ধর্ষণ প্রতিরোধে কাঠামোগত যে পরিবর্তন জরুরি
Published: 10th, March 2025 GMT
ধর্ষণ নিঃসন্দেহে ব্যক্তিগত অপরাধ। তবে এটি সামাজিক ও কাঠামোগত সমস্যাও বটে, যা সমাজের বিদ্যমান ক্ষমতার ভারসাম্য, লিঙ্গগত বৈষম্য এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে আইনের শৈথিল্য, বিচারহীনতা, পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সামাজিক নীরবতার মতো নানা কারণ কাজ করছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও আইনগত প্রতিকার প্রয়োজন হলেও শুধু এসব পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। কাঠামোগত পরিবর্তন ব্যতীত ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। কারণ এটি শুধু অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির বিষয় নয়; বরং সমাজে নারীর অবস্থান, অর্থনৈতিক ক্ষমতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত।
বাংলাদেশে ধর্ষণ-সংক্রান্ত মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল। ফলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। কথায় আছে– ‘জাস্টিস ডিলেইড জাস্টিস ডিনাইড’। এ ছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব থাকার কারণে তারা শাস্তি এড়াতে সক্ষম হয়। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করে এবং সমাজে একটি বার্তা পাঠায়– ধর্ষণ করেও পার পাওয়া সম্ভব। তাই ধর্ষণের বিচার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও কার্যকর করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন; পুলিশ ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং ভুক্তভোগীদের জন্য নিরাপদ আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা জরুরি।
নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও স্বনির্ভরতা ধর্ষণ প্রতিরোধের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। বাংলাদেশে নারীদের একটি বড় অংশ এখনও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নয়। ফলে তারা পরিবারের ওপর নির্ভরশীল এবং অনেক সময় নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েও তা প্রকাশ করতে পারে না। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, সমান মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করলে নারীরা অধিক আত্মনির্ভরশীল হবেন এবং লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শক্তি পাবেন।
গণমাধ্যম ও বিনোদন জগতে নারীদের উপস্থাপনা ধর্ষণের সংস্কৃতির বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অনেক ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র, নাটক ও বিজ্ঞাপনে নারীদের ‘বস্তু’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা নারীর জন্য মর্যাদাহানিকর। যেহেতু মানুষের সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় গণমাধ্যম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, তাই সব ধরনের গণমাধ্যমে নারীদের ইতিবাচক ও মর্যাদাসম্পন্নভাবে উপস্থাপন এবং ধর্ষণের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো ধর্ষণ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে।
প্রযুক্তিগত নিরাপত্তা ও ডিজিটাল অপরাধ প্রতিরোধের বিষয়ও ধর্ষণের কাঠামোগত সমাধানে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে নারীরা অনলাইন হয়রানির শিকার হচ্ছেন, যা অনেক সময় সাইবার ব্ল্যাকমেইল ও ধর্ষণের মতো অপরাধের সূত্রপাত করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি অনৈতিকভাবে ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে, যা তাদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সাইবার আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যকর মনিটরিং নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকাও ধর্ষণ প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমাজে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বিনির্মাণে বিশাল প্রভাব ফেলে। যদি এসব প্রতিষ্ঠান নারীর মর্যাদা, লিঙ্গ সমতা ও ধর্ষণবিরোধী বার্তা প্রচার করতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়, তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কিছু বিতর্কিত ধর্মীয় নেতা নারীদের পোশাক বা আচরণ নিয়ে কট্টর মনোভাব পোষণ করেন, যা ধর্ষণের জন্য নারীকেই দায়ী করার প্রবণতা তৈরি করে। এই মনোভাব পরিবর্তন করতে হলে ধর্মীয় নেতাদের সচেতন করা ও ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি।
ধর্ষণ প্রতিরোধে কমিউনিটি পর্যায়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ধর্ষণের ঘটনা অনেক সময় ধামাচাপা দেওয়া হয় বা সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়, যা অপরাধীদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। কমিউনিটি ওয়াচ গ্রুপ, নারীদের স্ব-সহায়ক দল ও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এতে নারীরা সাহসী হয়ে অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবেন এবং সমাজেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। পুরুষদের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া ধর্ষণ প্রতিরোধ সম্ভব নয়। পুরুষদের মধ্যে যদি ছোটবেলা থেকেই নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেওয়া এবং তাদের বোঝানো হয়– নারীর সম্মতি ছাড়া কোনো সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়, তাহলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। ‘মাচো সংস্কৃতি’ বা পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ এবং পুরুষদের এ বিষয়ে শিক্ষিত করা ধর্ষণ প্রতিরোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে।
ধর্ষণ প্রতিরোধে কাঠামোগত পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ, তবে এটি ছাড়া কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশে ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু আইনি ব্যবস্থা বা শাস্তির বিধান যথেষ্ট নয়। বরং সামাজিক মানসিকতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক নীতি, গণমাধ্যমের ভূমিকা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বিত পরিবর্তন প্রয়োজন। নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সমাজ গড়ে তুলতে হলে শুধু ধর্ষকদের শাস্তি দিলেই হবে না, বরং ধর্ষণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার পথগুলোও চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এটাই ধর্ষণ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর ও স্থায়ী উপায়।
মো.
বাংলাদেশ পুলিশ, বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি
অব ওয়ারউইকে পিএইচডি গবেষক
emranahmmed1991@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ অপর ধ দ র ক ঠ ম গত ব যবস থ ক র যকর ক ত গত র জন য ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপের ইচ্ছার কথা জানালেন জেলেনস্কি
ইউক্রেনের সুমি ও রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে নতুন সাফল্যের কথা জানিয়েছে মস্কো। অপরদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে সৌদি আরবে আলোচনায় বসার আগে মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি গঠনমূলক সংলাপ করতে সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
মঙ্গলবার লোহিত সাগরের তীরবর্তী শহর জেদ্দায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদল বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। এই বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যুদ্ধবিরতি এবং শান্তি চুক্তির জন্য একটি ‘কাঠামো’ নিশ্চিত করার জন্য জোর চেষ্টা চালাবেন।
আসন্ন আলোচনা সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, কুরস্ক সীমান্তের কাছে সুমি এলাকায় ছোট গ্রাম নোভেনকে ‘মুক্ত’ করেছে তাদের বাহিনী। এছাড়া কুরস্কের লেবেদেভকা, মালায়া লোকনিয়া, চেরকাসকোয়ে পোরেচনয়ে এবং কোসিৎসা গ্রাম পুনরুদ্ধারের ঘোষণাও দিয়েছে মস্কো।
২০২২ সালে সর্বাত্মক আক্রমণের প্রথম দিকে ইউক্রেনের সুমি অঞ্চলের কিছু অংশ দখল করে নেয় রাশিয়া। কিন্তু এরপর থেকে সেখানে আর কোনো অঞ্চল দখল করেনি রুশ সেনারা।
রাশিয়ার নোভেনকে দখলের দাবির বিষয়ে কিয়েভ এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। বিশ্লেষকদের মতে, গ্রামটি রুশ সেনাদের ইউক্রেনের প্রধান সরবরাহ পথ বন্ধ করতে সহায়তা করতে পারে।
গত রোবার এক ব্রিফিংয়ে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘কেবল শক্তিশালী ফ্রন্ট-লাইনের ওপর ভিত্তি করে কূটনীতি শক্তিশালী হবে। আর আমরা ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনের চাহিদা পূরণের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।"
কে কার সঙ্গে দেখা করছেযুদ্ধের অবসান ঘটাতে কিয়েভকে আলোচনায় বাধ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন এক আলোচনায় জেলেনস্কির সঙ্গে হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রকাশ্য বিবাদ হয়। ফলশ্রুতিতে ইউক্রেনের সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি, স্যাটেলাইটের তথ্যে প্রবেশাধিকার ও দেশটিতে সাহায্য বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের মতে, একটি খনিজ চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে ট্রাম্পের ক্রোধের শিকার হয়েছেন তিনি। ওই চুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তবে ট্রাম্প প্রশাসন তা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। পরিবর্তে ইউরোপকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির জন্য সাহায্য বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।
ইউরোপীয় নেতারা রুশ হুমকির বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এরই মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে সম্মত হয়েছেন। ওয়াশিংটন ইউক্রেনের ন্যাটো উচ্চাকাঙ্ক্ষার ওপরও ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে।
গত শনিবার জেলেনস্কি নিশ্চিত করেছিলেন যে, তিনি সৌদি আরবে যাবেন এবং যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠকের পর ইউক্রেনের কূটনৈতিক ও সামরিক প্রতিনিধিরা মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মঙ্গলবার বৈঠক করবেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ১০ থেকে ১২ মার্চের মধ্যে ইউক্রেনীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য সৌদি আরব সফর করবেন।