ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে কি আমরা ভেবেছি?
Published: 10th, March 2025 GMT
কয়েক দিন পরপর সংবাদমাধ্যমে খবর হয়, ঢাকা আজ বিশ্বের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বায়ুদূষিত নগরী। কখনও কখনও ঢাকাকে পাল্লা দিতে হয় কাম্পালা (উগান্ডা), দিল্লি কিংবা বেইজিংয়ের সঙ্গে। সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান (আইকিউএয়ার) বায়ুদূষণের ওপর নিয়মিত ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর’ প্রকাশ করে। এই স্কোরের ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর, স্বাস্থ্যকর কিংবা অধিক স্বাস্থ্যকর শ্রেণির নগরীর তথ্য প্রকাশ করা হয়। খবরজুড়ে শুধু স্কোরগুলোর এক ধরনের ব্যবচ্ছেদ করা হয়। আমার মতে, স্কোরগুলোর ব্যবচ্ছেদ না ছাপিয়ে শুধু ঢাকার অবস্থান জানালেই চলে।
ঢাকার বায়ুদূষণের একটি বড় অংশ আসে যানবাহন, শিল্পকারখানা ও নির্মাণকাজ থেকে। ডিজেল ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বিপুল পরিমাণ কার্বন ও উদ্বায়ী জৈব যৌগ নির্গত হয়, যা যানবাহন ও কলকারখানা থেকে আসে। একই সঙ্গে খোলা জায়গায় বর্জ্য পোড়ানোর ফলে অপরিপূর্ণ দহন হয়। যার ফল বড় মাত্রায় কালো কার্বন। এ ছাড়া ইটভাটা বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া ও কুয়াশা সৃষ্টি করে, যা কার্বন মনোক্সাইড ও ওজোন নির্গত করে। অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ থেকে ছড়িয়ে পড়ে ধুলাবালি, বিশেষ করে সূক্ষ্ম কণা (যেমন সিলিকা ধুলা, মাটি ও পাথরের সূক্ষ্ম কণা)। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন ডিজেল কিংবা তেলচালিত ১৫ লক্ষাধিক যানবাহন চলাচল করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের ২৫-৩০ শতাংশ উৎস যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া। ঢাকার আশপাশে ৭ সহস্রাধিক ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড বাতাসের প্রধান দূষক।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ৩৫-৪০ শতাংশ বায়ুদূষণের জন্য দায়ী ইটভাটা। তা ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন শিল্প এলাকা যেমন– সাভার, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরে নির্মাণসামগ্রী এবং রাসায়নিক বর্জ্য থেকে ভয়াবহ দূষণ তৈরি হচ্ছে।
ঢাকায় প্রতিবছর গড়ে দুই থেকে তিন হাজার নতুন বাসাবাড়ি-প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ চলে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্যানুসারে, শহরের ১৫-২০ শতাংশ বায়ুদূষণের জন্য দায়ী নির্মাণকাজ। সিটি করপোরেশনের বাইরেও আশপাশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে এসবের ব্যাপকভিত্তিক কর্মযজ্ঞ চলে। নির্মাণ সাইটগুলোতে সিমেন্ট, বালি, ইটের গুঁড়ো এবং রাস্তার ধুলাবালি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, যা ফুসফুসের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর একটি বড় অংশ খোলা জায়গায় পোড়ানো হয়।
২০২৩ সালে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ১৩৭তম স্থানে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান দূষণের কারণে ভবিষ্যতে বাসযোগ্যতার অবনতি ঘটবে, যা নগর পরিকল্পনার জন্য উদ্বেগজনক। বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের বার্ষিক ৪ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে।
পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। ইলেকট্রিক বাস, মেট্রোরেল এবং আধুনিক সিএনজি যানবাহনের সংখ্যা বাড়ালে জ্বালানির অপচয় কম হবে এবং ধোঁয়া ও দূষণ কমাবে। বিভিন্ন গবেষণামতে, ইলেকট্রিক যানবাহন প্রচলন করলে বায়ুদূষণ ২০-৩০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। নির্মাণস্থলে ধুলা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দরকার। উন্নত প্রযুক্তি যেমন– জলীয় স্প্রে, অস্থায়ী ঢাকনা ব্যবহার নিশ্চিত এবং নির্মাণের সময় কঠোর নিয়ম প্রয়োগ করা। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রিত নির্মাণ সাইট পরিচালনার মাধ্যমে ধুলাবালির পরিমাণ ২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব।
ইটভাটার বিকল্প ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অটোক্লেভ্ড অ্যারেটেড কংক্রিট প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, যা ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব, সেই সঙ্গে দূষণ কমায়।
বৈজ্ঞানিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং বাস্তবায়ন দ্রুত গ্রহণ করা দরকার। খোলা জায়গায় আবর্জনা পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং আধুনিক ও সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি চালু করা দরকার।
সবুজায়ন প্রকল্প চালু করা জরুরি। শহরের প্রতিটি ফাঁকা জায়গায় বৃক্ষরোপণ প্রকল্প চালু হলে তা কার্বন শোষণের মাধ্যমে বায়ুর মান উন্নত করবে। বিজ্ঞানীদের মতে, শহরের ১০ শতাংশ বেশি গাছ লাগালে বাতাসে কণা ২০-২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। পরিবেশ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা দরকার। বিদ্যমান বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণামতে, শক্তিশালী পরিবেশনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে বায়ুদূষণ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব।
বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম দূষিত ঢাকার বাতাস। এটি শুধু স্বাস্থ্য নয়; অর্থনীতি এবং বাসযোগ্যতার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। সরকারের উচিত দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন বাস্তবায়ন এবং নাগরিকদের আরও সচেতন করা। পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে সরকারকেই। তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সুস্থ ও বাসযোগ্য ঢাকা পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারবে।
ড.
গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
hasinur@du.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব শ বর জ য ন র গত পর ব শ র জন য ক র বন শহর র র ওপর দরক র ইটভ ট
এছাড়াও পড়ুন:
বিশ্বকে বদলে দেওয়ার যাত্রায় যুক্ত হোন
বিশ্বকে বদলাতে চাইলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যার বিশ্বকে বদলে দেওয়ার দুর্দান্ত সব আইডিয়া রয়েছে। এসব আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। তাই আমরা আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই, যেন আপনারা শুধু বাংলাদেশকে নয়, পুরো বিশ্বকে বদলে দেওয়ার যাত্রায় যুক্ত হোন।’
গতকাল বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে তিনি এ কথা বলেন। গত সোমবার শুরু হওয়া চার দিনের এই শীর্ষ সম্মেলনে দেশের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের সুযোগ এবং অর্থনৈতিক সংস্কার তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘ব্যবসার জন্য সেরা জায়গা বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ব্যবসা নিয়ে আসুন এবং এর মাধ্যমে বিশ্ব বদলে দিতে ভূমিকা রাখুন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যদি কোনো লক্ষ্য নিয়ে ব্যবসা করতে চান, তাহলে বাংলাদেশই আপনার সেই জায়গা। বাংলাদেশ কাজ করে দেখায়। আর একবার কেউ শুরু করলে অন্যেরা তা অনুসরণ করে।’
বাসসের খবরে বলা হয়, কীভাবে মানুষ ব্যবসার মাধ্যমে সুখী হয়, তা বর্ণনা করেছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘টাকা উপার্জন করে মানুষ নিঃসন্দেহে সুখ পায়। কিন্তু অন্যকে সুখী করার মধ্যে সুপার সুখ নিহিত রয়েছে।’
সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে ব্যবসায়ীদের যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যদি আপনি বাংলাদেশে ব্যবসা করেন, তাহলে আপনি সুখ এবং সুপার সুখ দুটিই পাবেন। কোনো খরচ ছাড়াই এই সুপার সুখ আপনি লাভ করতে পারেন এবং এটি করে আপনি গর্বিত হবেন।’
ইউনূস জানান, তিনি শুধু বাংলাদেশ নয়; এ অঞ্চলকে সম্ভাবনা হিসেবে দেখেন। তিনি একই সঙ্গে অর্থ উপার্জন এবং মানুষের জীবন পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য বিশ্ব বদলে দেওয়ার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এবং এর মাধ্যমে নতুন সভ্যতা গঠনের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন।
তিনি বলেন, ‘আপনাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এই সুপার সুখ উপভোগ করতে পারবে, যদি তারা তাদের প্রভাব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে।’
স্পেন থেকে অস্কার গার্সিয়া, যুক্তরাজ্য থেকে রোজি উইন্টারটন এবং বাংলাদেশ থেকে নাসিম মঞ্জুর অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বাংলাদেশে ব্যবসা এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।
টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরির লক্ষ্যে এই শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিনিয়োগকারী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক নির্বাহী এবং নীতিনির্ধারকরা।
সরকার নয়, ব্যবসার মাধ্যমে তিন শূন্য
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বলছি, আমরা তিন শূন্যর একটি পৃথিবী তৈরি করতে পারি। এটা সরকার দিয়ে নয়, ব্যবসার মাধ্যমে করা সম্ভব। কারণ এটা সরকারের কাজ নয়; মানুষ হিসেবে আমাদের কাজ।’
নতুন সভ্যতা হবে এমন– যেখানে কার্বন নির্গমন থাকবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তা করতে পারি। এটি হওয়া উচিত ব্যবসায়িক উদ্ভাবনী কার্যক্রমের মাধ্যমে।’
কার্বন নিঃসরণকে আত্মবিধ্বংসী ব্যবস্থা আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘অর্থ উপার্জন আনন্দের হলেও সম্পদের কেন্দ্রীকরণ মানব জাতির জন্য বিপজ্জনক। এটি পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলবে।’
তিনি শূন্য বেকারত্বের ধারণার প্রতিও গুরুত্ব দেন এবং বলেন, ‘তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে বিশ্বকে বদলে দিতে সক্ষম।’
শূন্যক্ষুধা প্রসঙ্গে তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ওই সময় প্রায় ১৫ লাখ মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যায়।’
শোনালেন গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণফোন শুরুর গল্প
উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের ড. ইউনূস শোনান গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। তিনি বলেন, ‘দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে একটি ছোট উদ্যোগ এসেছে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে। মানুষকে ২ বা ৩ ডলারের মতো ছোট ঋণ দেওয়া হতো, যেন তারা ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারে, বিশেষভাবে নারীদের ওপর গুরুত্ব দিয়ে। কারণ নারীরা ছিল সবচেয়ে অসহায়। এই ধারণা মাইক্রোক্রেডিট নামে পরিচিত হয়। আমরা একটি ব্যাংক তৈরি করি, যার নাম গ্রামীণ ব্যাংক।’
তিনি বলেন, ‘কেউ জানত না– শেষ পর্যন্ত এটি কোথায় গিয়ে পৌঁছবে। কিন্তু এটা হয়ে উঠল একটি বৈশ্বিক নাম। কারণ আপনি যে দেশে থাকুন না কেন, আপনার ভেতরে একটু হলেও ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ লুকিয়ে আছে। আপনি তা হয়তো চিনতে পারেন না, কিংবা লুকিয়ে রাখেন। আপনি জনগণের টাকা তাদের (দরিদ্রদের) দিয়ে দেন। ভাবেন, এটাই সমাধান। কিন্তু গরিব মানুষকে শুধু সরকারি টাকা দেওয়াটা কোনো সমাধান নয়। আসল সমাধান হলো একটি কাঠামো তৈরি করা, এমন একটি ব্যবস্থা, যা মানুষের শক্তিকে মুক্ত করে দেয়। মাইক্রোক্রেডিট ছিল সেই উদ্যোগের একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ।’
১৯৮৩ সালে সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২৮ বছর গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন ইউনূস। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূসকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
গ্রামীণফোনের লাইসেন্স নেওয়ার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তখন আমাদের কোনো ফোন ছিল না। শহরে হাতেগোনা কয়েকটা টেলিফোন ছিল। তার বেশির ভাগ কাজ করত না। তখন ভাবলাম, কেন আমরা একটা টেলিফোন কোম্পানির লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি না? একেবারে পাগলাটে একটা ভাবনা ছিল। সরকার জিজ্ঞাসা করল, এই টেলিফোন লাইসেন্স দিয়ে কী করবে? আমি বললাম, এটা গরিব মহিলাদের হাতে তুলে দেব। ওরা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শেষমেশ লাইসেন্স পেয়ে যাই। কেউ আমাদের সঙ্গে অংশীদার হতে চাইল না। কারণ আমাদের কোনো জ্ঞান ছিল না, কিছু জানতাম না। তখন সবাই বলত, বাংলাদেশ মোবাইল ফোনের জন্য উপযুক্ত জায়গা না। এখানে মোবাইল ফোনের বাজার নেই।’
শেষ পর্যন্ত নরওয়ের টেলিনর কোম্পানি অংশীদার হতে রাজি হয়। সেই কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, ‘শুরুতে তাদের বোর্ড রাজি হয়নি। পরে তারা সম্মত হয়। এর পর তো এটি দেশের সর্ববৃহৎ টেলিফোন কোম্পানিতে রূপ নেয়।’
যেভাবে পোশাকশিল্পের শুরু
দেশের পোশাকশিল্পের শুরুর দিকের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘৭০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কিছু সাহসী তরুণ, যারা অন্যরকম কিছু করার সাহস দেখিয়েছিল। বিদেশের গার্মেন্ট শিল্প দেখে তারা বলেছিল, কেন আমাদের না? এটি ছিল বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের সূচনা।’
ইউনূস বলেন, ‘এটি ছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের একটি যাত্রা। এখন দেশের তৃতীয় প্রজন্ম উঠে আসছে।’
স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে যুক্তরাজ্যের সহায়তা কামনা
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যকে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন ইউনূস। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন। বৈঠকে উভয় পক্ষ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে।
বাংলাদেশে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতির কথা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমাদের বর্তমানে নার্সের সংকট রয়েছে। নার্সিং শুধু জাতীয় সমস্যা নয়। এটি একটি বৈশ্বিক প্রয়োজন। আমরা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য আরও নার্সকে প্রশিক্ষণ দিতে চাই।’
যুক্তরাজ্যকে সহায়তার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য কার্যক্রম প্রায় অকার্যকর। এখানে যুক্তরাজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
আরেকটি সম্ভাবনাময় খাত হলো ওষুধ শিল্প। আমরা অনুরোধ করছি, পেটেন্ট তুলে নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিন। এতে প্রতিটি দেশ সাশ্রয়ী টিকা উৎপাদন করতে পারবে।’
উভয় পক্ষ শিক্ষা, টেক্সটাইল শিল্প, প্রতিরক্ষা, উড়োজাহাজ চলাচলসহ কৌশলগত সহযোগিতার আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করে। ব্যারোনেস উইন্টারটন বর্তমান সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি যুক্তরাজ্য সরকারের সমর্থন জানান। তিনি বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্কার কর্মসূচির প্রধান আলী রীয়াজের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করল হোলসিম গ্রুপ
হোলসিম গ্রুপের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের প্রধান মার্টিন ক্রিগনার গতকাল ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বৈঠকে দেশের সিমেন্ট খাতের ব্যবহার প্রবণতা, শিল্পটির পরিবেশগত প্রভাব এবং বাংলাদেশের বাজারে হোলসিমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। ক্রিগনার বাংলাদেশের বাজারে দীর্ঘ মেয়াদে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
হোলসিম গ্রুপ হলো লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের মূল কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি সুনামগঞ্জের ছাতকে কারখানা পরিচালনা করছে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে।
বাংলাদেশে হোলসিমের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল চৌধুরী জানান, প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘অ্যাগ্রিগেটস’ চালু করেছে, যা দেশের শত শত মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে সহায়তা করবে।
অধ্যাপক ইউনূস ছাতকের লাফার্জ কারখানায় পুনর্ব্যবহারের অযোগ্য প্লাস্টিক (নন-রিসাইকেবল) ব্যবহারের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে জানতে চান। হোলসিম আশ্বস্ত করে– এই জ্বালানির ব্যবহার কার্বন নির্গমন ঘটাবে না।
বৈঠকে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
সম্পর্ক জোরদার করতে চায় ইন্ডিটেক্স
স্পেনের শীর্ষস্থানীয় পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অস্কার গার্সিয়া ম্যাসেইরাস গতকাল ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে উভয় পক্ষ পারস্পরিক আগ্রহের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
ইন্ডিটেক্স বিশ্বের বৃহত্তম ফাস্ট ফ্যাশন গ্রুপ, যার মালিকানায় রয়েছে জারা, বারশকা এবং মিসিমো ডাটের মতো ব্র্যান্ড।
বাংলাদেশকে ইন্ডিটেক্সের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সোর্সিং হাব হিসেবে অভিহিত করে অংশীদারিত্ব আরও গভীর করার আগ্রহ জানান ম্যাসেইরাস। তিনি ঘোষণা দেন, চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পোশাক কারখানার ৫০ নারী কর্মীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার ব্যয় বহন করবে ইন্ডিটেক্স। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্প্যানিশ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ‘ইন্ডিটেক্স চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলেও জানান ম্যাসেইরাস।
বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান ইউনূস। বৈঠকে উপস্থিত ইন্ডিটেক্স কর্মকর্তারা জানান, শিগগির প্রতিষ্ঠানটি সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ার-কার্গো পরিবহন শুরু করবে।
তরুণ উদ্যোক্তা এক্সপো উদ্বোধন
বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘তরুণ উদ্যোক্তা এক্সপো ২০২৫’ গতকাল উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। এই এক্সপোর লক্ষ্য হলো, তরুণ প্রজন্মের উদ্যোক্তা মানসিকতাকে তুলে ধরা এবং উদীয়মান উদ্যোগগুলোর সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপন।