পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিন্যাস অনিবার্য
Published: 10th, March 2025 GMT
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোকেই নাড়া দেয়নি, বরং পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক কৌশলেও নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা ঐতিহ্য ও প্রথাগত কূটনৈতিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে সরকার এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রকৃত মিত্র ও প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। এই পরিবর্তন অতীতের পরনির্ভরশীল পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে আসার স্পষ্ট ইঙ্গিত। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশকে জাতীয় মর্যাদা, আত্মসম্মান ও বৈশ্বিক পরিসরে সমান অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন কৌশল গ্রহণ করার।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতির ভিত্তিতে তার কূটনীতি পরিচালনা করে এসেছে। এটি তাত্ত্বিকভাবে মহৎ শোনালেও বাস্তবে সব সময় তা যে কার্যকর হয়নি, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুধু বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে চলে না। বরং এটি স্বার্থ, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং কৌশলগত অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বিশ্বপরিসরে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকেও বাস্তববাদী ও কৌশলগত পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে, যা জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু দেশের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। উদাহরণ হিসেবে ভারতের সঙ্গে একতরফা ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির কথা বলা যায়। ক্ষমতাচ্যুত সরকার ও তার পৃষ্ঠপোষক অর্থনীতিবিদরা দাবি করেছিলেন, এসব চুক্তির ফলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো বাণিজ্যিক হাব হয়ে উঠবে। বাস্তবে দেখা গেছে, এতে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের লাভই বেশি।
গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে মূল্যায়ন করে সরকার এখন কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্মূল্যায়নে বাধ্য হচ্ছে। তাই সামনে চলে এসেছে নতুন পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োজনীয়তা। নীতিগতভাবে ও তাত্ত্বিক দিক থেকেও একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় স্বার্থের প্রতিফলন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি ছিল আত্মমর্যাদা, সার্বভৌমত্ব ও মানবিক মর্যাদা। কিন্তু গত কয়েক দশকে আমাদের কূটনীতি ক্রমেই আন্তর্জাতিক শক্তির কাছে নতিস্বীকারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সেই ভুলগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানোর সুযোগ এনে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশকে এমন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে জাতীয় মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস হবে না। সেদিকে এগোনোর সময় তাই লক্ষ্য রাখতে হবে কিছু বিষয়।
প্রথমত, মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করাই হতে হবে নতুন কূটনৈতিক কৌশলের মূলনীতি। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে শ্রমিক, পেশাজীবী ও উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছে। তাদের অধিকার, সুরক্ষা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক উদ্যোগকে আরও সক্রিয় করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অবশ্যই সমান মর্যাদা বজায় রাখতে হবে। বিশ্বপরিসরে নতজানু ভঙ্গির বদলে শক্তিশালী ও আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে হবে।
তৃতীয়ত, গণঅভ্যুত্থান শিখিয়েছে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কেবল সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি নয়; জনগণের মতামত বিদেশনীতি নির্ধারণে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা-ও দেখিয়ে দিয়েছে। অতীতে বিদেশি শক্তির সঙ্গে চুক্তি করার সময় জনমতের গুরুত্ব খুব বেশি দেওয়া হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা স্পষ্ট করেছে, জনগণের চাওয়াকে উপেক্ষা করা হলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। ভবিষ্যতে সরকার যদি পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে, তাহলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যেতে পারে– এ কথা বলাই বাহুল্য।
বর্তমান সরকার বুঝতে পারছে, শুধু বড় দেশগুলোর সমর্থনে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তিধর রাষ্ট্র কাকে সমর্থন করবে, তা তাদের নিজস্ব স্বার্থে নির্ধারিত হয়। অতীতে দেখা গেছে, প্রয়োজন পড়লে আন্তর্জাতিক মিত্ররাও নিজেদের স্বার্থে সম্পর্কের হিসাবনিকাশ বদলে ফেলে। তাই বাংলাদেশকে নিজের কৌশল নিজেকেই ঠিক করতে হবে, যেখানে জনগণের ইচ্ছা হবে প্রধান বিবেচ্য।
পররাষ্ট্রনীতিতে কৌশলগত পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। চীন ১৯৭৮ সালে অর্থনৈতিক উন্মুক্ততা গ্রহণ করে; তুরস্ক একুশ শতকের গোড়ায় বহুমুখী কূটনীতির দিকে ঝুঁকেছিল; ফ্রান্স ১৯৬৬ সালে ন্যাটো থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিল।
বাংলাদেশ এতদিন ধরে নির্দিষ্ট কিছু দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করে চলছিল। এই নির্ভরশীলতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও ছিল। ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে অনেক সময় বাধ্য হয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যা নিজের স্বার্থের পরিপন্থি। কিন্তু এখন সময় এসেছে এই পুরোনো ধাঁচের নীতি থেকে বেরিয়ে এসে শক্তিশালী ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলার।
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, সব দেশই সমান মর্যাদার অধিকারী। জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ ১(২) ও ২(১) অনুযায়ী এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সমান মর্যাদা পাওয়ার দাবিদার। অতএব, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত এমন, যেখানে আমরা কারও তল্পিবাহক হয়ে থাকব না, বরং বিশ্বমঞ্চে সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করব। সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে কোনো আপস নয়।
পররাষ্ট্রনীতির এই পরিবর্তনের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন, যারা আন্তর্জাতিক চাপের কাছে মাথা নত করবে না। বর্তমানে সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছে যে, কেবল ক্ষমতায় থাকার জন্য বিদেশি শক্তির আশীর্বাদ কামনা তাদের চরিত্র নয়। বরং তারা জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।
এই কৌশলগত পরিবর্তন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও দৃঢ় অবস্থান নিতে সাহায্য করবে। কূটনীতির ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থান নিতে হলে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, কূটনীতিকদেরও নতুনভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমাদের প্রতিনিধিত্ব এমন হতে হবে, যেখানে আমরা অন্যদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল নই, বরং সমান শর্তে আলোচনা করতে পারি।
বাংলাদেশকে অবশ্যই তার পুরোনো পররাষ্ট্রনীতি ঝেড়ে ফেলে, আত্মমর্যাদা ও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। সময় এসেছে, যখন বাংলাদেশকে বিদেশি শক্তির দিকে তাকিয়ে না থেকে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় শক্ত অবস্থান নিতে হবে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান কেবল সরকারের জন্য নয়, কূটনীতির ক্ষেত্রেও এক শিক্ষণীয় অধ্যায় তৈরি করেছে। এখন প্রয়োজন সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী, আত্মনির্ভরশীল ও সম্মানজনক একটি পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন।
আলাউদ্দিন মোহাম্মদ: যুগ্ম সদস্য সচিব, এনসিপি
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন ২০২৪ স ল র ন শ চ ত কর ন র ভরশ ল অবস থ ন ন ক টন ত ক র জন ত ক ক শলগত জনগণ র র ওপর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ট্যাগিং রাজনীতি যে সর্বনাশ ডেকে আনবে
বর্তমান রাজনীতিতে ‘ট্যাগিং’ একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হিসেবে হাজির হয়েছে। তা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠী, এমনকি ব্যক্তিরাও এখন একে অপরকে ভুল তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে বদনাম করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ‘ট্যাগিং রাজনীতি’ বলতে মূলত বোঝায়, কোনো ব্যক্তি বা দলকে মিথ্যা লেবেল দিয়ে তাদের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া ও সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা।
২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ট্যাগিং রাজনীতি শুরু হয়। তখন রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিভাজনকে কিছু সহজ পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করা হয়। যেমন শাহবাগি বনাম ইসলামপন্থী, ভারতপন্থী বনাম পাকিস্তানপন্থী, রাজাকার বনাম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এই বিভাজন শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা সামাজিক সম্পর্কেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল, যা এখনো রয়ে গেছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের পর এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরমভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দল নিজেদের স্বার্থে প্রতিপক্ষকে বিশেষ লেবেল দিয়ে তাদের দুর্বল করার কৌশল নিচ্ছে। প্রায় সব দলই এই খেলায় লিপ্ত। কিছু রাজনৈতিক নেতা, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ইউটিউবার, এমনকি কিছু ভুঁইফোড় (চালায় দেন) সোর্স এই কাজে সিদ্ধহস্ত।
গঠনমূলক আলোচনা বা দেশ পরিচালনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা না বলে, কিছু দল ও গোষ্ঠী ভুল তথ্য, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও আবেগপ্রবণ প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের মত পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। এই কৌশল স্বল্পমেয়াদে কারও জন্য লাভজনক হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি গণতন্ত্র ও সামাজিক ঐক্যের জন্য বিপজ্জনক।
১৯৭৫-৭৭ সালে ভারতের জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর সরকার বিরোধীদের ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এটি সাময়িকভাবে তাঁকে ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করলেও, পরে জনগণের ক্ষোভ বেড়ে যায়। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টি বড় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। একইভাবে, এরদোয়ানের সরকার তুরস্কে প্রায়ই বিরোধী নেতাদের বিদেশি শক্তির সহযোগী বলে অভিযুক্ত করে।
প্রশ্ন হলো, এই অভিযোগ ও ট্যাগিং কৌশল সত্যিই কাজে দেয় কি না। শুরুতে এটি কিছু দলকে দুর্বল করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সবাই সবার প্রতি সন্দেহ ঢুকে যায়। যদি সব দলকে বারবার মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুর্নাম করা হয়, তাহলে জনগণ আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস রাখবে না।
এই সমস্যা শুধু রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সমাজ ও সংস্কৃতিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ট্যাগিং রাজনীতি মানুষের দৈনন্দিন সম্পর্ক, কর্মস্থল, এমনকি ধর্ম ও লিঙ্গভিত্তিক আলোচনাতেও প্রভাব ফেলছে। মানুষ ভিন্নমত পোষণ করলেই তাকে একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ে বাঁধা হচ্ছে, যা সমাজকে বিভক্ত করছে এবং স্বাভাবিক আলোচনা কঠিন করে তুলছে।
যদি এই বিভ্রান্তির রাজনীতি চলতে থাকে, তাহলে তা একসময় শুধু কোনো নির্দিষ্ট দলকে নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবে। সময় থাকতেই এই ভুল না শোধরানো দরকার। তা না হলে মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বিশ্বাস হারাবে এবং নিজেদের প্রয়োজনে ভিন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তখন তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।বিশ্ববিদ্যালয় ও অফিসে মতাদর্শ নিয়ে বিতর্ক আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। কেউ ভিন্ন মত দিলেই তাকে শুধু বিরোধী নয়, বরং বিশ্বাসঘাতক, উগ্রবাদী বা বিদেশি এজেন্ট বলা হচ্ছে। নারী অধিকারকর্মী, সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবীদের কাজের স্বীকৃতি না দিয়ে তাদের গোপন রাজনৈতিক স্বার্থের অংশ হিসেবে দেখা হয়। ধর্মীয় আলোচনায়ও ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেই তাকে হয় চরমপন্থী, নয়তো অতিরিক্ত উদারপন্থী বলে ট্যাগিং দেওয়া হয়।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বুর্দিয়ু বলেছেন, ক্ষমতার লড়াই শুধু রাজনীতিতে নয়, সংস্কৃতিতেও চলে। আর ট্যাগিং বা লেবেলিং হলো একধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, যা স্বাধীন চিন্তাকে দমন করে এবং মানুষকে নির্দিষ্ট ছকে ফেলে দেয়। এর ফলে সমাজে বিশ্বাস ও আলোচনার পরিবেশ নষ্ট হয়, আর সন্দেহ ও বিভাজন বেড়ে যায়।
আজ মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া ট্যাগিং ও ভুল তথ্য ছড়ানোর বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ইউটিউব, ফেসবুক ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে ভিত্তিহীন অভিযোগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সমস্যা হলো, অনেক মানুষ মূলত সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই খবর পান, তাই তাঁরা সহজেই বিভ্রান্ত হন। ভুল তথ্যের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়। যদি কাউকে মিথ্যা দোষারোপ করা হয়, সত্য প্রকাশ পেলেও সাধারণ মানুষ তাঁর সম্পর্কে খারাপ ধারণা নিয়েই থাকেন।
বাংলাদেশেও ভুল তথ্য রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি শুধু একটি দলের জন্য সমস্যা নয়, বরং পুরো গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। যদি সত্যের চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ বড় হয়ে যায়, তাহলে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সত্যের কোনো মূল্যই থাকবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে এক্স (সাবেক টুইটার) ভুল তথ্য ছড়ানোর বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। রাশিয়ার ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও পোস্ট ব্যবহার করে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেয়। ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভোট জালিয়াতির অভিযোগ দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এই গুজব থেকে ‘স্টপ দ্য স্টিল’ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা ২০২১ সালের ক্যাপিটল দাঙ্গার কারণ হয়। ভুল তথ্যের কারণে অনেক ভোটার এখন আর নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্রের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।
রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘বিদেশি এজেন্ট’ বলে ট্যাগিং দেওয়া এখন সাধারণ ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রে, চরম রাজনৈতিক বিভাজন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মিথ্যা অভিযোগ ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব জনগণের আলোচনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতি নির্বাচনের সময় নতুন নতুন ভুল তথ্য ছড়ানো হয়, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে।
বাংলাদেশের রাজনীতিও এখন এক সংকটময় মোড়ে। বাংলাদেশেও ট্যাগিং প্রবণতা সাময়িকভাবে কাউকে সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি বিপজ্জনক। রাজনৈতিক দল, কর্মী ও মিডিয়ার বোঝা উচিত যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক। কিন্তু মিথ্যা তথ্য ও বিভ্রান্তি শেষ পর্যন্ত সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। রাজনীতিবিদদের উচিত বিভক্তি বাড়ানোর বদলে বাস্তব সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দিয়ে শাসন, অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা। জনগণ চায় এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে জনমতকে ভুল তথ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করে ভালো কাজের ভিত্তিতে নির্বাচন হয়।
যদি এই বিভ্রান্তির রাজনীতি চলতে থাকে, তাহলে তা একসময় শুধু কোনো নির্দিষ্ট দলকে নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবে। সময় থাকতেই এই ভুল না শোধরানো দরকার। তা না হলে মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বিশ্বাস হারাবে এবং নিজেদের প্রয়োজনে ভিন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তখন তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার, শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়