থাকলে এই পদ্ধতিতে ‘সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচি’ সমঝোতা স্মারকে পৌঁছানো সম্ভব। সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচি সর্বরোগের ওষুধ নয়। এটি স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, গণতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিতকরণ এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় প্রথম পদক্ষেপ। এর কেন্দ্রে তিনটি মূল বিষয় থাকতে পারে। ক.

শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর; খ. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং গ. প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো। এগুলো কেবল রাজনৈতিক আদর্শ নয়; বরং বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য জরুরি প্রয়োজনীয়তা।

জুলাই ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান প্রচলিত ব্যবস্থাকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। সমতা, গণতান্ত্রিক জবাবদিহি ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি নতুন সামাজিক চুক্তির দাবি এখন জাজ্বল্যমান। সংবিধান, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি প্রতিরোধব্যবস্থা ও পুলিশি কার্যক্রম নিয়ে গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো ঐকমত্য গঠনের জন্য ভিত্তি হতে পারে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলো নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে কীভাবে সংলাপে সম্পৃক্ত হতে পারে, তার একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেওয়া হলো।   

শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর: একদলীয় আধিপত্যের চক্র ভাঙা

ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের অভাব রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বজায় রেখেছে। জনগণের আস্থা চুরমার করেছে। নির্বাচন তদারকির জন্য অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিক সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন দেশীয় কায়দায় তৈরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ক্ষমতার অদলবদল ঘটিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া এবং হস্তান্তরকালে সহিংসতা বা বাধাবিঘ্ন থেকে বিরত থাকার জন্য একটি বাধ্যতামূলক অঙ্গীকারেও সম্মত হতে পারে। এই পদক্ষেপগুলোতে সার্বিক সম্মতি থাকলে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সমতাভিত্তিক পরিবেশ তৈরি করতে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে। 

বিভিন্ন দল ইতিমধ্যে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার ও সংসদের ভারসাম্য, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও মেয়াদসীমা নিয়ে আলোচনা উপস্থাপন করেছে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য দৃশ্যমান। বিশেষভাবে নারীদের সংসদে অংশগ্রহণ বাড়ানোর ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব সীমিত এবং প্রচারাভিযান তহবিলের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ‘প্রচারাভিযান তহবিল প্রবিধান’–এর বিষয়ে সম্মত হতে পারে। তদুপরি ছোট দলসহ সব রাজনৈতিক দলের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ নিশ্চিত করাও হতে পারে সংলাপের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  

অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন: ভোটারের আস্থা পুনঃস্থাপন

বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো সমাধানের জন্য বিভিন্ন প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে বায়োমেট্রিক ভোটার যাচাইকরণ ব্যবস্থা চালু, ভুতুড়ে ভোটার দূর ও ভোটার তালিকার স্বচ্ছতা নিশ্চিতি অন্তর্ভুক্ত। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার লক্ষ্যে পুনর্গঠন বিষয়ে জনগণের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। 

কমিশনারদের একটি স্বচ্ছ, বহুদলীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। ‘রাতে ভোট’, ‘ভোটের আগেই প্রার্থী নির্বাচিত’ এবং ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ হওয়ার রোগ সারাতে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে নির্বাচন কমিশনের আওতায় আনার পরিষ্কার আইনি কাঠামো দরকার। এ ছাড়া নির্বাচনী প্রচারণার সময় রাষ্ট্র ও বেসরকারি মিডিয়ায় সব দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতি এবং নির্বাচন স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করতে খ্যাতিমান দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে পর্যবেক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর সংবিধির প্রয়োজন। 

প্রতিনিধিত্বশীল শাসনকাঠামো: গণতন্ত্র ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ

প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয় এবং স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা একধরনের দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি করেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতি, স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া এবং বিচারকদের নির্দিষ্ট মেয়াদ নির্ধারণের বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে উঠছে। এ ধরনের সংস্কার জন–আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য। একইভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা, স্বচ্ছ নিয়োগ নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতি মামলার স্বাধীন তদন্তের জন্য দুদককে পর্যাপ্ত সম্পদ ও কর্তৃত্ব প্রদান জরুরি। 

স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করাও নাগরিকতন্ত্র গঠনের জন্য জরুরি। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনকাঠামোর জন্য তা অপরিহার্য। পুলিশ বিভাগকে রাজনীতিমুক্ত করা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ করা গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘমেয়াদি নাগরিক সেবার জন্য আবশ্যিক শর্ত। 

পুলিশের ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ এবং তাদেরকে কমিউনিটির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাও একটি সম্ভাব্য সংস্কার পদক্ষেপ হতে পারে। এই সংস্কারগুলো আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ প্রশাসন নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

নির্বাহী ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আদালতের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বিচারাধীন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভাব্য ঐকমত্যের আরেকটি ক্ষেত্র। 

এখনই সময় কথাকে কাজে পরিণত করার

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আহ্বানে অনুষ্ঠিত সংলাপ বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ। রাজনৈতিক নেতারা যখন জাতীয় স্বার্থকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তখন তাঁদের সে অনুযায়ী কাজও করতে হবে।   

সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচির লক্ষ্য নিখুঁত সংস্কার নয়; বরং সম্ভবপর সংস্কার বাস্তবায়ন করা। বর্ণিত ম্যাক্স-মিন পদ্ধতি (Max-min principle), তথা সর্বাধিক দলের ন্যূনতম জরুরি সংস্কারে একমত হওয়া একটি বাস্তবসম্মত পথ তৈরি করতে পারে। আদর্শগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও স্থিতিশীলতা ও বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় মূল সংস্কারে ঐকমত্য সম্ভব। 

এই সংলাপকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ এবং জাতীয় স্বার্থের প্রতি নিবেদিত রাখতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ঐকান্তিক, ধৈর্যশীল, কার্যকর ভূমিকা পালন জরুরি। জনস্বার্থে সংস্কারের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়বদ্ধ করতে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও বিদ্বৎসমাজেরও বিশাল ভূমিকা আছে। 

 সর্বসম্মত ন্যূনতম সংস্কার কর্মসূচি শেষ লক্ষ্য নয়।  এটি বরং একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত মূল সংস্কার নিঃসন্দেহে জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন, স্থিতিশীলতা নিশ্চিত এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত তৈরি করবে। 

এরপর একটি নির্বাচিত সরকার জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী আরও ব্যাপক সংস্কার কার্যকর করতে পারবে। এর চেয়ে কম কিছু বাংলাদেশের জনগণ প্রাপ্য নয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে জাতির জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। 

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক ন শ চ ত কর ন র জন য র র জন য ব যবস থ ঐকমত য জনগণ র ত র জন ত কর র ক র জন র একট সরক র গঠন র ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

হাসিনার পতনে গ্রামেগঞ্জে প্রভাব ও আওয়ামী কর্মীদের ভাবনা কী

মাঠ ঘুরে এলাম ৯ থেকে ১০ দিন। রাজশাহী শহর, শহরসংলগ্ন উপকণ্ঠ এবং গ্রাম। সরেজমিন দেখলাম, স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সমর্থক ও কর্মীরা কেমন আছেন। তাঁদের সঙ্গে আলাপ হলো। নেতাদের দেখা পাইনি। কর্মী আর সমর্থকদের পেলাম। নেতারা বেশির ভাগ দেশছাড়া। অধিকাংশই ভারতে। পলাতক নেতারা কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলেন, খোঁজখবর নেন। কিন্তু তাঁরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, সেই সম্পর্কে কিছুই জানান না। শুধু কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন।

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নিজেদের ভেতর যোগাযোগ রক্ষা করেন। এ যোগাযোগ চলে মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। শেখ হাসিনার শাসন নিয়ে তাঁদের ভেতর কোনো অনুশোচনা বা দুঃখবোধ চোখে পড়ল না; বরং তাঁর শাসনের পক্ষে তাঁরা যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন।

আওয়ামী লীগের একটি বড় অর্জন এই যুক্তিবোধহীন সমর্থকশ্রেণি তৈরি। তাঁরা শেখ হাসিনার কোনো সমালোচনা শুনতে পছন্দ করেন না বা সমালোচনা করতে চান না।

উপজেলা পর্যায়ের একজন নেতা বললেন, কথায় কথায় শেখ হাসিনার সমালোচনা করা ফ্যাসিস্ট বলাটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। এই নেতার অনুযোগ, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পার্থক্য হলো আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা সহজেই শেখ হাসিনার সমালোচনা করেন। কিন্তু বিএনপির সমর্থকেরা তারেক জিয়ার কোনো সমালোচনা করেন না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি আর জামায়াতের ভালো-মন্দ দিক, নির্বাচন এবং নির্বাচন হলে কে ক্ষমতায় আসবে, মাঠেঘাটে তা ঘিরে আলোচনা চলছে। সংস্কার নিয়ে কোনো আলোচনা কানে এল না।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট বৈষম্যহীন বাংলাদেশে বিনির্মাণের আকাঙ্ক্ষার অস্তিত্ব মাঠে খুঁজে পেলাম না। মাঠে যা পেলাম, তা হলো শেখ হাসিনা–পরবর্তী রাজনৈতিক পুনর্বাসনের জন–আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষায় বিএনপির অবস্থান অগ্রগণ্য।

একটি পর্যবেক্ষণ হলো, গণ–অভ্যুত্থানের চেতনা ঢাকার বাইরে নেওয়া সম্ভব হয়নি। শেখ হাসিনার সরকারের পতন ও ভারতে পালিয়ে যাওয়াকে স্থানীয় জনগণ গণ–অভ্যুত্থানের মুখে একটি সরকারের পতন হিসেবেই দেখছে। গণ-অভ্যুত্থানের মর্মবাণী ঢাকার ফ্রেমে আটকে আছে। এটা মর্মান্তিক ব্যাপার। ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ বা ‘নতুন বয়ান’ কিংবা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ’ বিনির্মাণের স্বপ্ন মাঠেঘাটে নেই।

স্থানীয় জনগণ নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টায় জনগণ বিএনপিকে আগামী দিনের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে। গ্রামীণ রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে জনগণ বিশেষ কিছু ভাবছে না। কারণ, জনগণের রাজনৈতিক আচরণের অভ্যস্ততা কেবল ভোটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; জীবন-জীবিকা, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা মাড়িয়ে এর শিকড় অনেক গভীরে। জনগণের ক্ষমতাপ্রিয়তা বা ক্ষমতাসখ্যের তীব্র অনুভূতি প্রচলিত রাজনীতির একটি বিশেষ দিক, যার ভিত্তি হলো রাজনৈতিক দলকেন্দ্রিক এক বিশেষ সুবিধাবাদী ব্যবস্থা। মতাদর্শের চেয়ে অনেক বেশি অনুগামী ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) গঠন ও ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে স্থানীয় জনগণের অভিমত হলো, তারা দল না করে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে থাকলেই ভালো হতো। দল গঠনের ব্যাপারে জনগণ তাদের তাড়াহুড়া দেখেছে। তাদের মন্তব্যে এনসিপি দল দ্রুত গঠিত হয়েছে। তারা নির্বাচন করতে চায় এবং ক্ষমতায় যেতে যায়। কিন্তু গ্রামের ভোট এনসিপির বাক্সে আনা সহজ হবে না। কারণ, গ্রামের মানুষের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে সংযুক্তি, তার বাইরে আনা কঠিন।

গ্রামীণ পরিসরে নাগরিক বোধ সেই অর্থে বিকশিত হয়নি। মানুষ আছে বড় আকারের দলা হয়ে। এই দলা বালুর দলার মতো ঠুনকো। সামান্য আঘাতে এলোমেলো হয়ে যায়। আমাদের চাওয়া ছিল এঁটেল মাটির দলা, যূথবদ্ধ সামাজিক বিন্যাস। কিন্তু সামাজিক ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। সম্পর্কগুলো ভীষণভাবে হালকা হয়ে উঠছে। পরিশীলিত রাজনৈতিক বোধ ও দায়িত্বশীলতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। এই দায় সবার। জনগণের ভেতর বিদ্যমান ক্লেদাক্ত রাজনীতি লকলকে জিব বের করছে। এর শেষ কোথায়!

সুইডিশ লেখক ও ইতিহাসবিদ জোহান্স নর্গবাগ বলেছেন, গণতন্ত্রহীন পরিস্থিতিতে মানুষ সম্ভাবনা নয়, সুরক্ষা খুঁজে। তিনি ‘দ্য প্রোগ্রেস’ গ্রন্থে এই ধারণা তুলে ধরেন। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী যে কথোপজীবী শ্রেণি গড়ে উঠল, তারাও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সম্মেলনকক্ষের অনুরাগী। বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের সামাজিক কোনো রূপান্তর গ্রামীণ পরিসরে দেখা যাচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ কেবল গুটিকয় শহরের সমষ্টি নয়। নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে গ্রামের মানুষদের যুক্ত করা না গেলে তা বিশেষ কোনো ফল আনবে না।

আরেকটি বিষয় হলো, শাসন যত ভালো হোক না কেন, তা যদি জনগণের মনে স্বস্তি তৈরি না করে, তবে এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় না। শেখ হাসিনার পতনের মূলে রয়েছে জন–অসন্তুষ্টি। উন্নয়ন একটু কম হলেও সমস্যা নেই। মানুষ স্বস্তি চায়। ৫ আগস্ট–পরবর্তী মাঠে বিএনপি ও জামায়াতের বিরুদ্ধে দখল, চাঁদাবাজি, হানাহানি, কলহ, ক্ষেত্রবিশেষে খুনোখুনির অভিযোগ উঠছে। মানুষ শেখ হাসিনাকে তাড়িয়েছে একটু স্বস্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদার আশায়। বাস্তবে জনপরিসরে নতুন করে অস্বস্তি বাড়ছে।

পরাজিত আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের ওপর সেই খড়্গ নামছে প্রতিনিয়ত। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ একবার পরাজিত হয়েছে। সেই অবধি আওয়ামী লীগকে প্রতিদিন পরাজিত করার চেষ্টা হচ্ছে। একটি বড় জয়ের পর আর কোনো ছোট জয় থাকতে পারে না। যাঁরা অপরাধ করেছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যের বিচারের ভার নিজ হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।

পরাজিত আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের ওপর সেই খড়্গ নামছে প্রতিনিয়ত। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ একবার পরাজিত হয়েছে। সেই অবধি আওয়ামী লীগকে প্রতিদিন পরাজিত করার চেষ্টা হচ্ছে। একটি বড় জয়ের পর আর কোনো ছোট জয় থাকতে পারে না। যাঁরা অপরাধ করেছেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যের বিচারের ভার নিজ হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।

বিজয়ীদের ঔদ্ধত্য বাড়ছে। উদ্ধত আচরণ জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। বিজয়ী কতটা উন্নত, তা বোঝা যায় বিজিতের প্রতি সে কেমন আচরণ করে তা দিয়ে। বিজয়ের স্বাদ বিজিতদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া কাজের কথা হতে পারে না। বিজয় উদ্‌যাপনের চেয়ে তার মর্মকে বাস্তবে রূপ দেওয়া জরুরি কাজ। ভেঙে যাওয়া সম্পর্কগুলো, সমাজের গভীর ক্ষতগুলো সারিয়ে তোলা দরকার। আন্তসম্পর্কের গভীর নেতিবাচক অভিঘাত নিয়ে কোনো সমাজ বেশিদূর এগোতে পারে না।

ফ্যাসিস্ট তাড়ানোর বহুমাত্রিক অভিঘাত পড়েছে সমাজের নানা স্তরে। গ্রামের একজন সাধারণ আওয়ামী লীগ সমর্থকও তা পদে পদে অনুভব করছেন। ক্ষমতাহীনতার তিক্ত স্বাদ এবং অসহায়ত্ব তাঁদের পেয়ে বসেছে। পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের দুয়ারীবাজারের এক আওয়ামী লীগ সমর্থক জানান, অনেক মামলা তাঁর। এতে তাঁর সমস্যা নেই। সমস্যা হলো ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে। আর অর্থনীতি শেষ হয়ে গেলে মানুষের দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। অর্থনীতি ও রাজনীতি কীভাবে মিলেমিশে গেছে, তার চমৎকার ব্যাখ্যা দিলেন তিনি।

নিছক রাজনৈতিক সমর্থন ও দলীয় সম্পৃক্ততার কারণে কাউকে রাজনৈতিক, সামাজিক বা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও হয়রানি করা যাবে না। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই চলছে। এতে সামাজিক সংহতি ও সহাবস্থানমূলক সম্পর্কে ব্যাপক ফাটল ধরেছে। ফ্যাসিস্ট তাড়ানোর মাইক্রো–ইমপ্যাক্ট কত গভীরে, তা বুঝতে মাঠে পাওয়া কয়েকটি ঘটনা নিচে তুলে ধরা হলো।

ব্যাংকঋণ ‍নিয়ে মামলার ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা জানান, তৎকালীন সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী তাঁকে ক্ষমতার শেষ দিকে উপজেলা কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন। তিনি তা নিতে চাননি। পদ পাওয়ার অল্প কিছুদিনের মাথায় শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এরপর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীরা তাঁর নামে মামলার হুমকি দিতে থাকেন। মামলা থেকে বাঁচতে চাঁদা দেওয়ার জন্য চাপ দেন। মামলা-মোকদ্দমার ঝক্কি এড়াতে তিনি ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা ঋণ নেন। নেতাদের চাঁদা দিয়ে তিনি মামলা থেকে রক্ষা পেয়েছেন। স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী এই নেতা ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও সংসার চালাতে এখন হিমশিম খাচ্ছেন।

টুপি ও পাঞ্জাবি যখন মুক্তির দাওয়া

মাঠে দেখা হলো একজন পরিচিত আওয়ামী সমর্থকের সঙ্গে। বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার আলোকছত্র এলাকায়। তাঁর পোশাক-আশাকে ব্যাপক পরিবর্তন দেখলাম। তিনি টুপি ও পাঞ্জাবি পরেছেন, নিয়মিত নামাজ পড়ছেন। পোশাক পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করলে জানান, নিরাপত্তা , হুমকি ও মামলা থেকে বাঁচতে তিনি এই পরিবর্তন এনেছেন। তিনি আরও জানান, এতে তাঁর সমাজে মর্যাদা বেড়েছে। অনেকে সালাম দেন, সম্মান করেন।

গভীর নলকূপের অপারেটর পরিবর্তন

৫ আগস্টের পরপর তানোর-গোদাগাড়ী উপজেলা প্রায় সব গভীর নলকূপের অপারেটর পরিবর্তন করা হয়েছে। সেখানে বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থকেরা অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তবে তাঁদের নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। একটি গভীর নলকূপের অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পেতে এক লাখ টাকা উপরি গুনতে হয়েছে। বরেন্দ্র এলাকার গভীর নলকূপ কেবল সেচের উৎস নয়, ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের বড় পাওয়ার হাউস। কারণ, এটি সরাসরি কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৃষক নতুন করে অপারেটরদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চাষাবাদ চালিয়ে যাচ্ছেন।

স্থানীয় জনগণ নিজেদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার চেষ্টা করছেন। প্রচলিত রাজনীতির ঘেরাটোপের ভেতরই তাঁরা রয়েছেন। তার ভেতরেই তাঁরা যা খুঁজছেন, তা সুরক্ষা, সম্ভাবনা নয়। গ্রামের মানুষ পরিবর্তন আশা করে। কিন্তু সেটা কত দূর, সে বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত নন।

খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ পেশাজীবী ও শিক্ষক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দেশের নাম ‘বাংলাদেশ জনকল্যাণ রাষ্ট্র’ চায় ইসলামী আন্দোলন
  • ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শেয়ারবাজারে কারসাজির অভিযোগ, তদন্তের আহ্বান সিনেটরদের
  • সংস্কার প্রস্তাবনার ওপর মতামত জানাল ইসলামী আন্দোলন
  • হাসিনার পতনে গ্রামেগঞ্জে প্রভাব ও আওয়ামী কর্মীদের ভাবনা কী
  • ‘পিপল ওয়েলফেয়ার স্টেট অব বাংলাদেশ’ নাম চায় ইসলামী আন্দোলন
  • ১৯ বার বৈঠকের পর জোট গঠনে ঐকমত্য
  • ঐকমত্য কমিশনে বিকল্পধারা বাংলাদেশ ও গণঅধিকার পরিষদের মতামত
  • সংস্কার নিয়ে মতামত দিল আরও দুই দল
  • এনসিপির সঙ্গে হেফাজতের বৈঠক, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঐকমত্য
  • ঐকমত্য কমিশনের লক্ষ্য আগামী বাংলাদেশের পথরেখা তৈরি করা: আলী রীয়াজ