বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের দপ্তরের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ খান। কমিশনের মধ্যম সারির এই কর্মকর্তার সাকল্যে বেতন পাওয়ার কথা ৬৮ হাজার ২৮৩ টাকা। তবে তিনি নিজ দপ্তর থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়েছেন। এই মুহূর্তে অফিসের কাছে তাঁর ঋণের দেনা ৫৬ লাখ ৫৮ হাজার ৪৭০ টাকা। ছয়টি আলাদা ঋণের কিস্তি বাবদ ৫৬ হাজার ৯০৮ টাকা ৭৫ পয়সা কেটে রেখে সব মিলিয়ে তিনি মাস শেষে হাতে পান মাত্র ১১ হাজার ৩৭৪ টাকা ২৫ পয়সা। প্রশ্ন উঠেছে, রাজধানীতে থেকে গৃহিণী স্ত্রী, দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার এত কম টাকায় তিনি কীভাবে চালান?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৎভাবে এই টাকায় চারজনের সংসার চালানো কোনোভাবে সম্ভব না। এ ছাড়া ইউজিসি কর্তৃপক্ষ অনিয়মের মাধ্যমে প্রাপ্যতার চেয়ে অতিরিক্ত ঋণ এই কর্মকর্তার নামে মঞ্জুর করেছে। এর দায় কমিশন এড়াতে পারে না।

সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ খান ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইউজিসিতে কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগ দেন। সর্বশেষ গত ২৯ জানুয়ারি তাঁকে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর আগে তাঁর বেতন আরও কম ছিল। গত জানুয়ারির তাঁর বেতন বিবরণী সমকালের হাতে রয়েছে।
ইউজিসির কর্মকর্তারা জানান, মামুনুর রশিদ খান নিজেকে ইউজিসি চেয়ারম্যানের এপিএস হিসেবে পরিচয় দেন। যদিও ইউজিসির অর্গানোগ্রামে এ ধরনের পদ নেই। তিনি বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে চেয়ারম্যানের সঙ্গে থাকেন। সমাবর্তন আয়োজনে ইউজিসির পক্ষ থেকে তিনি নেপথ্যে সহায়তা করেন বলে তাঁকে নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে। 
মামুনুর রশিদ খান বাড়ি নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ ঋণ পেতে পারেন ১৩ লাখ ২১ হাজার ৩৮৭ টাকা। অথচ ইউজিসি তাঁকে অতিরিক্ত ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬৫২ টাকাসহ সব মিলিয়ে ঋণ দিয়েছে ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৪১৩ টাকা। কিস্তি পরিশোধের কারণে এখন তা ৫২ লাখে নেমে এসেছে।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বিপুল অঙ্কের ঋণ থাকলেও মামুনুর রশিদকে বর্তমান কমিশনের আমলে আরও ৪ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। তাঁর ঋণের নথিতে বলা হয়, মামুনুর রশিদের পেনশন আনুতোষিক ৩৫ লাখ ১২ হাজার ১৪ টাকা। আর ভবিষ্য তহবিলের স্থিতি ৭ লাখ ৩১ হাজার ৯০৫ টাকা। এ দুটি মিলিয়ে মোট সমন্বিত স্থিতি ৪২ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৯ টাকা। বর্তমান ঋণ, গৃহনির্মাণ ঋণের স্থিতি ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৫৯৩ টাকা। করপোরেট গৃহনির্মাণ ঋণের স্থিতি ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮৭ টাকা। আর যানবাহন ঋণের স্থিতি ৭৭ হাজার ৪০০ টাকাসহ বর্তমান মোট ঋণ ৫২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৭০ টাকা।
নথিতে আরও বলা হয়, প্রাপ্যতার চেয়ে তাঁর দেনার পরিমাণ ১০ লাখ ১৪ হাজার ৫৫১ টাকা বেশি। এর আগে তিনি আরও চারবার ভবিষ্য তহবিল থেকে ঋণ চেয়ে আবেদন করেছেন। তবে দেনার পরিমাণ বেশি থাকায় কর্তৃপক্ষ ঋণ মঞ্জুর করেনি। তার পরও সম্প্রতি তাঁকে অতিরিক্ত ৪ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কর্মকর্তাদের বাড়ি নির্মাণে অন্তত দেড় কোটি টাকা অতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে ইউজিসি। প্রাপ্যতার অতিরিক্ত টাকা নেওয়া কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা চেয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।

এত ঋণ নিয়ে কী করেছেন? জানতে চাইলে মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ খান সমকালকে বলেন, ‘আমার মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে, তাদের পেছনে সব খরচ করেছি। বাড়ি-গাড়ি কিনিনি।’
মাত্র ১১ হাজার টাকা বেতনে কীভাবে চলেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ চালায়। গ্রামের বাড়ি থেকে চাল-ডাল আনি, মাছ আনি। এভাবে চলি।’
অনিয়ম করে ঋণ নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঋণ তো আমি মঞ্জুর করিনি। আমি অন্যায় করে থাকলে লিখুন। নিয়মের বাইরে আমি কোনো ঋণ নিইনি।’ সর্বশেষ নেওয়া ৪ লাখ টাকা ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আমি নিয়েছি। এটা কোনো অপরাধ নয়।’ চেয়ারম্যানের এপিএস পরিচয় দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এপিএস বলি না নিজেকে। আমি চেয়ারম্যানের সহকারী সচিব।’
এ ব্যাপারে ইউজিসির সচিব ড.

মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, তিনি তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ৪ লাখ টাকা নিয়েছেন। প্রভিডেন্ট ফান্ডে তাঁর জমা আছে ৬ লাখ টাকা। আমরা ৪ লাখ টাকা তাঁকে দিয়েছি। 

ইউজিসি অতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে যাদের
গৃহনির্মাণের জন্য সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছেন ইউজিসির পরিচালক (জেনারেল সার্ভিসেস এ স্টেট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ) জাফর আহম্মদ জাহাঙ্গীর। ‘ইউজিসি সিএইচবিএল প্রাপ্তির সর্বোচ্চ সীমা’ ২৭ লাখ ৮১ হাজার ৭২২ টাকা। অর্থাৎ ঋণ নেওয়ার সময় চাকরির বয়স অনুযায়ী তাঁর পেনশন ও অন্যান্য আনুতোষিক মিলিয়ে ২৭ লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য তিনি। তবে এ কর্মকর্তাকে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত ৪৫ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। তাঁর মোট ঋণের পরিমাণ ৬৭ লাখ টাকা।
ইউজিসির অতিরিক্ত পরিচালক (স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাশিউরেন্স বিভাগ) মো. আকরাম আলী খান গৃহনির্মাণ ঋণ নেওয়ার সময় ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তা ছিলেন। ইউজিসি সিএইচবিএল অনুযায়ী ঋণপ্রাপ্তির সর্বোচ্চ সীমা ২৩ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৭ টাকা। তিনি সব মিলিয়ে ঋণ নিয়েছেন ৫৫ লাখ ২২ হাজার ৯৪৯ টাকা। প্রাপ্যতার সর্বোচ্চ সীমার চেয়ে তিনি অতিরিক্ত ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৩৪৫ টাকা ঋণ নিয়েছেন।

ইউজিসিতে ১৮তম গ্রেডে চাকরি করা অফিস সহায়ক মির্জা হামিদুল ইসলাম অতিরিক্ত ১৪ লাখ ৬৯ হাজার ৩০১ টাকা, মো. আমিনুল ইসলাম অতিরিক্ত ৮ লাখ ৩১ হাজার ৫৬১ টাকা, মো. আবুল হোসেন অতিরিক্ত ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৬৮৭ টাকা এবং মো. নুরুল ইসলাম জীবন ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা অতিরিক্ত ঋণ হিসেবে নিয়েছেন।
ইউজিসির সিএইচবিএলের সর্বোচ্চ ঋণসীমার অতিরিক্ত হিসেবে আরও টাকা তুলে নিয়েছেন ১৬তম গ্রেডের কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুস সালাম ১১ লাখ ৩৩ হাজার ২১৩ টাকা, ১৮তম গ্রেডের মেশিন অপারেটর মো. শহিদুল ইসলাম ৬ লাখ ৬২ হাজার ১৩১, একই গ্রেডের বার্তা বাহক মাসুদ রানা ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৯৪, অফিস সহায়ক মো. আবুল বাশার ৩ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ এবং নিরাপত্তা প্রহরী মো. নুরনবী ৬ লাখ ৯ হাজার ৬৯৮ টাকা।
বেশি ঋণ নেওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে পরিচালক জাফর আহম্মদ জাহাঙ্গীর সমকালকে বলেন, ‘আমি কি ইউজিসির ভল্ট ভেঙে টাকা নিয়েছি? নাকি অর্থ বিভাগের পরিচালককে জোর করে চেকে সই নিয়েছি? সম্পূর্ণ নিয়মনীতি ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঋণ নিয়েছি।’

নীতিমালা ভেঙে বাড়তি ঋণ
ইউজিসির করপোরেট সাধারণ গৃহনির্মাণ ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, পঞ্চম গ্রেড ও তদূর্ধ্ব কর্মচারীর জন্য ৭৫ লাখ টাকা, নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেড ৬৫ লাখ, ১৩তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেড ৫৫ লাখ, ১৭তম গ্রেড থেকে ১৪তম গ্রেড ৪০ লাখ এবং ২০তম গ্রেড থেকে ১৮তম গ্রেড পর্যন্ত ৩৫ লাখ টাকা সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা আছে। এ পরিমাণ টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরি জীবনের শেষ দিকে পেয়ে থাকেন।
এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে গৃহনির্মাণ ঋণ নীতিমালায় ঋণের সিকিউরিটি হিসেবে জমি বা ফ্ল্যাট সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে বন্ধক হিসেবে রাখতে হয়। 
তবে কমিশনের ত্রুটিপূর্ণ করপোরেট সাধারণ গৃহনির্মাণ ঋণের বিপরীতে সিকিউরিটি হিসেবে শুধু কর্মচারীর পেনশন আনুতোষিক বন্ধক হিসেবে রাখা হয়। নীতিমালায় সীমা যাই থাকুক না কেন, একজন কর্মচারী ঋণ দেওয়ার সময় তাঁর চাকরির বয়স অনুযায়ী প্রাপ্য পেনশন ও আনুতোষিকের চেয়ে বেশি ঋণ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ ইউজিসির অন্তত ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি।

ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, তারা অনেকে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করলেও বাড়ি তৈরির জন্য ঋণ পাচ্ছেন না। অথচ একই ব্যক্তি একাধিকবার ঋণ পাচ্ছেন। কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, সদস্যসহ অন্যান্য কর্মকর্তার জোগসাজশে প্রাপ্যতার বাইরে দ্বিগুণ অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়েছেন অনেকে। ইউজিসি কীভাবে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত ঋণ দেয়? 
প্রাপ্যতার অতিরিক্ত টাকা অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘আমাদের বর্তমান কমিশনের আমলে এমনটা হয়নি। এগুলোর সবই ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেওয়া হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নথি না দেখে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না।’
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ বলেন, ‘গৃহনির্মাণ ঋণ নির্ধারিত সীমার ভেতরেই দেওয়ার কথা। এর বাইরে দেওয়া হলে তা অবশ্যই অন্যায় হয়েছে। এগুলো আমরা খতিয়ে দেখব।’ তিনি বলেন, ‘গৃহনির্মাণ ঋণের সীমা কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বার্থে বাড়ানোর জন্য আমরা চেষ্টা করব।’

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ঋণ কর মকর ত র ঋণ ন য় ছ ন ইউজ স র ল ইসল ম অন য য় পর ম ণ ঋণ র স ঋণ দ য় র জন য জ র কর প নশন সমক ল

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে ঋণের মহোৎসব

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যানের দপ্তরের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ খান। কমিশনের মধ্যম সারির এই কর্মকর্তার সাকল্যে বেতন পাওয়ার কথা ৬৮ হাজার ২৮৩ টাকা। তবে তিনি নিজ দপ্তর থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়েছেন। এই মুহূর্তে অফিসের কাছে তাঁর ঋণের দেনা ৫৬ লাখ ৫৮ হাজার ৪৭০ টাকা। ছয়টি আলাদা ঋণের কিস্তি বাবদ ৫৬ হাজার ৯০৮ টাকা ৭৫ পয়সা কেটে রেখে সব মিলিয়ে তিনি মাস শেষে হাতে পান মাত্র ১১ হাজার ৩৭৪ টাকা ২৫ পয়সা। প্রশ্ন উঠেছে, রাজধানীতে থেকে গৃহিণী স্ত্রী, দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার এত কম টাকায় তিনি কীভাবে চালান?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সৎভাবে এই টাকায় চারজনের সংসার চালানো কোনোভাবে সম্ভব না। এ ছাড়া ইউজিসি কর্তৃপক্ষ অনিয়মের মাধ্যমে প্রাপ্যতার চেয়ে অতিরিক্ত ঋণ এই কর্মকর্তার নামে মঞ্জুর করেছে। এর দায় কমিশন এড়াতে পারে না।

সমকালের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ খান ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ইউজিসিতে কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগ দেন। সর্বশেষ গত ২৯ জানুয়ারি তাঁকে সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এর আগে তাঁর বেতন আরও কম ছিল। গত জানুয়ারির তাঁর বেতন বিবরণী সমকালের হাতে রয়েছে।
ইউজিসির কর্মকর্তারা জানান, মামুনুর রশিদ খান নিজেকে ইউজিসি চেয়ারম্যানের এপিএস হিসেবে পরিচয় দেন। যদিও ইউজিসির অর্গানোগ্রামে এ ধরনের পদ নেই। তিনি বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে চেয়ারম্যানের সঙ্গে থাকেন। সমাবর্তন আয়োজনে ইউজিসির পক্ষ থেকে তিনি নেপথ্যে সহায়তা করেন বলে তাঁকে নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যে আলোচনা আছে। 
মামুনুর রশিদ খান বাড়ি নির্মাণের জন্য সর্বোচ্চ ঋণ পেতে পারেন ১৩ লাখ ২১ হাজার ৩৮৭ টাকা। অথচ ইউজিসি তাঁকে অতিরিক্ত ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬৫২ টাকাসহ সব মিলিয়ে ঋণ দিয়েছে ৬১ লাখ ৬৫ হাজার ৪১৩ টাকা। কিস্তি পরিশোধের কারণে এখন তা ৫২ লাখে নেমে এসেছে।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বিপুল অঙ্কের ঋণ থাকলেও মামুনুর রশিদকে বর্তমান কমিশনের আমলে আরও ৪ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। তাঁর ঋণের নথিতে বলা হয়, মামুনুর রশিদের পেনশন আনুতোষিক ৩৫ লাখ ১২ হাজার ১৪ টাকা। আর ভবিষ্য তহবিলের স্থিতি ৭ লাখ ৩১ হাজার ৯০৫ টাকা। এ দুটি মিলিয়ে মোট সমন্বিত স্থিতি ৪২ লাখ ৪৩ হাজার ৯১৯ টাকা। বর্তমান ঋণ, গৃহনির্মাণ ঋণের স্থিতি ১৩ লাখ ৮২ হাজার ৫৯৩ টাকা। করপোরেট গৃহনির্মাণ ঋণের স্থিতি ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার ৪৮৭ টাকা। আর যানবাহন ঋণের স্থিতি ৭৭ হাজার ৪০০ টাকাসহ বর্তমান মোট ঋণ ৫২ লাখ ৫৮ হাজার ৪৭০ টাকা।
নথিতে আরও বলা হয়, প্রাপ্যতার চেয়ে তাঁর দেনার পরিমাণ ১০ লাখ ১৪ হাজার ৫৫১ টাকা বেশি। এর আগে তিনি আরও চারবার ভবিষ্য তহবিল থেকে ঋণ চেয়ে আবেদন করেছেন। তবে দেনার পরিমাণ বেশি থাকায় কর্তৃপক্ষ ঋণ মঞ্জুর করেনি। তার পরও সম্প্রতি তাঁকে অতিরিক্ত ৪ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কর্মকর্তাদের বাড়ি নির্মাণে অন্তত দেড় কোটি টাকা অতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে ইউজিসি। প্রাপ্যতার অতিরিক্ত টাকা নেওয়া কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা চেয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।

এত ঋণ নিয়ে কী করেছেন? জানতে চাইলে মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ খান সমকালকে বলেন, ‘আমার মেয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে, তাদের পেছনে সব খরচ করেছি। বাড়ি-গাড়ি কিনিনি।’
মাত্র ১১ হাজার টাকা বেতনে কীভাবে চলেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ চালায়। গ্রামের বাড়ি থেকে চাল-ডাল আনি, মাছ আনি। এভাবে চলি।’
অনিয়ম করে ঋণ নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঋণ তো আমি মঞ্জুর করিনি। আমি অন্যায় করে থাকলে লিখুন। নিয়মের বাইরে আমি কোনো ঋণ নিইনি।’ সর্বশেষ নেওয়া ৪ লাখ টাকা ঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আমি নিয়েছি। এটা কোনো অপরাধ নয়।’ চেয়ারম্যানের এপিএস পরিচয় দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এপিএস বলি না নিজেকে। আমি চেয়ারম্যানের সহকারী সচিব।’
এ ব্যাপারে ইউজিসির সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, তিনি তাঁর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ৪ লাখ টাকা নিয়েছেন। প্রভিডেন্ট ফান্ডে তাঁর জমা আছে ৬ লাখ টাকা। আমরা ৪ লাখ টাকা তাঁকে দিয়েছি। 

ইউজিসি অতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে যাদের
গৃহনির্মাণের জন্য সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছেন ইউজিসির পরিচালক (জেনারেল সার্ভিসেস এ স্টেট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ) জাফর আহম্মদ জাহাঙ্গীর। ‘ইউজিসি সিএইচবিএল প্রাপ্তির সর্বোচ্চ সীমা’ ২৭ লাখ ৮১ হাজার ৭২২ টাকা। অর্থাৎ ঋণ নেওয়ার সময় চাকরির বয়স অনুযায়ী তাঁর পেনশন ও অন্যান্য আনুতোষিক মিলিয়ে ২৭ লাখ টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য তিনি। তবে এ কর্মকর্তাকে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত ৪৫ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে। তাঁর মোট ঋণের পরিমাণ ৬৭ লাখ টাকা।
ইউজিসির অতিরিক্ত পরিচালক (স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাশিউরেন্স বিভাগ) মো. আকরাম আলী খান গৃহনির্মাণ ঋণ নেওয়ার সময় ষষ্ঠ গ্রেডের কর্মকর্তা ছিলেন। ইউজিসি সিএইচবিএল অনুযায়ী ঋণপ্রাপ্তির সর্বোচ্চ সীমা ২৩ লাখ ৯৯ হাজার ৯৯৭ টাকা। তিনি সব মিলিয়ে ঋণ নিয়েছেন ৫৫ লাখ ২২ হাজার ৯৪৯ টাকা। প্রাপ্যতার সর্বোচ্চ সীমার চেয়ে তিনি অতিরিক্ত ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৩৪৫ টাকা ঋণ নিয়েছেন।

ইউজিসিতে ১৮তম গ্রেডে চাকরি করা অফিস সহায়ক মির্জা হামিদুল ইসলাম অতিরিক্ত ১৪ লাখ ৬৯ হাজার ৩০১ টাকা, মো. আমিনুল ইসলাম অতিরিক্ত ৮ লাখ ৩১ হাজার ৫৬১ টাকা, মো. আবুল হোসেন অতিরিক্ত ৫ লাখ ৭৯ হাজার ৬৮৭ টাকা এবং মো. নুরুল ইসলাম জীবন ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা অতিরিক্ত ঋণ হিসেবে নিয়েছেন।
ইউজিসির সিএইচবিএলের সর্বোচ্চ ঋণসীমার অতিরিক্ত হিসেবে আরও টাকা তুলে নিয়েছেন ১৬তম গ্রেডের কম্পিউটার অপারেটর মো. আব্দুস সালাম ১১ লাখ ৩৩ হাজার ২১৩ টাকা, ১৮তম গ্রেডের মেশিন অপারেটর মো. শহিদুল ইসলাম ৬ লাখ ৬২ হাজার ১৩১, একই গ্রেডের বার্তা বাহক মাসুদ রানা ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৯৪, অফিস সহায়ক মো. আবুল বাশার ৩ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ এবং নিরাপত্তা প্রহরী মো. নুরনবী ৬ লাখ ৯ হাজার ৬৯৮ টাকা।
বেশি ঋণ নেওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে পরিচালক জাফর আহম্মদ জাহাঙ্গীর সমকালকে বলেন, ‘আমি কি ইউজিসির ভল্ট ভেঙে টাকা নিয়েছি? নাকি অর্থ বিভাগের পরিচালককে জোর করে চেকে সই নিয়েছি? সম্পূর্ণ নিয়মনীতি ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ঋণ নিয়েছি।’

নীতিমালা ভেঙে বাড়তি ঋণ
ইউজিসির করপোরেট সাধারণ গৃহনির্মাণ ঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, পঞ্চম গ্রেড ও তদূর্ধ্ব কর্মচারীর জন্য ৭৫ লাখ টাকা, নবম গ্রেড থেকে ষষ্ঠ গ্রেড ৬৫ লাখ, ১৩তম গ্রেড থেকে দশম গ্রেড ৫৫ লাখ, ১৭তম গ্রেড থেকে ১৪তম গ্রেড ৪০ লাখ এবং ২০তম গ্রেড থেকে ১৮তম গ্রেড পর্যন্ত ৩৫ লাখ টাকা সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা আছে। এ পরিমাণ টাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরি জীবনের শেষ দিকে পেয়ে থাকেন।
এ ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে গৃহনির্মাণ ঋণ নীতিমালায় ঋণের সিকিউরিটি হিসেবে জমি বা ফ্ল্যাট সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে বন্ধক হিসেবে রাখতে হয়। 
তবে কমিশনের ত্রুটিপূর্ণ করপোরেট সাধারণ গৃহনির্মাণ ঋণের বিপরীতে সিকিউরিটি হিসেবে শুধু কর্মচারীর পেনশন আনুতোষিক বন্ধক হিসেবে রাখা হয়। নীতিমালায় সীমা যাই থাকুক না কেন, একজন কর্মচারী ঋণ দেওয়ার সময় তাঁর চাকরির বয়স অনুযায়ী প্রাপ্য পেনশন ও আনুতোষিকের চেয়ে বেশি ঋণ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অথচ ইউজিসির অন্তত ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি।

ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, তারা অনেকে দীর্ঘদিন ধরে চাকরি করলেও বাড়ি তৈরির জন্য ঋণ পাচ্ছেন না। অথচ একই ব্যক্তি একাধিকবার ঋণ পাচ্ছেন। কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, সদস্যসহ অন্যান্য কর্মকর্তার জোগসাজশে প্রাপ্যতার বাইরে দ্বিগুণ অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়েছেন অনেকে। ইউজিসি কীভাবে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত ঋণ দেয়? 
প্রাপ্যতার অতিরিক্ত টাকা অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘আমাদের বর্তমান কমিশনের আমলে এমনটা হয়নি। এগুলোর সবই ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেওয়া হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নথি না দেখে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না।’
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এসএমএ ফায়েজ বলেন, ‘গৃহনির্মাণ ঋণ নির্ধারিত সীমার ভেতরেই দেওয়ার কথা। এর বাইরে দেওয়া হলে তা অবশ্যই অন্যায় হয়েছে। এগুলো আমরা খতিয়ে দেখব।’ তিনি বলেন, ‘গৃহনির্মাণ ঋণের সীমা কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বার্থে বাড়ানোর জন্য আমরা চেষ্টা করব।’

 

সম্পর্কিত নিবন্ধ