পবিত্র রমজান সংযমের মাস, আত্মশুদ্ধির মাস। অথচ বাংলাদেশে এ মাস এলেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে যায়। বেগুন, লেবু, ছোলা, চিনি, ভোজ্যতেল—ইত্যাদি পণ্যের মূল্য যেন হঠাৎ আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠে।

এই লেখক দীর্ঘদিন কর্মসূত্রে জাপানে অবস্থান করেছেন। সেখানকার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, জাপানে কোনো ধর্মীয় উৎসবের সময়ও বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করে না; বরং দাম থাকে স্বাভাবিক। সেখানে তারা সৎভাবে চলার চেষ্টা করে, আইন মানে, মানুষ ঠকায় না। নৈতিকতা ও সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা জাপানের জীবনযাত্রার মূল ভিত্তি।

অন্যদিকে বাংলাদেশে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তাহলে আমাদের দেশে কেন এই মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা? এর পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে।

জাপানের সততা ও আইনের কঠোরতা: জাপানে ব্যবসার নীতিমালা অত্যন্ত স্বচ্ছ, আর আইনের প্রয়োগও কঠোর। কেউ যদি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বা অযৌক্তিকভাবে পণ্যের দাম বাড়ায়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ফলে ব্যবসায়ীরা অনৈতিকভাবে মুনাফা করার চিন্তাই করে না।

বাংলাদেশের অনিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থা: বাংলাদেশে পবিত্র রমজানের শুরুতে অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যপণ্য মজুত করে বাজারে সংকট তৈরি করে। ফলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম দেখা যায়, আর এতে দাম বেড়ে যায়। তদারকির অভাব, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে সাধারণ মানুষকে বেশি দাম দিয়ে পণ্য কিনতে হয়।

ভোক্তাদের অসচেতনতা ও মূল্যবোধের অভাব: পবিত্র রমজান সংযমের মাস হলেও বাস্তবে আমরা সংযমের চেয়ে মুনাফার প্রতিযোগিতা দেখি। অনেক ক্রেতা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্য কিনে থাকেন, যা বাজারে চাহিদা আরও বাড়িয়ে তোলে। আবার অনেক ব্যবসায়ী মূল্যবোধ ভুলে গিয়ে অধিক মুনাফার লোভে সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা ভাবে না।

ব্যবস্থার স্বচ্ছতা: জাপানে ব্যবসায়িক স্বচ্ছতা রয়েছে। এখানে যদি কেউ বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে দাম বাড়ায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ফলে ব্যবসায়ীরা অসাধু উপায়ে দাম বাড়ানোর সাহস পায় না। বাংলাদেশে আইন থাকলেও তা প্রয়োগে অনেক দুর্বলতা আছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের মনিটরিং কার্যকর হয় না, যার ফলে অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ নেয়।

নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা: জাপানের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুদের ছোটবেলা থেকেই সততা, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ শেখায়। সেখানে প্রতারণা, মিথ্যা বা দুর্নীতি করা খুবই লজ্জার ব্যাপার। মানুষকে ঠকানো সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা অনেক সময় বেশি মুনাফার আশায় ক্রেতাদের অসুবিধার কথা চিন্তা না করেই দাম বাড়িয়ে দেয়। অনেকে এটাকে স্বাভাবিক ব্যাপার মনে করে। কারণ, তারা মনে করে, ‘সবাই তো একই কাজ করছে’!

কৃত্রিম সংকট ও মজুতদারি: বাংলাদেশে পবিত্র রমজানের শুরুতেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যপণ্য গুদামজাত করে মজুতদারি শুরু করে, যাতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। এ কারণে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম দেখা যায়, আর এতে দাম বেড়ে যায়। জাপানে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। সেখানে বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে সরকারের নজরদারি থাকে, আর জনগণেরও সচেতনতা বেশি।

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য: বাংলাদেশে কৃষকেরা কম দামে পণ্য বিক্রি করে, কিন্তু ভোক্তারা সেটা অনেক চড়া দামে কেনে। এর মূল কারণ হলো মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালেরা। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে পণ্য কিনে পরে বাজারে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করে। জাপানে কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সরাসরি পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা কার্যকর, ফলে দামের ওপর দালালদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

ভোক্তাদের অসচেতনতা ও অসহযোগিতা: বাংলাদেশে অনেক সময় ভোক্তারাও দায়ী। অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পণ্য কিনেন, ফলে চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যায় এবং দামও বেড়ে যায়। জাপানে মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কেনে না, তাই বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় না।

মূল্যবোধ বাস্তবায়নের অভাব: পবিত্র রমজান মানে সংযমের মাস, কিন্তু বাংলাদেশে অনেকের জন্য এটি লাভ করার সময়। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও রাষ্ট্রীয় আইন মেনে ন্যায্য দামে ব্যবসা করা উচিত, কিন্তু বাস্তবে অনেক ব্যবসায়ী এই নীতিগুলো মেনে চলে না। জাপানে নৈতিকতার কারণে মানুষ সৎভাবে ব্যবসা করে। তারা নিজেদের দায়িত্ব বোঝে এবং লোভের কারণে অন্যের ক্ষতি করতে চায় না।

জাপানে সুশৃঙ্খল সমাজ, কঠোর আইন, নৈতিক শিক্ষা ও জনগণের সচেতনতা বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে আমরা নৈতিকতা নিয়ে এত উচ্চকিত থেকেও একটি সুস্থ সমাজ বিনির্মাণ করতে পারিনি। আমাদের প্রয়োগে সমস্যা। ব্যবস্থার সমস্যা। সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা। আইনের প্রয়োগে সমস্যা। নৈতিক শিক্ষার অভাব। আমাদের নিশ্চয়ই বিশাল গলদ রয়েছে। সেই গলদ কোথায়, গভীরভাবে ভাবা দরকার।

যদি আমরা সবাই সচেতন হই, আইন মেনে চলি এবং নৈতিক মূল্যবোধ অনুসরণ করি, তাহলে এই সমস্যা অনেকটাই কমানো সম্ভব। পবিত্র রমজানে যদি ব্যবসায়ী, ক্রেতা ও প্রশাসন—সবাই সচেতন হয়, নৈতিকতা মেনে চলে এবং আইন কঠোরভাবে কার্যকর হয়, তাহলে আমাদের দেশেও নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে।

ড.

এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স) এবং পরিচালক, পোলট্রি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব যবস য ব যবস থ সরবর হ আম দ র ন ত কত আইন র সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

বিদ্যুৎ না থাকায় ডিইপিজেডে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ

ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়ায় ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ডিইপিজেড) আজ সোমবার দুপুর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এ কারণে দুপুরের পর ডিইপিজেডের সব কারখানায় শ্রমিকদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। ডিইপিজেডের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় এ সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ডিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক মো. শরীফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ইউনাইটেড পাওয়ারের ডিইপিজেডে বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রকল্পটিতে গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এতে তারা উৎপাদন করতে না পারায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে ডিইপিজেডে প্রায় ৯০টি কারখানার এক লাখের মতো শ্রমিককে ছুটি দেওয়া হয়।

বিদ্যুতের সংযোগ না থাকায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে উল্লেখ করে মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবার যদি এটি অব্যাহত থাকে, তবে সংকট আরও বাড়বে। শ্রমিকেরা কাজ না করতে পেরে বিক্ষুব্ধ হলে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠবে। কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়া এ ধরনের ঘটনায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ডিইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘তিতাস বলছে, ইউনাইটেড পাওয়ারের কাছে বিল বকেয়া রয়েছে। তারা বকেয়া পরিশোধ করেনি। এ ব্যাপারে আদালতে দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলছে। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে, বেপজাকে কোনো ধরনের পূর্ব নোটিশ না দিয়ে হঠাৎ করে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন। এ ধরনের পদক্ষেপের আগে ডিইপিজেডের গুরুত্ব বিবেচনা করে আলোচনার মধ্য দিয়ে বিষয়টির সমাধান করা উচিত ছিল।’

এ বিষয়ে ইউনাইটেড পাওয়ার প্ল্যান্টের ব্যবস্থাপক মো. মমতাজ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাসের কোনো প্রেশার নেই। প্রেশার শূন্য। কিন্তু কেন তিতাস কর্তৃপক্ষ এমনটি করল, সে ব্যাপারে এখানকার (আশুলিয়া অঞ্চলের) তিতাসের লোকজন কিছু বলতে পারেননি। আমরা নিজেরাও বিষয়টি নিয়ে জানি না। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার জানামতে, বকেয়া নিয়ে কোনো ধরনের মামলা নেই। তিতাস কেন গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিল, সেটি জানা নেই।’

জানতে চাইলে তিতাসের আশুলিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবু ছালেহ মুহাম্মদ খাদেমুদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের বিল বকেয়া থাকায় গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এটি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের সিদ্ধান্ত। দুপুরের দিকে গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আদানির সঙ্গে চুক্তি ক‌রে শুল্ক ফাঁকি
  • শিল্প খাতের উৎপাদন যেন ব্যাহত না হয়
  • কারাগারে গাঁজা সরবরাহ করতে গিয়ে নিজেই কারাগারে
  • ‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা কী
  • ডিইপিজেডে বিদ্যুৎ নেই, ৯০ কারখানায় ছুটি
  • মঙ্গলবার ৭ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব জায়গায়
  • পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে আরও ২৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত
  • পর্তুগাল ও স্পেনে নজিরবিহীন বিদ্যুৎ বিপর্যয়, পর্যুদস্তু জনজীবন
  • হাসপাতালে ডায়রিয়ার প্রকোপ শয্যা ও স্যালাইন সংকট
  • বিদ্যুৎ না থাকায় ডিইপিজেডে উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ